পদ্মা সেতুর কারণে বিশ্বে আত্মমর্যাদা বেড়েছে বাংলাদেশের
পাহাড়–পর্বত ভেঙে অবিরামভাবে পদ্মা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে। তাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে কখনো আমরা চেষ্টা করিনি, বরং তার অত্যাচার–অবিচার সহ্য করে নিজেদের সামলে নিয়ে বসবাস করে চলছি। সে নদীর একূল ভেঙেছে, ওকূল গড়েছে ঠিকই, তবে আমাদের স্থায়িত্বকে বারবার হরণ করেছে। তবে সে আমাদের দিয়েছে প্রচুর, সে কথা আমরা ভুলিনি, ভুলব না। পদ্মা অবশ্যই শক্তিশালী নদী। এত যুগ পর তার পিঠে সেতু তৈরি করা হয়েছে। পদ্মার ওপর দিয়ে চলাফেরা অনেকটা বাঘের পিঠে বসে শিকার করার মতো সাহস বাংলাদেশের বাঙালি জাতি পাবে, এটাই মূলত কারণ আমার লেখা কবিতা ‘ওগো সুন্দরী আমি তোমার কথা বলছি’ প্রথম আলো পত্রিকার নাগরিক সংবাদ দূর পরবাসে ৭ জুন প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে আমি অনেক কথা তুলে ধরেছি।
শুধু পদ্মা নদী নয়, আমি পদ্মা সেতুকে নিয়ে আমার মনের ভাব প্রকাশ করেছি। একই সঙ্গে ইঙ্গিত দিয়েছি, এটা যখন সম্ভব, তখন বাকি সব সমস্যার সমাধান হবে ইনশা আল্লাহ। আমরা মানুষ জাতি স্রষ্টার সৃষ্টির সেরা জীব ভুলে গেলে চলবে কি? গদ্যাকারে না লিখে কবিতার ভাষায় লিখেছি, তাতে যদি কেউ মনে করে আমি একজন কবিতে পরিণত হয়েছি! সমস্যা কোথায়? তবে আমি সেই আগের মতোই দূরপরবাসী বাংলাদেশের রহমান মৃধাই আছি।
অনেকের ধারণা, বিশ্বের কিছু উন্নত, স্বাধীন, গণতান্ত্রিক দেশ যেমন জার্মান, জাপান প্রাক্-আধুনিক যুগের সবচেয়ে হিংস্র জাতিগুলোর মধ্যে দুটি। তারা মনে করে এই দেশগুলোতে গণতন্ত্র রয়েছে কারণ, যুক্তরাষ্ট্র চায় তারা গণতান্ত্রিক হোক এবং মার্কিন সেনা ঘাঁটি শৃঙ্খলের মাধ্যমে এই দেশগুলোতে গণতন্ত্র অটুট রেখেছে।
আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে ‘আপনি বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য আকুল। আপনি কি জানেন কেন বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই? সেই সঙ্গে তাদের বর্ণনায় ফুটে উঠেছে যেমন বাংলাদেশে ইউএস বেস নেই, তেমনি গণতন্ত্রও নেই! গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে এবং সেই সঙ্গে এটিকে রক্ষা করতে, আমাদের শিগগিরই বঙ্গোপসাগরে একটি মার্কিন সেনা ঘাঁটি দরকার। এটা ছাড়া আমাদের দেশে গণতন্ত্র টেকসই হবে না। কারণ, ভারত হস্তক্ষেপ করবে, পাকিস্তান, চীন করবে ইত্যাদি।’
ইদানীং সবাই লক্ষ করছেন সুইডেন, ফিনল্যান্ডের মতো দেশও শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বন্দী হতে চলেছে পাশের দেশ রাশিয়ার হুমকি-ধমকি থেকে রেহাই পেতে। জানি না প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই কি গণতন্ত্রের বেস্ট প্র্যাকটিস করছে! প্রতিবছর কী পরিমাণ স্কুলশিক্ষার্থী হত্যা হচ্ছে সেখানে? বিশ্বের কোথায় তারা নাক গলাতে বাদ রেখেছে? তবে হ্যাঁ, অন্যান্য দেশের তুলনায় হয়তো কিছুটা ভালো, তবে সেটা যথেষ্ট নয়।
আমি বাংলাদেশি এবং সুইডিশ সে ক্ষেত্রে যেটা দুই দেশের মানুষের জন্য ভালো, সেটা নিশ্চয়ই গোটা বিশ্বের জন্যও ভালো হবে বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। সুইডেন সব সময় বিশ্বকে নিয়ে ভাবে, বিশ্বের মানুষের পাশে দাঁড়ায় বিপদ–আপদে। বাংলাদেশের যে সমস্যা আমাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে, সেটা হচ্ছে দেশের সম্পদ লুটপাট করে যারা বিদেশে পাঠাচ্ছে এবং যারা এটাতে সক্রিয় অংশগ্রহণসহ সব রকম সাহায্য করছে।
এটা বন্ধ করতেই হবে। দেশকে ভালো না লাগলে, দেশ ছাড়ো, সমস্যা নেই। কিন্তু দেশের বারোটা বাজিয়ে লুটপাট করে নিয়ে যারা চলে যাচ্ছে, সেটা হতে দেওয়া যাবে না। সব সহ্য করা যেতে পারে, তবে বেইমান বা নেমকহারামদের সহ্য করা ঠিক হবে না। আমাকে এমনও প্রশ্ন করা হয়েছে, ‘আপনি জানেন কেন বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের পুতুল?’ পুতুল কে না পছন্দ করে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই বলেছেন, ‘সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।’
বাংলাদেশ সত্যিই একটি পছন্দের জায়গা। তার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেকেরই লোভ রয়েছে, লোভ নেই শুধু রাজাকারের বাচ্চাদের, যারা দেশটাকে লুটপাট করে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছে, আমি তাদের ঘৃণা করি। এদের এখন শায়েস্তা করতে হবে। তার জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, কারণ আমরা সোনার বাংলাদেশ গড়তে চাই, আমরা গর্বিত বাংলাদেশি নাগরিক হয়ে পৃথিবীর দায়িত্ব পালন করতে চাই।
আমাকে আরও প্রশ্ন করা হয়েছে, আমি গণতন্ত্রের বাণী সারাক্ষণ লিখে চলেছি, কই পেরেছি কি পরিবর্তন আনতে?
একটি গল্প মনে পড়ে গেল এ প্রশ্নের কারণে।
কয়েক বছর আগের হবে, বাংলাদেশের র্যাব প্রশাসন জঙ্গলে ঢুকেছে হাতি ধরতে, এ খবরে ভয়ে মহিষ দৌড়ে পালাচ্ছে। সিংহ মহিষকে বলল, র্যাব তো হাতি ধরতে জঙ্গলে নেমেছে, তুমি কেন দৌড়াচ্ছ? উত্তরে মহিষ বলেছিল, আমি যে হাতি না, সেটা প্রমাণিত হতে কমপক্ষে ২০ বছর লাগবে, মানে তত দিন আমারে আটকে রাখবে প্রশাসন।
ঘটনাটি হাস্যকর ঠিকই, তবুও ভাবনার বিষয়। দুঃখের বিষয় হলো বাংলাদেশের ক্ষমতাবান প্রশাসনকে সহজে জাগানো যাবে না, সময় লাগবে। কারণ, তারা যেটা করার সেটাই করবে। তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে বলে মনে হয় না। তারপর লক্ষ করুন সব সমস্যার জন্য বৈদেশিক সাহায্য নেওয়া হয় শুধু প্রশাসন ছাড়া। চোখে ময়লা না ঢুকলে কী কেউ কখনো বলে চোখে সমস্যা?
যে প্রশাসন অন্যের চোখে ময়লা ঢুকলে অনুভব করতে শেখেনি সেই ব্যথার কী জ্বালা! সে প্রশাসন দেশের মানুষের দুঃখ–কষ্ট বুঝবে বলে মনে হয় না!
যাহোক, পরিবর্তনে দরকার সময়ের, দেশ স্বাধীনের ৫০ বছর পর যেমন পদ্মা নদীর ওপর সেতু তৈরি হয়েছে নিজেদের অর্থে, ভাবুন, যদি এত টাকা সত্যি সত্যিই বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেতু করা হতো, কী পরিমাণ সুদ-মূলসহ পরবর্তী প্রজন্মকে সেটা আজীবন কলুর বলদের মতো টানতে হতো! বাংলাদেশের মানুষ অতীতে প্রমাণ করেছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করে আর এবার প্রমাণ করল বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে পদ্মা সেতু করে।
আমার বিশ্বাস বাংলার মানুষ আস্তে আস্তে নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হবে। সচেতন জাতি তখন অজুহাত নয় খুঁজবে সততা, খুঁজবে সমাধান, আমি সেদিনের আশায়।