নূতনের কেতন উড়িয়েছেন নজরুল

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে তাঁর শেষ বয়সে হলেও আমরা বাংলাদেশের মাটিতে তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি। কবির ভ্রাতুষ্পুত্র প্রয়াত কাজী মোজাহার হোসেন তখন চুরুলিয়ার নজরুল অ্যাকাডেমির পরিচালক থাকার সুবাদে এবং বঙ্গবন্ধুর একান্ত প্রচেষ্টায় কবি নজরুলকে ঢাকায় আনা সম্ভব হয়েছিল।

কাজী নজরুল ইসলাম এক আত্মসচেতন বিরল প্রতিভার নাম। যতটা একজন সৃজনশীল শিল্পীর জন্য প্রয়োজন। পাঠক মাত্রই স্বীকার করবেন, নজরুল ইসলাম ছিলেন সদা জাগ্রত একজন শিল্পী। কারও কারও মতে, একজন প্রকৃত শিল্পী তাঁর শিল্পকর্ম সম্পর্কে শুরুতে কিছুই জানতেন না, কিন্তু যখন তিনি আঁকতেন, শিল্প আপনাআপনি হয়ে যেত। তেমনি নজরুল ইসলাম ও জানতেন না যে, তিনি এক নতুন যুগের সৃষ্টিকে এগিয়ে আনছেন। যিনি তাঁর প্রথম বইয়ের প্রথম কবিতায় লিখেছেন, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর!/তোরা সব জয়ধ্বনি কর!/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়/তোরা সব জয়ধ্বনি কর!’

আমার কৈফিয়ৎ নামে নজরুলের প্রথম কবিতা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালে। এর আগে তিনি তীক্ষ্ণ হীরক খণ্ডের মতো ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখেছেন। ‘খেয়াপারের তরণী’র মতো কবিতা লিখেছেন, প্রেমের কবিতা লিখেছেন, সর্বনাশের ঘণ্টার মতো ক্রুদ্ধ কবিতা লিখেছেন, এতেই বোঝা যায় নজরুল বহুভাবে বিপরীত দিকে ধাবিত হয়েছেন। নজরুলের অনেক কবিতা যেমন—বিদ্রোহী; দারিদ্র্য; আমার কৈফিয়ৎ অনেক গতিশীল কবিতা।

প্রথমেই কবি নিজেকে বর্তমানের কবি বলে আখ্যায়িত করেছেন। ‘প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, যেন লেখা হয় আমার রক্তে তাদের সর্বনাশ’ কবিতার স্তবকে বর্তমানের কবি কথাটার বিশদ বিবরণ লক্ষণীয়। তিনি চির প্রেমের কবি। তিনি যৌবনের দূত। তিনি প্রেম নিয়েছিলেন, প্রেম দিয়েছিলেন। আসলে তিনি বিদ্রোহী কবি। আবার তিনি মানুষকে অনায়াসেই বলতে পারেন, আমার আপনার চেয়ে আপন যেজন খুঁজি তারে আমি আপনায়। বাংলা কবিতায় নজরুলের আবির্ভাব একেবারে উল্কার মতো। হঠাৎ তিনি একদিন বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হয়ে পুরো আকাশকে রাঙিয়ে দিলেন, তা নিয়ে এখনো গবেষণা হতে পারে।

বাংলা সাহিত্যে তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। এক কথায় বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি স্তরে তাঁর ছিল সমান বিচরণ। অন্যায়, অবিচার, অসাম্য, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে চির বিদ্রোহী কবি নজরুলের সমগ্র সাহিত্যে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছে। এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছেন মানবপ্রেমিক নজরুল। মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা, মানুষের বেদনা, যাতনা, পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এক কথায় মানবপ্রেম।

নজরুলের ছোটগল্পে এক নতুন ভাবধারা সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনি’ গল্পে যেভাবে নিচুতলার জীবনের কথা উঠে এসেছে তেমন রূপায়ণ বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পে ছিল না।

নজরুলের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস মৃত্যু-ক্ষুধা; বস্তিবাসীর প্রকৃত ছবি এর আগে অন্য কোনো উপন্যাসে পাওয়া যায়নি। নজরুলের উপন্যাসে যে মানবপ্রেমী দৃষ্টিকোণ যুক্ত হয়েছে তা তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতারই ফসল। অসাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু মুসলমানের মিলন, সমাজের নিচুতলার মানুষের উত্থান এসবই নজরুলের মানবিকতার অংশ। নজরুল মনে প্রাণে ব্রিটিশের উচ্ছেদ কামনা করেছেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে নজরুলের উচ্চারণে একতিল খাদ ছিল না, নজরুল শেষ পর্যন্ত ইংরেজ নয়-ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। তিনি লক্ষ্য করেছেন, মানুষ চিরকাল মানুষের ওপর অত্যাচার করে এসেছে। নজরুল জীবনভর লাঞ্ছিত মানুষেরই জাগরণ কামনা করেছেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান-কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস। তাই তিনি হয়ে উঠলেন আমাদের জাতীয় কবি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলা দেশে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করেন।

নজরুলের কবিতার ক্ষেত্রে দৃষ্টি দিলে দেখি, বহু আয়তনে বিস্তৃত তাঁর কবিতা। ব্যক্তি জীবনের উদার মানবিকতার চর্চাই নজরুলের সাহিত্যিক জীবনে প্রতিফলিত হয়েছিল। ক্রোধ, ধার্মিকতা, আধ্যাত্মিকতা, সমাজ ও রাজনীতি, বাস্তব ও স্বপ্ন মিলে কখনো দেখা গেছে গভীর বিষাদে মগ্ন থেকে কবি কাজ করেছেন মাত্র দুই যুগ। সুস্থাবস্থার সময়কাল মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাস আধুনিক এই কবিদের চেয়ে অনেক কম সময় পেয়েছেন কবি নজরুল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হলে কবি নজরুল চলে যান করাচিতে। কিন্তু সেখানে বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি করাচির মাটি। তিনি চলে এলেন কলকাতায়, কমরেড মুজাফ্‌ফর আহমদের সঙ্গে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে। নজরুল ইসলাম ও মুজাফ্‌ফর আহমদ দৈনিক ‘নবযুগ’ প্রকাশ করেন। এ কে ফজলুল হক ছিলেন প্রধান পরিচালক। মুজাফ্‌ফর আহমদ মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হলে নজরুল সম্পাদিত অর্ধ সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ বের করেন। তারপর সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘লাঙল ‘প্রকাশিত হয়। লাঙল পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই বিদ্রোহী কবির সাম্যবাদী চরিত্র প্রকাশিত হয়। তখনই ঘোষিত হলো মানবতার জয়গান।

‘গাহি সাম্যের গান

যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান

যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রিশ্চান।’

১৯২৫ সালে প্রকাশিত সাম্যবাদী কবিতাগ্রন্থ সমাজতন্ত্রী বাংলা কবিতার দরজা খুলে দিল। ৩০ ও ৪০-এর দশকে সাম্যবাদী কবিতার যে প্রবাহ, তার প্রতিকৃত কাজী নজরুল ইসলাম। চৌদ্দশো বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নজরুল ইসলামই হিন্দু মুসলমান মিলনের শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা। শত শত বছর ধরে হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি বাস করলেও সাহিত্যে তা আদৌ যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি। ব্যক্তি জীবনেও নজরুল তার ব্যবধান রাখেননি। বিয়ে করলেন হিন্দু মেয়ে, কাজী ফকির আহমদের পুত্র কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর পুত্রদের নাম রাখলেন হিন্দু মুসলিম ঐতিহ্যকে সমান করে।

নজরুল হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের আচার থেকে অন্তরাত্মা অবধি ব্যবহার করেছেন। শুধু কবিতায় নয় গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, প্রবন্ধে, গানে সব ক্ষেত্রে তাঁর প্রধান লক্ষ্য শেষ পর্যন্ত মানুষেরই মহিমা কীর্তন, মানুষেরই বিজয় ঘোষণা। বহুমাত্রিক নজরুল, ইসলাম ধর্মের অসামান্য সাহিত্যিক রূপ দিয়েছেন তাঁর কবিতা-গানে। আবার নজরুলের ইসলামি কবিতার একটি প্রধান উদ্দেশ্য, মুসলমানের জাগরণ বা পুনর্জাগরণ। ফলে তাঁর কবিতা গানে ভক্তি ও আত্মসমর্পণ যেমন আছে তেমনি আছে আরও কয়েকটি দিক। নজরুল বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন ইসলামের সাম্য চেতনায়। তাঁর একটি গানের কথা ধরা যাক—

‘ধর্মের পথে শহীদ যাহারা আমরা সেই সে জাতি।

সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা বিশ্বে করেছি জ্ঞাতি।

আমরা সেই সে জাতি।’

এই গানে কবি উঁচু-নিচের ভেদহীন ইসলামের কথা বলেছেন, অমুসলিমদের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধের কথা বলেছেন। নজরুলের ঈদ বিষয়ক কবিতাগুলোতে প্রায় সব সময়ই মানুষে মানুষে সাম্যের কথা উচ্চারিত হয়েছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের শোকাবহ ঘটনার এক বছর পর, ১৯৭৬ সালের ২৮ আগস্ট এই শোকের মাসেই কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।

কবি কাজী নজরুল এই বাংলায় নূতনের কেতন উড়িয়েছেন। এই মানব প্রেমিক কবির উদ্দেশ্যে একবিংশ শতাব্দীতে তাঁর তিরোধান দিবসে আমরা দাঁড়িয়ে সালাম জানিয়ে যেতে চাই।