পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অন্য নাম স্বদেশ
যদি প্রশ্ন করা হয় স্বদেশ কি? এর উত্তর আমাদের প্রত্যকের জানা। তবে এই জানা নিজেকে জানার মতো। নিজের সঙ্গে দেশকে মিলিয়ে নেওয়ার ঐকান্তিক এক বাসনার নাম স্বদেশ, স্বভূমি ও স্বজাতি তো বটেই। একজন কবির দৃষ্টিতে স্বদেশ হলো, হৃদয়ে তোলপাড় করা এক অখণ্ড এবং অবিসংবাদিত আবেগ ও মননের সমন্বয়। সে আমার মধ্যরাতের মুগ্ধবোধের স্বপ্ন। স্বদেশ আমার আত্মার নুন, বঙ্গোপসাগরের জল। শস্য শ্যামল অবারিত সবুজ প্রকৃতি ও মায়া রোদের চিত্রকল্প আমার বাংলাদেশ। আমার অস্থি-মজ্জা ধমনির রক্তের প্রতিটি কণিকাতেই আমার শ্যামল দেশ ও দেশের যত গৌরবগাথা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পৌনঃপুনিক ধারাবাহিকতা।
যেখানে, যত দূরেই যাই না কেন স্বদেশ যায় আমার সঙ্গে। স্বদেশ আমার ব্যক্তি পরিচয়ের প্রধান নিয়ামক। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন, আমি আমার স্বদেশকে বুকের মধ্যে গেঁথে নিয়ে ঘুরে বেড়াই তুমুল পর্যটনে। যতক্ষণ দেশে থাকি, স্বদেশ আমার মা-জননী, যদি থাকি প্রবাসে তখন সে সন্তানের অধিক সন্তান। সন্তানকে পরিত্যাগ করে কোনো বাবা-মা–ই যেমন কোনো রাজ্যপাটের সুখ-সমৃদ্ধি আশা করে না, তেমনি প্রবাসে, বিদেশ-বিভুঁইয়ে দেশ হয়ে ওঠে সন্তানের মতো। তাকে ছেড়ে এক মুহূর্ত সময় যাপনের কথা ভাবা যায় না। যদি ধরে নিই করোনাকালের কথা। বৈশ্বিক এই অতিমারির ত্রিশঙ্কু অবস্থায় যখন জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দুলছি।
প্রবাসে থেকেও তখনো মন পড়ে আছে দেশে, দেশের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু এবং আপামর জনগণের কথা ভেবে আকুল হই। তাদের ভালো থাকা, মন্দ থাকা আমাকে স্পর্শ করছে। তারা ভালো না থাকলে প্রবাসে আমিও ভালো থাকি না। যেমন টরন্টোতে এখনো আমি জানি না, কখন টিকা পাব। গভীর একটা অনিশ্চয়তার মধ্য আছি। কেননা, আমি টিকা পাচ্ছি না বলে দেশে যেতে পারছি না। কিন্তু যখন জানতে পারছি, আমার দেশের ৪০ বছরের তরুণ–তরুণীরা টিকা পেয়ে গেছে এবং সরকারের সুন্দর ব্যবস্থাপনায় সবাই তা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করছে। তখন সত্যি আনন্দে বুক ভরে উঠছে নিজের দেশের সাফল্য গানে। টেলিফোনে আমাকে কয়েকজন ইতিমধ্যে জানিয়েছে, প্রবাসে টিকা না পেয়ে অনেকেই দেশে চলে গেছে টিকা নিতে। আমার আত্মীয় ও সুহৃদেরাও বলছে, আপনিও চলে আসুন, দেশে এসে টিকা নিন। সুরক্ষার লিংকও পাঠিয়ে দিয়েছে। আমার কাছে দেশ হলো আনন্দ-বেদনা, দুঃখ কষ্ট সবাই মিলে উদ্যাপনের ক্ষেত্র।
যেদিন পদ্মাসেতুর উদ্বোধনের গল্প শুনি, সেদিন প্রবাসে আমার দেহ থাকলেও আমার মন, মনন এবং দিব্যদৃষ্টিতে আমি উপস্থিত থাকি দেশে। একইভাবে দেশের কোনো অমঙ্গলের বার্তা পেলে মরমে মরে থাকি। কখন মেঘ কেটে সূর্যের উদয় দেখব, সেই প্রত্যাশায় দিন গুনি। এই স্বদেশ স্বভূমি আমাকে সৃষ্টি করেছে বায়ান্ন থেকে একাত্তরের মহান যুদ্ধের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির বাতাবরণে। কাজেই তাকে ভুলে থাকার কোনো সুযোগ নেই আমার জীবনে। আমি যত দূরেই থাকি না কেন, দেশ বাস করে আমার অন্তরের গভীর তলদেশে। জল ছাড়া যেমন মাছ বাঁচে না, তেমনি মানুষও তার দেশ ছেড়ে বাঁচতে পারে না বলেই আমি বিশ্বাস করি। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যে বাঙালি বাস করছে, সে কিন্তু তার ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, আচার–আচরণকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই প্রবাস ভূমিতেই। তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে স্বদেশকে প্রোথিত করে দিচ্ছে নিরন্তর। নিজ দেশের গৌরব এখানেই নিহিত। তুলনামূলকভাবে বলা যায়, স্বদেশ হলো আত্মার মনভূমি, প্রবাস জীবন তার বহিরঙ্গ সংযোগ ব্রিজ। বাংলা ভাষা-কৃষ্টির চর্চার মধ্যে দিয়েও আমরা দেশকে অনুভব করি অভিন্ন মাত্রায়।
স্বদেশকে ভালোবেসে নিউইয়র্ক প্রবাসী বাঙালি বিশ্বজিৎ সাহার উদ্যোগে যে বইমেলা সংস্কৃতি একদিন যেভাবে শুরু হয়েছিল, আজ তারও বয়স ৩০ বছরের বেশি। একটি দেশ, দেশের ভাষা ও সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অতি উত্তম মাধ্যম হিসেবে নিউইয়র্ক মুক্তধারার বইমেলা আজ প্রবাসে বাংলা ভাষা সংস্কৃতির পতাকা হয়ে উঠেছে। তারা প্রমাণ করেছে, জীবন–জীবিকার প্রয়োজনে প্রবাসে থাকলেও মূলত সর্বক্ষণ দেশের সঙ্গেই আছি আমরা। দেশের উন্নয়ন, কল্যাণ ও মঙ্গল চিন্তাকে কেন্দ্র করেই দেশ ও দেশের ভাষা-সংস্কৃতি কৃষ্টি ইতিহাসকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাঙালি। একইভাবে পূরবী বসু জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ‘উত্তর আমেরিকা বাংলা সাহিত্য পরিষদ’–এর উদ্যোগে বাংলা ভাষা বনাম দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। দ্বিতীয় বিশ্ব বাংলা সমাবেশের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষার শিল্পীদের তারা স্বাদেশিক সৌহার্দ্য ও ভালোবাসার পতাকাতলে জড়ো করতে পেরেছেন। টরন্টোতে সাদি ভাই ‘অন্যমেলা’নামে বই মেলা শুরু করেছেন বেশ কিছুকাল ধরে। প্রতি বছর মুক্তধারা নিউইয়র্ক শাখার অনুরূপ বই মেলা করছেন তিনি। এই অতিমারির সময়ে অন্যদের মতো ভার্চুয়াল মেলা করেছেন রেকর্ড করে।
কবি আসাদ চৌধুরী এবং আমিও সেখানে বাংলা কবিতার ইতিহাস নিয়ে কথা বলেছি। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বাঙালিরা এভাবেই তাদের দেশ নিয়ে জাগ্রত আছে। এমনকি ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে প্রবাসের মাটিতে তারা শহীদ মিনারের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পেরেছে নিউইয়র্ক ও টরন্টোর বাঙালি কমিউনিটি। অর্থাৎ প্রবাসে বসবাসরত প্রত্যেকে বাঙালি দেশের ভাবনা থেকেই কাজে করছেন দেশের জন্য, সর্বোপরি নিজ অস্তিত্বের জন্যই। এ থেকেই প্রমাণিত, আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অপর নাম স্বদেশ।
২০১২ সালে রফিক আজাদ ও আমাকে নিয়ে আমাদের বড় সন্তান অভিন্ন একটি সপরিবার ভ্রমণের ব্যবস্থা করেছিল। সেই যাত্রায় সুইজারল্যান্ডে প্রথমে আমার ছোট ভাই হাবিবের ডেলিমন্ডের বাড়িতে উঠেছিলাম। অতঃপর দুই সন্তানকে নিয়ে আমরা চারজন রোমে বেড়াতে গিয়েছিলাম দুদিনের জন্য। ভ্যাটিক্যান সিটিতে সিসটিন চ্যাপেল দেখি প্রথম। সেখান থেকে রোমের কলোসিয়াম দেখে ফেরার পথে ফুটপাতে এক বাঙালি হকারের হাব-ভাব এবং তার ইংরেজি কথা বলার ভঙ্গি দেখে তাকে প্রশ্ন করে জেনেছিলাম, তার বাড়ি শরিয়তপুরে। পৃথিবীর বিখ্যাত হেরিটেজ কলোসিয়াম দেখে সেদিন আমি যত না অভিভূত হয়েছিলাম, সেখানে একজন বাঙালির পরিচয় পেয়ে আমি ততধিক আনন্দে উদ্বেল হয়ে পড়েছিলাম। এই হলো আমার দেশ এবং আমার শেকড় সন্ধানের গল্প। অন্যদের ক্ষেত্রে কী হয় জানি না। তবে প্রবাসে আমার দেশকে আমি আবিষ্কার করি একজন বাঙালি হিসেবে অপর বাঙালির প্রাণের গান শুনে।