পবিত্র ঈদে নজরুলকে স্মরণ

কাজী নজরুল ইসলাম

গত বছরগুলোর মতো এবারও দুয়ারে কড়া নাড়ছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। আর প্রতিবছর ঈদুল ফিতর আসতে না আসতে বাংলার শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে আবালবৃদ্ধবনিতা পর্যন্ত সবার অন্তরে বেজে ওঠে সেই বিখ্যাত গান:
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।’

ঘুরেফিরে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই সৃষ্টিশীল রচনাগুলো যেন বছরের এই সময়ে বারবার আমাদের মাঝে ফিরে আসে। আর এটিই হচ্ছে কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনন্যতা, বাংলা সাহিত্যে জগতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যদি হন মধ্যগগনের সূর্য, তবে কবি কাজী নজরুল ইসলাম হচ্ছেন সে গগনের উজ্জ্বলতম ধূমকেতু।

ইতিহাসে একসময় সমগ্র বিশ্বের মুসলমান তো বটেই, বাঙালি মুসলমানরা ক্রান্তিকালীন সময় কাটিয়েছেন। ঠিক সে সময়ই আবির্ভাব ঘটে কবি কাজী নজরুল ইসলামের। তাঁর রচিত সেই বিখ্যাত কবিতা থেকে যদি কয়েকটি লাইন আমরা স্মরণ করি—
‘বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা
শির উঁচু করি মুসলমান।
দাওয়াত এসেছে নয়া যমানার
ভাঙ্গা কেল্লায় ওড়ে নিশান।’

বাংলার মুসমানদের মধ্যে নজরুল ইসলাম নতুনভাবে এক রেনেসাঁর জন্ম দিয়েছেন। তিনি তাঁর নিপুণ সাহিত্যের আঁচড়ে বঙ্গীয় মুসলিমদের মধ্যে পুনর্জাগরণের ডাক দিয়েছেন। হারিয়ে যাওয়া ইসলামি আচার, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে নতুনভাবে তিনি তাঁর লেখনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্থপতি বলা হলেও পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছিলেন বঙ্গীয় মুসলমানরা। কেননা পাকিস্তানের পাঞ্জাব, সিন্ধু কিংবা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে শুরু করে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে যাঁরা মুসলমান ছিলেন, তাঁরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক অগ্রসর ছিলেন। শিক্ষা ক্ষেত্রেও তাঁরা যথেষ্ট অগ্রসর ছিলেন। অবিভক্ত পাঞ্জাবে মুসলিম, শিখ ও হিন্দু—তিন সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন এবং তাঁদের প্রত্যেকে ছিলেন একে অপরের সমকক্ষ। তাই ভারত ভেঙে নতুন রাষ্ট্র গঠনের পেছনে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে যে ধরনের অধ্যবসায় পরিলক্ষিত হয়েছিল, ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে তেমনটি ছিল না বললেই চলে।

দারিদ্র্যের তাড়নায় হয়তো বা খুব বেশি পড়াশোনার সুযোগ পাননি, তবে তিনি ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত ব্যক্তিত্ব। তা ছাড়া আর্থিক দুরবস্থার কারণে তাঁর সাহিত্যচর্চার পথ তেমন একটা মসৃণ ছিল না। আরবি, ফার্সি ও উর্দু থেকে শুরু করে ইংরেজিতেও তাঁর পারদর্শিতা ছিল লক্ষ করার মতো। যা তাঁর সাহিত্যচর্চায় বাড়তি মাত্রা দান করেছে। বিভিন্ন ভাষার শব্দমালার সংমিশ্রণে তিনি নতুন নতুন অনেক সুরের সৃষ্টি করেছেন।

বিশ্বে কোনো কবি এককভাবে তাঁর মতো এত সংগীত রচনা করতে পারেনি। ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ’ থেকে শুরু করে ‘শোন শোন ইয়া ইলাহী’ কিংবা ‘হেরা হতে হেলে দুলে নূরানী তনু’ ও ‘কে আসে হায়’–এর মতো বাংলা সাহিত্যের বেশির ভাগ বিখ্যাত হামদ, নাত ও গজল এককভাবে তাঁরই রচনা করা। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে স্মরণ করে তাঁর লেখা:

‘তৌহিদের মুর্শিদ আমার মুহাম্মদের নাম
মুর্শিদ মুহাম্মদের নাম
ঐ নাম জপলেই বুঝতে পারি খোদাই কালাম
মুর্শিদ মুহাম্মদের নাম।’
কিংবা
‘রাসুলের অপমানে যদি না কাঁদে তোর মন,
মুসলিম নয় মুনাফিক তুই, রাসুলের দুশমন।’
বাংলার মুসলামনদের মধ্যে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও ইসলামি মূল্যবোধ পুনরুদ্ধারে এভাবে তিনি কাজ করে গিয়েছেন। তবে ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। এ জন্য হামদ, নাত ও গজল রচনার পাশাপাশি শ্যামাসংগীত রচনায়ও তিনি ছিলেন যশস্বী। বিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে তাই যখন হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা রীতিমতো যখন এক বিপর্যয়ের রূপ নিল, সে সময়ে তিনি লিখেছেন—
‘মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।
মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।
এক সে আকাশ মায়ের কোলে
যেন রবি শশী দোলে,
এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান।
এক সে দেশের খাই গো হাওয়া, এক সে দেশের জল,
এক সে মায়ের বক্ষে ফলাই একই ফুল ও ফল।
এক সে দেশের মাটিতে পাই
কেউ গোরে কেউ শ্মাশানে ঠাঁই
এক ভাষাতে মা’কে ডাকি, এক সুরে গাই গান।’

এমনকি সে যুগেও তিনি তাঁর সন্তানদের নাম রেখেছিলেন কাজী সব্যসাচী, কৃষ্ণ মুহাম্মদ, কাজী অনিরুদ্ধ ও অরিন্দম খালেদ। অন্যদিকে প্রেমিক কবি হিসেবেও নজরুল ঠাঁই করে নিয়েছেন কোটি কোটি যুগলের হৃদয়ে। তাঁর রচিত একটি বিখ্যাত প্রেমের কবিতা—

‘তোমারে পড়িছে মনে
আজি নীপ-বালিকার ভীরু-শিহরণে,
যূথিকার অশ্রুসিক্ত ছলছল মুখে
কেতকী-বধূর অবগুণ্ঠিত ও বুকে-
তোমারে পড়িছে মনে।
হয়তো তেমনি আজি দূর বাতায়নে
ঝিলিমিলি-তলে
ম্লান লুলিত অঞ্চলে
চাহিয়া বসিয়া আছ একা,
বারে বারে মুছে যায় আঁখি-জল-লেখা।
বারে বারে নিভে যায় শিয়রের বাতি,
তুমি জাগ, জাগে সাথে বরষার রাতি।’

কাজী নজরুল ইসলাম (১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬—১২ ভাদ্র ১৩৮৩),
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

কবি কাজী নজরুল ইসলামের আরও একটি দিক বিশেষভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন, আর সেটি হচ্ছে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন। বাংলা সাহিত্যে তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবেও পরিচিত। বাংলাভাষী মানুষের কাছে তাই তিনি এক বিদ্রোহের প্রতীকরূপে সমাদৃত। তবে সে বিদ্রোহ নিতান্তভাবে অন্য সকল বিদ্রোহ থেকে আলাদা। এ বিদ্রোহের পেছনে নেই কোনো অভিলক্ষ্য। কেবল নিপীড়িত মানুষের উদ্দেশে ধ্বনিত হয়েছে এ বিদ্রোহ। সুকান্ত ভট্টাচার্য কিংবা রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহও বিদ্রোহের কবিতা রচনা করেছেন, তবে তাঁদের প্রত্যেকের বিদ্রোহ ছিল মার্ক্সবাদী চিন্তাধারার নিরিখে প্রতিফলিত, এদিক থেকে নজরুল ছিলেন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং তাঁর বিদ্রোহী চেতনাকে কোনোও ধরনের রাজনৈতিক আদর্শ দিয়ে কখনো ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
সমাজের সব বৈষম্যের মূলে তিনি কুঠারাঘাত করেছেন নিচের দুই চরণের মাধ্যমে—

‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান!’

নিখিল ভারতে স্বাধীনতাকামী মানুষের মধ্যে প্রথম স্বাধীনতার বীজ বোপিত হয়েছিল নজরুল ইসলামের লেখনীর মাধ্যমে এমনটি দাবি করলেও ভুল হবে না। সত্যি কথা বলতে গেলে, ১৯২০ সালের ১২ জুলাই ‘নবযুগ’ নামের একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করে। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন। ওই বছরই এই পত্রিকায় ‘মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন, যার জন্য পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয়। নজরুল ব্রিটিশ সরকারের জনরোষে পতিত হন এবং রাষ্ট্রদোহের অভিযোগে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। স্বাধীনতাকামী মানুষের উদ্দেশে তাঁর লেখা—
‘কারার ঐ লৌহকপাট,
ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট
শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।
ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।’

বলতে গেলে কাজী নজরুল ইসলাম যখন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কলম ধরে দখলদার শ্বেতাঙ্গ ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিয়ে ‘সেই দিন হব শান্ত’ লিখেন, সেটিই ভারতের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার ডাক। তাই নজরুলকে ছাড়া এ ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকে কল্পনা করা কখনো সম্ভব নয়।

বাস্তবিক অর্থে বলতে গেলে বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রি থাকলেও জ্ঞানের কোনো ডিগ্রি নেই। জ্ঞান যেমনিভাবে ডিগ্রিবিহীন, ঠিক তেমনি সীমাহীন। কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের সবার মধ্যে এই নির্মম বাস্তবতাকে চোখে আঙুল দিয়ে তুলে ধরেছেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাই তিনি খুব বেশি দূর অগ্রসর হতে না পারলেও বাংলা সাহিত্যকে একাই তিনি নিজ হাতে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছেন। শব্দ চয়ন থেকে শুরু করে বর্ণনার ভঙ্গি পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য পাণ্ডিত্য দেখিয়েছেন। তাঁর তুলনা তিনি নিজে, বিশ্ব সাহিত্য অঙ্গনেও তাঁর সমতুল্য কবি খুব কম রয়েছেন। মাত্র ৪২ বছর বয়সে তিনি মস্তিষ্কের এক দুরারোগ্য ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হন, তাঁর সাহিত্যচর্চায় ছেদ পড়ে এবং তিনি ধীরে ধীরে তাঁর বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। সত্যি কথা বলতে গেলে, তাঁর সাহিত্যচর্চার সময় ছিল ২০ থেকে ২৪ বছরের মতো, যেটা নিতান্ত কম বলতে হবে। সংক্ষিপ্ত এই সময়টুকুতেও তাঁকে দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। এরপরও তিনি তাঁর লেখনীর দ্বারা গোটা বাঙালির হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছেন। দুর্ভাগ্যবশত কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আমরা এখনো যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারিনি। দুখু মিঞা আমাদের মধ্যে এখনো অনেকটা অনাদরে রয়ে গিয়েছেন, কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে আরও অধিক গবেষণার প্রয়োজন। পাশাপাশি তাঁর সৃজনশীল রচনাগুলোকে ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশসহ বিদেশি বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা প্রয়োজন।

সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজী, কাজী নজরুল ইসলাম ও ফররুখ আহমেদ—এই ত্রয়ীর জন্ম না হলে বাংলার মুসলমানরা আজও অন্ধকারাচ্ছন্ন থেকে যেত। একই সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম না থাকলে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের জাঁতাকল থেকে সত্যিকার অর্থে আমরা কতটুকু মুক্ত হতে পারতাম, সে প্রশ্নও তোলার সুযোগ রয়েছে। তাই নজরুলচর্চা থেকে সরে আসা মানে মনন জগৎকে আবারও সেই ঔপনিবেশিক দাসত্বের দিকে ঠেলে দেওয়া। একই সঙ্গে বাঙালি ও মুসলমান হিসেবে আমাদের যে গৌরবজ্জ্বল সোনালি অতীত রয়েছে, সেটিও বিলীন হয়ে যাবে আমাদের মনোজগৎ থেকে, যদি না আমরা তাঁর সৃষ্টিকর্মকে যথার্থভাবে তুলে ধরতে না পারি। তাই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে আমাদের গুরুত্বসহকারে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিশীল কর্মের প্রতি যত্নবান হতে হবে এবং সেগুলোকে সংরক্ষণের পাশাপাশি বিশ্বদরবারেও যাতে আমরা তাঁর রচনাকে ছড়িয়ে দিতে পারি, সে ব্যাপারেও আমাদের তৎপর হতে হবে।

*লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া