নো বর্ডার, নো বাউন্ডারি

‘লীলাবালি লীলাবালি

ভর যুবতী সইগো

ভর যুবতী সইগো

কী দিয়া সাজাইমু তোরে’

ইউটিউবে চোখ আটকে গেল মুজার গানে। নতুনত্ব আছে। যেমনটি আছে তার ‘আইলারে নয়া দামান’ গানেও। লীলাবালির সুরের বিশ্বজনীন আবেদন আছে। আসলে লোকসংগীতের কোনো সীমানা নেই। এ প্রসঙ্গে শিল্পী হিমাংশু গোস্বামীর একটি স্মৃতিকথা মনে পড়ল। ‘সাধের লাউ’ গানের প্রথম শিল্পী বসবাস করেন ব্রিটেনে। আগে অনুষ্ঠানের জন্য নিয়মিত আসতেন নিউইয়র্কে। সে ধারাবাহিকতায় এখন ছেদ পড়েছে। আমার সঙ্গে পরিচয়-ঘনিষ্ঠতা অর্ধ শতাব্দীর, সেই সিলেট থেকেই।

হিমাংশু গোস্বামী স্কটল্যান্ডের একটি অনুষ্ঠানের গল্প করেছিলেন। তিনি গান গাইছেন। একটি জনপ্রিয় বাংলা লোকসংগীত। লক্ষ্য করলেন, দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে উল্লাস। কেউ কেউ নৃত্যও করছেন। বাংলা গানের এমন প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা অবাক হলেন। গান শেষে জানার চেষ্টা করলেন, দর্শকদের এমন প্রতিক্রিয়া কেন? যা জানলেন, তাতে আরও অবাক হলেন। তাঁর গাওয়া গানের সুরের সঙ্গে মিল রয়েছে স্কটল্যান্ডের জনপ্রিয় একটি লোকসংগীতের। ভাষা না বুঝলেও সুরের মিলে উপভোগ্য হয়েছে গানটি। এ কারণেই এমন প্রতিক্রিয়া। এ থেকেই বোঝা যায়, লোকসংগীতের কোনো বর্ডার নেই, নেই কোনো বাউন্ডারি।

৭০-৮০’র দশকে বিটিভিতে বনি এমের একটি গান শুনতাম, যার সুর এখনো কানে বাজে। গানটি হলো—‘ব্রাউন গার্ল ইন দ্য রিং লা লা লা-সি লুকস লাইকস অ্যা সুগার অ্যান্ড পালম’।

বৃহত্তর সিলেটে লোকসংগীতের এক বড় ভান্ডার রয়েছে। হাসন রাজা, রাধারমণ, আরকুম শাহ, শিতালং শাহ, দুরবীন শাহ, কবি দিলওয়ার, শাহ আবদুল করিম, গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, ক্বারী আমির উদ্দিনসহ গ্রাম-গঞ্জের শত শত কবি-গায়কের কাছে আছে হাজারো লোকগীতি।

চার দশক আগের কথা। চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্যভূষণ নিয়মিত আসতেন যুগভেরীতে। তাঁর ছেলে হারুন আকবরের শ্বশুরবাড়ি ছিল যুগভেরী অফিসের পাশেই। এ উপলক্ষেও আমাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হতো একটু বেশি। লোকসংগীত সংগ্রহে তাঁর জুড়ি নেই। হাজার হাজার গান সংগ্রহ করে তিনি বাংলা একাডেমিকে দিয়েছেন। বাংলা একাডেমি তাঁর সংগ্রহ থেকে কয়েক শ গান-কবিতা নিয়ে ‘সিলেট গীতিকা’ নামে একটি বইও প্রকাশ করেছে। সংগ্রহের বাকিগুলো প্রকাশিত হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।

সে সময়ের আরেকটি ঘটনা মনে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি আন্তর্জাতিক ফোকলোর সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেলেন চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্যভূষণ। উড়োজাহাজের টিকিট সংগ্রহ করতে না পারায় সম্মেলনে তাঁর যোগদান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এ লজ্জা কার!

এ অবস্থায় সে সময়ের প্রভাবশালী দৈনিক ইত্তেফাক এক কড়া সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। পরদিনই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস তাঁকে একটি টিকিট উপহার দেয়। এতে তাঁর যুক্তরাষ্ট্র সফর সম্ভব হয়।

একদিন গল্পের ছলে বলছিলেন, তিনি যা সংগ্রহ করেছেন তার চেয়ে বহুগুণ বেশি লোকসংগীত গ্রাম-গঞ্জে পড়ে রয়েছে, সংগ্রহের অপেক্ষায়।

কবি দিলওয়ার আমাদের তরুণ প্রজন্মের অভিভাবক ছিলেন। যুগভেরীতে তাঁকে ঘিরে কবি সাহিত্যিকদের জমজমাট আড্ডা হতো। তাঁর লেখা গান ‘তুমি রহমতের নদীয়া, দোয়া করো মোরে হজরত শাহজালাল আউলিয়া’ গেয়ে ১৯৬৭ সালে সিলেট বেতার কেন্দ্র উদ্বোধন করা হয়। গানটি গেয়েছিলেন শিল্পী আরতি ধর।

কিংবদন্তি শাহ আবদুল করিম যুগভেরীতে আসতেন। সঙ্গে থাকতেন সাংবাদিক আল আজাদ। তাঁর হাসি মুখ ভুলতে পারি না। গানের খাতা সঙ্গে থাকত। শাহ করিম ছিলেন উদীচীর উপদেষ্টা। গণমুখী রাজনীতি ও সংস্কৃতি চর্চায় তিনি ছিলেন নিবেদিত।

গীতিকার গিয়াসউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকতাও করেছেন। তিনি যুগভেরীর ছাতক প্রতিনিধি ছিলেন। তাঁকে নিয়েও যুগভেরীতে জমজমাট আড্ডা হতো। ‘সিলেটে প্রথম আজানধ্বনি বাবায় দিয়াছে’সহ তাঁর বেশ কিছু জনপ্রিয় গান রয়েছে। তাঁর ছেলে আনোয়ার হোসেন বর্তমানে বাংলাদেশের একজন নামকরা উপস্থাপক ও সংস্কৃতি কর্মী।

একটি বিষয় সত্য, যেকোনো সাফল্যের অনেক মাতা-পিতা বা দাবিদার থাকে; বিফলের কেউ না।

শিল্পী হিমাংশু গোস্বামী প্রথম সিলেট বেতার থেকে ‘সাধের লাউ’ গানটি পরিবেশন করেন। সঙ্গে সঙ্গে গানটি বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। এ গানের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হিমাংশু গোস্বামী প্রধান আকর্ষণ হয়ে ওঠেন। এরপর শিল্পী রথীন্দ্র নাথ রায় ও রুনা লায়লা গাওয়ার পর গানের জনপ্রিয়তা দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় শিল্পী বিদিত লাল দাস ও তাঁর গানের দল বিটিভিসহ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান পর্ব এবং দেশি-বিদেশি ফোরামে গানটি পরিবেশন করে আলোড়ন তোলেন। বিদিত লাল দাসের গানের দলে ছিলেন সুবীর নন্দী, রামকানাই দাস, আকরামুল ইসলাম, দুলাল ভৌমিক, হিমাংশু বিশ্বাস, হিমাংশু গোস্বামী, গিয়াস উদ্দিন আহমদ, জামাল বান্না প্রমুখ।

ওই সময় ঢাকার দৈনিক বাংলার মতামত বা চিঠিপত্র কলামে ‘সাধের লাউ’ গানের উৎপত্তি, সৃষ্টি ইত্যাদি নিয়ে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। এর লেখক নিয়ামত আলী। চার দশক পর লেখাটির বিস্তারিত মনে নেই। তবে সারমর্ম মনে আছে। তা হচ্ছে—হিমাংশু গোস্বামী গানটির প্রথম কয়েক লাইন সংগ্রহ করে সিলেট বেতারে নিয়ে আসেন এবং সংগৃহীত গান হিসেবে তাঁর কণ্ঠে রেকর্ড করাতে উদ্যোগী হন। সমস্যা দেখা দেয় গানটির আকার নিয়ে। পূর্ণতা দিতে হলে এর আকার বাড়াতে হবে। এগিয়ে আসেন গীতিকার গিয়াস উদ্দিন আহমদ। তিনি এক লাইন যোগ করলেন। সুর করার সময় ফুল মোহাম্মদ বা রাস বিহারী চক্রবর্তী আরও এক লাইন যোগ করলেন। এভাবে গানটি পূর্ণতা পায়। হিমাংশু গোস্বামীর কণ্ঠে সংগৃহীত গান হিসেবে রেকর্ড ও সম্প্রচারিত হয়।

দৈনিক বাংলায় লেখাটি প্রকাশ হওয়ার পরদিন সকাল। আমার ধোপাদীঘির উত্তর পারের বাসার দরজায় নক। খুলে দেখি পটলদা (বিদিত লাল দাস)। বললেন, ‘মহবুব ভাই, আপনজন হয়ে আপনি আমার এত বড় ক্ষতি করলেন!’

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। পটলদা দৈনিক বাংলার লেখাটি দেখিয়ে বললেন, ‘কে আপনাকে এসব দিয়েছে, সব জানি আমি।’

তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। বললাম, এটা তো নিয়ামত আলীর লেখা, আমার নয়। কিন্তু পটলদা বুঝতে রাজি নন। তাঁর দলের এক শিল্পীর নাম ধরে বলতে থাকলেন, ‘সেই আপনাকে দিয়ে সবকিছু করাচ্ছে। আমি সব খবর পেয়েছি।’

অনেক চেষ্টা করে তাঁর ক্ষোভ কিছুটা প্রশমনে সক্ষম হলাম। তবে সেদিন বা তারপরেও পটলদাকে আমার জিজ্ঞাসা করা হয়নি, ওই লেখায় ক্ষতিটা কি হয়েছিল।

ওই সময় শোনা যেত, কোনো কোনো শিল্পী প্রচারের সুবিধার্থে নিজের লেখা বা সংগৃহীত গোপন করে হাসন রাজার গান বলে সিলেট বেতারে রেকর্ড করাতে চাইতেন।

বহু বছর পর আরেক বিতর্ক দেখলাম। মুজা ও তোশিবার কণ্ঠে ‘আইলারে নয়া দামান’ গান ভাইরাল হওয়ার পর। আসলে ৫০ বছর আগে যখন শিল্পী ইয়ারুন্নেসার কণ্ঠে বেতারে গানটি রেকর্ড করা হয়, বিরোধ থাকলে তখনই এর নিষ্পত্তি হওয়া উচিত ছিল। তথ্য বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এসব বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি কমিটি বা সেল গঠন করে দিতে পারে।

তবে যে যাই বলুক, মুজা ও তোশিবার গাওয়া ‘আইলারে নয়া দামান’ গানটি দারুণ হয়েছে। আমার শোনা ‘আইলারে’ গানের মধ্যে এটিই সেরা।