পরবাসে বাংলা ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
‘নানান দেশের নানান ভাষা,
বিনে স্বদেশীয় ভাষা, পুরে কি আশা?’
রামনিধি গুপ্তের মতো আমারও নিজের ভাষা ছাড়া তৃষ্ণা মেটে না। অফিসে কাজ করতে করতে আপন মনে কত দিন যে সহকর্মীকে বাংলায় কিছু বলে ফেলেছি, আর সে বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর ফিক করে হেসে দিয়ে বলত, ‘ইউ আর অ্যাট ইওর ওয়ার্ক প্লেস ডিয়ার।’ বাংলায় অনেকক্ষণ কথা বলতে না পারলে আমার হাঁসফাঁস লাগে।
পরবাসে বাংলা চর্চার সুযোগ কম এ কথা যেমন সত্য তেমনি বাংলাকে অন্তরে ধারণ না করে, লালন না করে এর আভিজাত্য, এর নির্যাস নিতে না জানলে বাংলার প্রতি প্রেম-অনুরাগ জন্মাবে না কোনোকালেই। আমরা সুযোগের অভাবের দোহাই দিয়ে যতই এই ভাষাকে আড়ালে রাখব, ততই সে হয়ে যাবে পেছনের সারির। বাংলা রয়ে যাবে অবহেলিত মানুষের ভাষা। পৃথিবীর বুকে অসংখ্য ভাষার ভিড়ে হারিয়ে যাবে একদিন এই মধুময় ঐশ্বর্যময় ভাষাটি, যদি আমরা বাঙালিরাই প্রবাসে এর ব্যবহার সচেতনভাবেই কমিয়ে দিই।
যদিও এটি একান্তই ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ। আমরা ভাবি বিদেশে যখন এসেছি আমাদের সন্তানেরা শুদ্ধ ইংরেজি বলতে-লিখতে-পড়তে পারুক, এইই তো আমাদের চাওয়া উচিত। তবেই না ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। তাই আমাদের অনেক অভিবাসী বাবা-মা ঘরোয়াভাবেও বাংলায় কথা বলায় উৎসাহ তো দেনই না, বরং বাংলা না বলাটাকেই স্ট্যাটাস মনে করেন। পরবাসে বাংলা চর্চার কথা বলতে এলেই আমার ভবানী প্রসাদ মজুমদারের ভাষা নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কবিতাটির কথা মনে পড়ে যায়।
‘ছেলে আমার খুব ‘সিরিয়াস’ কথায়-কথায় হাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।’
উপরিউক্ত কবিতার চরণের ভাবার্থ হলো, বাংলা ভাষাভাষী মানুষের নিজের ভাষার প্রতি উদাসীনতা, হীনম্মন্যতা, তথা নিজ ভাষা ব্যবহারের প্রতি মানসিক দরিদ্র তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণমাত্র। মূলত কবি আমাদের মতো হতভাগা বাঙালিদের মনের কথাটাই তুলে ধরেছেন এই কবিতায়, যা প্রকারান্তরে আমাদের ভাষার প্রতি, নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি অশ্রদ্ধার দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করে।
শুধু বিদেশেই নয়, দেশেও সেই কৈশোর থেকেই এক লাইনের একটি বাক্য সাধারণত বাংলায় বলি না, তার মধ্যে দু–চারটে ইংরেজি শব্দ ঢুকিয়ে দিই, এতে বাক্যটা ওজনদার হয়, সেই সঙ্গে আমি নিজেও। নিজেকে খানিকটা ব্রাহ্মণ-পুরোহিত ধরনের মনে হয়, একটু মর্যাদা বেড়ে যায়। এই চর্চা সমাজের বহু পুরোনো। কেননা, ইংরেজি হলো সাহেবি ভাষা। এর কায়দাকানুনই আলাদা। মনে পড়ে, শৈশবে ভুল বানানে ইংরেজি লিখলে তিন ভুলের জন্য এক নম্বর কাটা যেত। একইভাবে বাংলার জন্য তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলই না। তাহলে আজও আমরা অশুদ্ধ বাংলা লিখতাম না। অশুদ্ধ লিখে আমরা লজ্জিত হতেও ভুলে যাই, কারণ, এ আর এমন কী? বরাবরই ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপারে আমাদের বিদেশ প্রীতিটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের। দুই শ বছর ইংরেজের পদলেহন করার ফলে ইংরেজি প্রীতিটাও মিশে গেছে অস্থি–মজ্জায়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, যে ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হয়েছে, যে ভাষায় আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য সবই হচ্ছে, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ অর্জন করেছে যে ভাষাভাষী মানুষেরা, সেই ভাষা রেখে নিজের ভাষা নিয়ে এত ঢাকঢোল পেটানোর কী আছে? আদতেই কিছু কি নেই? আজ যদি প্রশ্ন করি পৃথিবীর এমন কোনো জাতি আছে যারা নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য প্রাণ দিতে দ্বিধা করেনি? যারা রক্ত দিয়েই মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জন করে ইতিহাসে নিজেদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখেছিল? দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই ইতিহাস জানবে না। প্রয়োজন পড়বে না জানার।
ইউনেসকো আয়োজিত ২০২১–এর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘Fostering multilingualism for inclusion in education and society,’ ইউনেসকো বিশ্বাস করে টেকসই সমাজ উন্নয়নের জন্য সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বৈচিত্র্যতা রক্ষণাবেক্ষণ ও তার চর্চার পরিবেশ বজায় রাখা খুবই জরুরি। এতে মূলধারার সঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত অন্তর্ভুক্তি সহজতর হয়, যা বিশ্বব্যাপী একটি শান্তিপ্রিয় সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে।
সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী প্রথম বাঙালি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, যিনি বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে উপস্থিত করেছিলেন বিদেশি সাহিত্যকে বাংলায় তুলে এনেই। এই ভাষার মাধুর্য এবং এর অন্তর্নিহিত ভাব উপলব্ধি করে তিনি লিখেছিলেন, ‘ইংরাজিতে যাহা শিখিয়াছ তাহা বাংলায় প্রকাশ কর, বাংলা সাহিত্য উন্নতি লাভ করুক।’ তিনি জ্ঞান বিজ্ঞানের সব শাখায় বাংলা ব্যবহার করা সম্ভব বলেই দৃঢ়তা প্রকাশ করতেন। সবার আগে মাতৃভাষাকে তিনি স্থান দিতেন, তাঁর মতে, ‘আগে হতে হবে বাংলার শক্ত গাঁথুনি, তারপরে বিদেশি ভাষার গোড়াপত্তন।’ তিনি ইংরেজি শিক্ষার বিরোধিতা করেননি কখনোই। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, যাঁকে আমরা মহাকবি এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক হিসেবে জানি, তিনিও বিদেশ প্রীতির জন্য বাংলা ভাষাকে ত্যাগ করে একদিন দেশের মাটিতেই ফিরে এসেছিলেন এবং বাংলা ভাষার ভান্ডারে তিনি বিবিধ রতন খুঁজে পেয়েছিলেন।
বাঙালি জাতির স্বাধীনতা প্রাপ্তির সূতিকাগার রচিত হয়েছিল মহান ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে! বায়ান্নয় জাতিসত্তার যে বীজ রোপণ করা হয়েছিল, সেই বীজ ফুলেফেঁপে অঙ্কুরোদ্গম করে ১৯৭১–এ পরিপুষ্ট গাছে পরিণত হলো। আর আমরা ফিরে পেলাম স্বাধীন মুক্ত স্বদেশ ভূমি। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের এই যে ইতিহাস তা গৌরবের, ত্যাগের। আমাদের সন্তানদের সেই ত্যাগের ইতিহাস জানা জরুরি। সুতরাং আজকের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি, ইউনেসকো স্বীকৃত মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডের একচ্ছত্র গৌরব যে কেবল বাঙালির, সেই বীজটি ঢুকিয়ে দিতে হবে সন্তানদের মগজে-মননে। অভিভাবক হিসেবে সেই দায় তো আমাদেরই।
দুঃখজনকভাবে সত্য যে আজকাল ভাষা দিবস পালন হয়ে গেছে অনেকটা লৌকিক আচার পালনের মতো। আমাদের করপোরেট বেনিয়ারা নানা ঢঙে পসরা সাজায়, বিজ্ঞাপন বানায়, মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি ভাষা দিবসের পণ্যে মুড়ে রাখি নিজেদের, গান করি, স্লোগান দিই, আবৃত্তিও করি। কিন্তু সত্যিকারের রং কি আর মর্মে এসে লাগে? যে রং ছড়িয়ে যাওয়ার কথা ছিল সবখানে? ওই তো একটি দিনই! একটি দিনেই আমরা পান্তা ইলিশের বাঙালি, একটি দিনেই আমরা একুশের বাঙালি।
কানাডায় আদিবাসী ভাষাসহ প্রায় ২০০–এর অধিক ভাষা রয়েছে, যার মধ্যে বাংলাও একটি। ইউনেসকোর স্বীকৃতি প্রাপ্তির পর এ বিষয়ে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সদস্যরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক দিবস পালনের বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। হতাশার কথা হলো, বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ব্যক্তিগত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ছাড়া কানাডায় সরকারিভাবে এই দিনটি পালনের কোনো উদ্যোগ ইতিপূর্বে গৃহীত হয়নি। যদিও ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো ফেডারেল সরকারের কাছে একটি বেসরকারি বিল উত্থাপিত হয়েছিল, এর ফলে জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণ এখন প্রাপ্য আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে।
আফসোসের সঙ্গে লক্ষ করেছি অভিবাসী অধ্যুষিত শহর টরন্টোতে অনেক বাঙালি থাকা সত্ত্বেও সেই শৈশবের মতো করে দীর্ঘদিন একটি পোর্টেবল শহীদ মিনার তৈরি করে তাতেই দলে দলে বিভাজিত হয়ে(?) নানা বর্ণে-গন্ধে রং ছড়িয়ে ব্যানার হাতে করে সাদা–কালোয় সেজে ২০ ফেব্রুয়ারির রাত ১২টা ১ মিনিটে পুষ্পস্তবক অর্পণ করি। এই দৃশ্য বড়ই বেদনাদায়ক। তবে আশার কথা হলো, আইএমএলডির উদ্যোগে টরন্টো শহরে বড় শহীদ মিনার স্থাপিত হচ্ছে, যা কোভিডের কারণে এখনো নির্মাণাধীন। আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্মিলিত প্রচেষ্টাগুলো একদিন বড় সফলতা এনে দিতে পারে, এ তারই দৃষ্টান্ত। সুতরাং প্রবাসে বাংলাকে অধিক গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হলে ব্যাপক সমাদৃত করতে হলে আমাদের যেতে হবে আরও খানিকটা দূর। সে লক্ষ্যে আরও কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে, যা এখন সময়ের দাবি।
১। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি সরকারি উদ্যোগে প্রাদেশিক এবং ফেডারেল সরকারে পরিপূর্ণ মর্যাদায় পালন করার পরিপত্র জারি করা উচিত।
২। প্রতিটি প্রাদেশিক রাজধানী এবং বড় শহরে অন্ততপক্ষে একটি করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার স্থাপন করা, যাতে দিবসটিকে ঘিরে আলোচনা অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ইতিহাসবিষয়ক আলোচনা হতে পারে। যার মাধ্যমে এই প্রজন্মের শিশুরাসহ অন্য জাতিগোষ্ঠী দিবসটি সম্বন্ধে জানতে পারবে এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার ঘটবে।
৩। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস ও উৎপত্তিবিষয়ক টেক্সট পাবলিক স্কুলের কারিকুলাম বয়স ও শ্রেণিভেদে সংযুক্ত করতে হবে। সমাজবিজ্ঞান কিংবা ভূগোল পাঠের আওতায়।
৪। একুশে ফেব্রুয়ারিকে প্রতিবছর সরকারি ছুটির দিন হিসেবে নির্ধারিত করতে হবে।
পরিশেষে বলব, নিজের শিকড় উপড়ে ফেলে দিলে সেই গাছ বেশি দিন বাঁচে না, তাই লক্ষ রাখা উচিত আমাদের সন্তানেরা যেন,
‘বাংলা যেন কেমন-কেমন, খুব দুর্বল প্যানপ্যানে
কবে যেন হয় ‘বেঙ্গলি ডে’, ফেব্রুয়ারি মাসে না?’
এমন প্রশ্ন করে না বসে! আমরা যেন তাদের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে না ফেলি! তাহলে এর চেয়ে বড় হন্তারক আর কেউই হবে না। প্রার্থনা করছি, আমরা যেন নিজ নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠতে পারি, ধরে রাখতে পারি আপন গৌরব নিজ নিজ অবস্থানে থেকেই। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন আমি বাঙালি। সেটাই হোক আমার গর্বের পরিচয়।
লেখক: সঙ্গীতা ইয়াসমিন, টরন্টো, কানাডা