পথ চলিতে, যদি চকিতে, কভু দেখা হয়, পরাণ প্রিয়...

১৯৮৯ সালে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম আমি শুভ। বাবার সঙ্গে রেজিট্রেশন ভবনে দাঁড়িয়ে আছি, কলেজের প্রথম দিন। সবাই নতুন, চোখে স্কুলের গন্ডি ছাড়িয়ে কলেজে পড়তে আসা একরাশ স্বপ্ন। এর মাঝে ময়ুর নীল জামা পরা একটা মেয়েকে দেখলাম। কি মায়াবী তার চোখ, মনে হচ্ছে যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে, ঐ দু'চোখে কি মায়া। 

বদলে গেল আমার কলেজ জীবনের সমীকরণ। স্বপ্নময়ীকে কলেজে ঢুকতে দেখব, তার পিছে পিছে তার ক্লাসে যাব, বিশাল কাঁঠালিচাঁপা গাছের নিচ থেকে শিশির ভেজা ফুল তুলে সদ্য লেখা কবিতাসহ লেকচার গ্যালারিতে ওর ব্যাগে দিয়ে দিব, এই হয়ে গেল আমার নিত্য রুটিন। সে কমন রুমে গিয়ে লান্চ টাইমে ক্যারম খেলবে, পিচ্চি দিয়ে আনিয়ে সিংগারা খাবে বান্ধবীদের সঙ্গে। আমি তাকিয়ে থাকব জানালা দিয়ে। ও রিকশা চড়ে বাসায় যাবে, মোটর সাইকেল চালিয়ে সঙ্গে সঙ্গে যাব আমি।

ওর নাম রত্না। কতদিন চেঁচিয়ে বলেছি 'রত্না আমি তোমাকে ভালবাসি'। মুখ নিচু করে সে চলে যায়। আমার রাতের ঘুম প্রায় হারাম হয়ে গেল। কয়েকটা ক্লাসে পিছন থেকে ওর নাম ধরে ডাকলাম। কোন সাড়া নেই।

তারপর একদিন সেই ডাকল আমাকে। বলল, 'তুমি এত বিরক্ত কর কেন?' এতটুকুই? বললাম তাহলে কথা দাও আমার প্রেমিকা হবে । বলল, 'না, ওসব ভাবার সময় এখনও আসেনি।' এর মাঝে কলেজের সাংস্কৃতিক অংগনে তার সরব পদচারণা শুরু হলো। আমার মনে বাজে, 'এ কোন মধুর শরাব দিলে আল আরব সাকি, নেশায় পাগল রংগীন হোল..' দুটো বছর ঝড়ের বেগে কেটে যেতে লাগল। কতবার চলতি পথ থামাতে চেয়েছি। এইচএসসি পরীক্ষার সময় ওর গাড়ীর সামনে সামনে হাঁটতাম। প্রতি পরীক্ষার পর মনে হতো রত্নাকে নিয়ে চলে যাই আমার বাড়ীতে। ভৈরব নদীর পাড়ে দোতলা বাড়ী। চাঁদের দিকে তাকিয়ে ওর চুলের গন্ধ নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দেই। পরীক্ষার পর ছুটিতে ওর বাসার সামনে নুপুর নিয়ে হাঁটতাম। যদি তার দেখা পাই।

একদিন শুনলাম রত্না কোথাও এডমিশন নিয়ে চলে গিয়েছে। বুকের মাঝে চিনচিন ব্যথা, 'পথ চলিতে যদি চকিতে কভু দেখা হয় পরাণ প্রিয়।'
রত্নার শোকে আমার পাগল হওয়ার যোগাড় হয়েছিল। সেসময় মা আর আমি বাসা থেকে বের হয়ে নদীর পাড়ে চলে যেতাম। মা অনেক বোঝালেন। বলতেন 'বাবা তুই আর রত্না দু'জনেইতো অনেক ছোট। নিজের পায়ে দাঁড়া আগে। তারপর তোর কাছে এনে দেব তাকে।' চলে গেলাম ঢাকা ইউনিভার্সিটি। পড়ি, কেউ যদি বলে রত্না আছে সেখায়, বহু অনুরোধ করি আমার কয়েকটা চিঠি তাকে পৌঁছে দিতে। কয়েক বছর কেটে গেল। চিঠিগুলোর কোন উত্তর পেলাম না।


পড়ার পাঠ চুকিয়ে নামী পত্রিকায় ঢুকলাম। কবি হিসেবে আমার নাম ডাকও হলো। হঠাৎ করে এই ঢাকাতেই রত্নার বাবা-মার খোঁজ পেলাম। মা-কে সঙ্গে সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। কিন্তু ওর বাবা-মা দেখিয়ে দিলেন ওর স্বামী আর বাচ্চার ছবি। রত্না এখন গ্রীসে থাকে। ভীষন কস্ট আমার, 'হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে কুড়াই ঝরা ফুল একবেলা আমি'।
ছেড়ে দিলাম ঢাকা। চলে এলাম ভৈরবের পাড়ে আমার স্বপ্ন নীড়ে। ডিংগি নৌকায় নদীতে ঘুরি। কবিতা হয়ে গেল আমার রত্না। মা অনেক বললেন বিয়ে করতে। বললাম রত্না ছাড়া আমার বউ আর কেউ না মা। তারপর সন্ধ্যার আগে আগে নৌকা নিয়ে পাড়ে আসতে আসতে দেখলাম একদিন নীল শাড়ি পরা অর্ধেক ঘোমটা দেওয়া অপ্সরী বসে আছে। মনে বেজে উঠল সুর 'ঐ জলকে চলেল কার ঝিয়ারী, রূপ চাপেনা তার নীল শাড়ি'। মা বাসায় যেতেই ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ওর নাম মায়া, ওর সাথে বিয়ে হোক আমার, মা খুব চাইছেন। আরে ছোট্ট এ মেয়ের চোখ, ভাষা, হাসি সবই তো আমার লেখা কবিতা। বিয়েটা হয়ে গেল তাড়াতাড়ি। জোছনা রাতে নৌকা নিয়ে মাঝ নদীতে বসে থাকি আমরা আজকাল। কি অসহ্য সুন্দর জীবন। এ জীবনে রত্না নামক কোন ছায়া নেই। 'প্রিয় হে বিদায়'।