যত দূর মনে পড়ে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার জন্য আমার শুধু মুখস্থ নয় ঠোঁটস্থ করা রচনার নাম হচ্ছে ‘জীবনের লক্ষ্য কী’। পরীক্ষার উত্তরপত্রে সবাই যখন লিখেছিল কেউ হতে চায় ডাক্তার, কেউবা ইঞ্জিনিয়ার, আবার কেউ নামকরা ব্যারিস্টার। স্পষ্ট মনে আছে ছোট্ট হাতে সেদিন পরীক্ষার খাতায় লিখেছিলাম, আমি বড় হয়ে বেদিনী হতে চাই। যুক্তির ঘরে নিবিড় মমতায় বর্ণনা দিয়েছিলাম, বেদিনী হয়ে স্বাধীনভাবে পালতোলা নৌকায় চড়ে পানির ওপরে মনের সুখে নীল আকাশের নিচে ভাসব। দেশের এক প্রান্ত হতে আরেক প্রান্ত চষে বেড়াব। নিভৃতে কোনো সবুজ অরণ্য ঘেঁষে জলের ওপরে সংসার পাতব। আষাঢ়, শ্রাবণে আকাশ যখন একা একা কেঁদে যাবে খুব নীরবে সমব্যথী হয়ে আকাশের সব কষ্টের কথা শুনব বসে গভীর জলে। নীলাকাশ আর আমি মুখোমুখি দুজন তাকিয়ে রবো অনন্তকাল ধরে সুখে-দুঃখে, আলো-আঁধারে। বিশাল আকাশ আর আমি, আমাদের মাঝখানে থাকবে না কোনো শৃঙ্খলের ব্যাকরণ অথবা সময়ের হিসেব। আমাদের টলমলে জলের মাঝে বইবে শুধু ভালোবাসার প্রতিধ্বনি বারোমাস। চোখ ঝলসানো পূর্ণিমা রাতে গলা ছেড়ে গান গাইব মনের সুখে। চাঁদ, জোসনাদের সঙ্গী করে বেড়াতে যাব কোনো নির্জন দ্বীপে। সকালের নরম রোদ আলতো করে ছুঁয়ে যাবে আমাকে। ফুলেরা সুবাস বিলাবে। প্রজাপতির দল রঙিন পাখনা মেলে উড়ে যাবে। পাখিরা গান ধরবে। তাই ইচ্ছে আমার বেদিনী হওয়ার।
আমার বাবা তখন বিদেশে থাকতেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন আমাদের গৃহশিক্ষক। পরীক্ষার খাতায় লেখা আমার বেদিনী হওয়ার ইচ্ছে এবং যুক্তি প্রধান শিক্ষক পুরোটাই পড়ে শুনালেন আম্মাকে। স্যার ও আম্মার রক্তচক্ষুর শাসানি এবং সেদিনের শাস্তির কথা আজও ভুলিনি।
আমাকে সেদিন শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল কেউ যদি জিজ্ঞেস করে বড় হয়ে কী হতে চাও? বা তোমার জীবনের লক্ষ্য কী? উত্তরে বলবে, বড় হয়ে আমি ডাক্তার হতে চাই। বড়দের চাপিয়ে দেওয়া ও শেখানো বুলিই রোবটের মতো সবাইকে বলেছি ও পরীক্ষার খাতায় লিখেছি স্বাদহীন পুরো ছাত্র জীবনজুড়ে। অথচ, আমার বুকে অথই সমুদ্রের শান্ত জলে শুধুই ভেসে বেড়াত আমার আজন্ম প্রিয় পাল তোলা নৌকা খানি। কিন্তু উপায় নেই। আমাকে ডাক্তার হতেই হবে। পানিতে যাওয়া যাবে না। রাতদিন বদ্ধ ঘরে পড়াশোনা করতে হবে। স্যার ও আম্মার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলাম।
>জিজ্ঞেস করলাম, বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও? উত্তর দিল, ‘আমি আমার মতো হতে চাই!’ তার ইচ্ছেকে স্বাগত জানিয়ে আরও কয়েকজনকে একই প্রশ্ন করলাম। সবার উত্তরগুলো প্রায় একইরকম।
আমার এক বান্ধবী খুব ভালো ছবি আঁকত। পথের পাশে অযত্নে ফুটে থাকা বুনোফুলকেও সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে প্রথমে মগজে ধারণ করত তারপর রং তুলির আঁচড়ে অনিন্দ্য সুন্দর রূপে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলত। আমরা বন্ধুরা সবাই মুগ্ধ হয়ে তাঁর ছবি আঁকা দেখতাম এবং অনুপ্রেরণা দিতাম। আমাদের অনুপ্রেরণা পেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে সে ছবি আঁকত। একদিন হঠাৎ ওকে ক্লাসের শেষ বেঞ্চে মনমরা, অমনোযোগী দেখে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে? উত্তর দিল, মা এবং বড় ভাইয়া আমার সব রং-পেনসিল নিয়ে গেছে এবং বলেছে সামনে ফাইনাল পরীক্ষা, যেন মন দিয়ে পড়ি। ছবি আঁকার মতো ফালতু কাজে যেন মূল্যবান সময় ব্যয় না করি। মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার জন্য কোচিংয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিই। উল্লেখ্য, আমাদের ছাত্রজীবনের সেই সময়টাতে বেশির ভাগ বাবা-মা চাইতেন তাঁদের কন্যা সন্তানটি বড় হয়ে পেশা হিসেবে যেন ডাক্তারি পেশাই বেছে নেয়৷ আমার বন্ধুমহলে তা-ই দেখেছি।
আমার আরেক বন্ধু খুব ভালো গান করত। ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়তে না বসে হারমোনিয়াম নিয়ে বসতো বলে তার মা হারমোনিয়াম তালাবদ্ধ করে রাখেন। পরে তাকে দেখতাম আম পাতা দিয়ে বাঁশি বানিয়ে সে বাঁশি বাজাতো। অপূর্ব ছিল তার সে পাতার বাঁশির সুর। পরে তার আর গানের চর্চা ছিল কিনা জানি না।
নিউইয়র্ক শহরের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন ছুটি চললেও গ্রীষ্মকালীন কার্যক্রমগুলো সচল রয়েছে। স্কুল থেকে মেধাতালিকায় বিশেষায়িত হাইস্কুলের পরীক্ষার্থী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ায় আমার বড় ছেলেকে নিয়মিতভাবে ক্লাসে যেতে হচ্ছে। অভিভাবক-শিক্ষক পরিচিতি অনুষ্ঠানে ছেলের সঙ্গে লম্বা সময় স্কুলে কাটাতে গিয়ে পাশে বসে থাকা ফুটফুটে চাইনিজ একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও? উত্তর দিল, ‘আমি আমার মতো হতে চাই!’ তার ইচ্ছেকে স্বাগত জানিয়ে আরও কয়েকজনকে একই প্রশ্ন করলাম। সবার উত্তরগুলো প্রায় একইরকম। তারা সবাই আমাকে জানাল কোনো মুখস্থ পথ ধরে নয়, নিজেদের যা ভালো লাগে, যা করে তারা আনন্দ পাবে তাকেই জীবনের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিবে।
আমি জানি ও বুঝেছি আজকের এই শ্রেণিকক্ষে অবস্থিত ছেলে-মেয়েগুলোই একদিন শক্তিশালী প্রজন্ম হিসেবে বিশ্বের দরবারে নিজেদের তুলে ধরতে সক্ষম হবে সগৌরবে। কারণ তাদের পিতামাতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জোর জবরদস্তি করে ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাদের ওপর কোনো বিষয় চাপিয়ে দিচ্ছে না। সবার মেধা আলাদা। যে বিষয়ে যে পারদর্শী তাকে সে বিষয়ে পড়াশোনা করে জ্ঞানার্জন করে প্রস্ফুটিত হতে দেওয়া উচিত। এতে করে সে নিজে যেমন জীবনে সফল হবে তেমনি দেশ ও দশের মুখও উজ্জ্বল করবে।
আমাদের দেশের বাবা, মা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ভিড়ের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের ঠেলে না দিয়ে মেধানুসারে তাদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে সাহায্য করে তাহলে আরও বেশি সাফল্যের সঙ্গে জীবনে উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে ও সামনে এগিয়ে যেতে পারবে।