পরবাসে ঈদ আনন্দ

এই ঈদে ভারতে পড়াশোনারত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঈদ আড্ডায় লেখক।
ছবি: সংগৃহীত

কিছু কথা অব্যক্ত রয়ে যায়, কিছু অনুভূতি মনের মাঝে থেকে যায়,
কিছু স্মৃতি নীরবে কেঁদে যায়, শুধু এই একটি দিন সব ভুলিয়ে দেয়।

ঈদের এই আনন্দ শুধু তাঁরাই নিতে পারেন, যাঁরা পরিবার নিয়ে একত্রে আছেন। আর যাঁরা পরিবার ছাড়া অনেক অনেক দূরে আছেন, মানে দেশের বাইরে, তাঁদের কাছে ঈদ অন্য সব সাধারণ দিনের মতোই মনে হয়। পার্থক্য শুধু ঈদের নামাজ।

ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ—এই কথা সবাই মানলেও দেশের বাইরে থাকা প্রবাসীদের জীবনে এর বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া দায়। কেউ জীবনের তাগিদে আর কেউ পড়াশোনার জন্য বিদেশে পাড়ি জমান। এই যেমন আমি গত তিন বছর পরিবার ছাড়া ঈদ করছি, দেখতে দেখতে ছয়টা ঈদ ভারতে আছি। প্রথম দুইটা ঈদ সত্যি অনেক কষ্টের ছিল। এরপরের সব ঈদ আর ঈদের মতোই মনে হয়নি। এখানে বিদেশি মুসলিম বন্ধুদের সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়ে এসে বাসায় কথা বলি, এরপর লম্বা একটা ঘুম। এভাবেই কাটছে ঈদের দিন। এই ঈদেও ব্যতিক্রম কিছু হবে না। প্রবাসীদের কাছে ঈদ একটু অন্য রকম হয়। যাঁরা কাজের উদ্দেশ্যে আসেন, তাঁদের জন্য ঈদের দিনটা অত্যন্ত কষ্টের।

এত কিছুর পরও প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণে রেকর্ড গড়েছেন। যেন ঠিক সময়ে পরিবারে ঈদের টাকা পাঠাতে পারলেই প্রবাসীদের হৃদয় আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে। ঈদে পরিবারের মুখে হাসি দেখলে তাঁরা আনন্দে বিভোর হয়ে যান। ঈদের সারা দিন প্রবাসীর মনটা পড়ে থাকে পরিবারের কাছে।

ভারতে পড়াশোনারত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লেখকের প্রথম ঈদ (২০১৮)।
ছবি: সংগৃহীত

এত কিছুর পরও প্রবাসীদের জীবন চলে নিরন্তর। লক্ষ্যের পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন এ যোদ্ধারা। এ জীবনে যখন তাঁরা ব্যর্থতার তিক্ত স্বাদ পান, তখন চোখ বুজে সয়ে যান। ঝিনুক যেমন নীরবে সহে যায়।

মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ। এই ঈদ নিয়ে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন আশা–আকাঙ্ক্ষা থাকে আর প্রস্তুতির কমতি থাকে না। ফজরের নামাজের পর দল বেঁধে ছোটাছুটি, দলবদ্ধ হয়ে পুকুরে গোসল করা। এরপর মিষ্টিমুখ করে নতুন জামাকাপড় পরে ঈদগাহ মাঠে যাওয়া। ঈদের ছুটিতে সবাই শহর থেকে বাড়িতে। অনেক দিন পর সবার সঙ্গে দেখা, আড্ডা আর খুনসুটিতে সময় পার করা যেন ঈদের বিশেষ আনন্দ। সারা দিন বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানো বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে। ঈদ মেলায় ছোটাছুটি আনন্দে। ঈদের বর্ণিল সাজে মন হয়ে ওঠে উজালা।

আরও একটা মজার বিষয় হতো, সবাইকে ঈদের বার্তা পাঠানো একটা মেসেজ অনেকজনকে কপি করে পাঠানো। কোরবানির ঈদের একটা মেসেজের কথা মনে পড়লে এখনো হাসি পায়। লেখাটা ছিল এমন,
‘দিনে গরম রাতে শীত সামনে আসছে কুরবানি ঈদ। সাদা রুটি মাংসের ঝোল, খেতে তোমরা করোনা ভুল । ঈদে থাকব হাসি খুশি তোমাকে চাই পাশাপাশি।’

কোরবানি ঈদের সময় গরু নিয়ে কত যে মাতামাতি হতো। কার গরু কত শক্তিশালী কার গরুর বড় সিং। আরও কত কী—এসব বলে শেষ করা যাবে না।

ঈদের দিন বিকেলে বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে খাবারের আয়োজন।
ছবি: সংগৃহীত

ভারতে আসার পর ঈদের দিনের সবকিছুই এখন স্মৃতি। এখন আর নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে আম্মু তাড়াহুড়া করে সেমাই রান্না করে টেবিলে রাখে না। নতুন জামা পরে আম্মু, আপু, ভাইয়ার কাছ থেকে সালামি চাওয়া হয় না। কারণ, একটাই আমি—এখন বাংলাদেশ থেকে আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে। এখানে ঈদ মানে শূন্যতা, ঈদ মানে কোনো আনন্দই না। পরিবার–পরিজন ছাড়া ঈদ যে কতটা কষ্টের, সেটা একমাত্র প্রবাসীরই ভালো জানে। যারা পড়াশোনা করে, তাদের জন্য কিছুটা হলেও বিষয়টা স্বাভাবিক, আর যারা কাজ করতে বিদেশ আসে, অনেকে তো ঈদের দিনও ডিউটিরত থাকতে হয়। দিন শেষে একটাই শান্তি—পরিবারের সবাই হাসিখুশি আছে। সুখে থাকুক সব পরিবার। অনেক অনেক ভালোবাসা।

লেখক: মো. হাসিবুর রহমার নিলয়, বেঙ্গালুরু ইউনিভার্সিটি, ভারত।