পদ্ধতির ফায়দা

স্রোতে গা ভাসানো মানুষ আমি । ক্রিসমাসের আলোকসজ্জা দেখতে ছেলেকে নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছিলাম। জমাট শীতের সন্ধ্যা। হাই স্ট্রিটে মানুষের হাতে হাতে শপিং ব্যাগ। উৎসবের মেজাজ চারদিকে। লাইভ অর্কেস্ট্রা বাজছে। সারি সারি দোকানের মাঝখানের রাস্তায় ছেলের হাত ধরে হাঁটছি। মাত্র চারটা বাজে। কিন্তু লাগে গভীর রাত।
সিস্টার ডাক শুনে তাকিয়ে দেখি ইয়াসিন। ৩০ বছরের যুবক। আমার প্রতিবেশী। আরব। মিসরের কায়রো শহরের।
আমি যত না অবাক তার চেয়ে অবাক আমার ছেলে তাকে দেখে। কারণ, আমরা তাকে হুইল চেয়ারে দেখে অভ্যস্ত। সে দিব্বি দাঁড়িয়ে ।
আমি অবাক হয়ে বলি, তুমি এখানে? ক্রিসমাসের শপিং করো?
না সিস্টার, উইন্ডো শপিং করছি।
ইয়াসিন তুমি হাঁটতে পারো? আমার ছেলে বলে ওঠে।
চুপ কাউকে বলো না। আমি পারি।
তাহলে তুমি বাসায় হুইলচেয়ারে বসো কেন?
উত্তরটা আমি জানি। কাজ করতে হয় না। সরকার থেকে স্পেশাল নিড হিসেবে বাড়ি ভাড়া, ভাতা সবই পাওয়া যায়। নিজের ওপর রাগ হয়, ইয়াসিনের কথায় কেন আমি থামলাম? বাসার সামনে তাকে যখন আবার হুইলচেয়ারে দেখবে আমার ছেলে, তখন প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাবে। আমাকে কতকগুল উত্তর খুঁজতে হবে। না হলে সে কী করে না করে, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নাই।
আমি তাড়াতাড়ি সরে পরতে চাই। ইয়াসিনের সঙ্গে সব সময় দরজায় দাঁড়িয়ে কথা হয়। অনেক অনুরোধ করে তার বাসায় যাওয়ার জন্য বা চায় আমি তাকে ডাকি। আমি বিনয়ের সঙ্গে না করি। শুধু মুসলমান হওয়ার জন্যই যে কোজি হতে হবে, তা নয়। কিন্তু একটা সহানুভূতি কাজ করত তাকে হুইলচেয়ারে দেখে। একদিন দরজায় বেল দিয়ে বলে, সিস্টার আমার একটু শপিং করে দেবে? আমার ইন্টারনেট কাজ করছে না। অনলাইন শপিং করি আমি।
মাঝেমধ্যে ছোটখাটো বাজার করে দিতাম। ওকে বলাও ছিল, কিছু লাগলে আমার দরজার কাছে বেল দিয়ে শপিং লিস্ট আর টাকা ড্রপ করে দিতে। আমি পরে তার বাজার করে তার দরজায় নক করে জিনিসপত্র দিতাম।
সেই রাতে ছেলেকে নিয়ে যখন বাসায় ফিরলাম, দেখি হুইলচেয়ারে বসা ইয়াসিন আমার ড্রাইভওয়েতে। আমার ছেলের আবার বিস্ময়।
ও কিছু বলার আগে আমি বলে উঠি, ইয়াসিন তুমি একটু ওয়েট কর, আমি ওমরকে বাসার ভিতরে দিয়ে আসছি।
তুমি এই ঠান্ডায় এখানে? আমি ফিরে এসে প্রশ্ন করি ইয়াসিনকে।
সিস্টার তুমি বলবে না তো কাউকে? আমি যে সুস্থ, হাঁটতে পারি।
বলব না, যেখানে তোমার ক্ষতি হবে। কিন্তু তোমাকে যদি পরিচিত কেউ বা কাউন্সিলের লোক দেখে, তোমার জন্য বিপদ। কাছাকাছি শপিং মলে হেঁটে বেড়াও কেন?
ভুল হয়েছে। মাথা নিচু ইয়াসিনের।
আর কিছু বলবে? আমি তাড়া দিই। প্রচণ্ড ঠান্ডা।
দেখো ওদের পয়সা নিব না কেন? আমাদের মুসলিম দুনিয়াকে কী করে দিছে? আমি গিল্টি ফিল করি না, ওদের ট্যাক্স দিব কেন? আমাদের যেভাবে শেষ করছে সেটা তো এই তুলনায় কিছু না ।
যখন তারা শেষ করে তোমাদের, তোমরা তাদের কাছে বিক্রি হয়ে সে সুযোগ দাও কেন? বলতে যেয়েও থেমে যাই।
মুখে হাই তুলে বলি, সরি ইয়াসিন, ওমর বাসায় একা, আমি যাই। মনে মনে বলি, ‘এটা কিছু হইল? যত সব আজাইরা এক্সকিউজ।’
তাহমিনা আমীর
লন্ডন, যুক্তরাজ্য