নীলা আমার কেউ না
কিছু কিছু মানুষের চোখের দিকে তাকালেই মনে হয় কত দিনের চেনা। নীলা মেয়েটিকে প্রথম দেখে সে রকম মনে হয়েছিল। কী রকম যেন এক নেশা আছে তার দুই চোখে, একবার তাকালে সেই নেশাই যেন কাছে টেনে নিয়ে যায়। বয়সে আমার চেয়ে কম করে হলেও ১৫-১৬ বছরের ছোট হবে নীলা। আমি ৩৭ বছরেও যুবকই মনে করি নিজেকে। ব্যবসা, গাড়ি, বাড়ি, বউ, ফুটফুটে দুই মেয়েও আছে আমার। ব্যবসার কারণে সংসারে যথেষ্ট সময় দিতে না পারলেও সংসারের প্রতি আমার টান কোনো অংশেই কম নয়। আমার বউ মিনু এই ব্যাপারটা খুব ভালো করেই বোঝে বলে সংসারের সবকিছু সে সামলায়।
সেদিন ছোট্ট পরিসরে নীলার সঙ্গে পরিচয়, বন্ধু মারুফের মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। নীলা সম্পর্কে মারুফের ভাগনি হয়। কী একটা কারণে নীলাকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। সেদিন আমারও ছিল বাসায় ফেরার তাড়া। মারুফ যখন বলছিল, অনুষ্ঠান শেষ হলেই নীলাকে পৌঁছে দেবে। কথাটা শুনেই মারুফের কাছে নীলাদের বাসা কোথায় জানতে চাইলাম। যখন শুনলাম নীলাদের বাসা ফেলেই আমাকে যেতে হবে তখন ভদ্রতা করেই বললাম, কোনো আপত্তি না থাকলে আমি নীলাকে ড্রপ করতে পারি। মারুফের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব সেই কলেজ থেকেই, সে আমাকে খুব ভালো করেই জানে, তাই না বলেনি। গাড়িতে উঠেই পেছনের সিটে বসতে চাইলে বললাম মানুষ তো আমাকে তোমার ড্রাইভার ভাববে, বলতেই সামনে এসে বসল নীলা। তারপর ননস্টপ কথাবার্তা চলতেই থাকল। সব কথার সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলেও ভীষণ ভালো লাগছিল, মনে হচ্ছিল নিজেও ২০-২২ বছর বয়সে ফিরে গেছি। ওর কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। নীলা মুগ্ধ আমার কথার কৌশলে। অভিমানী সুরে বলল—কেউ তাকে বোঝে না, যেন আমি তাকে খুব বুঝতে পেরেছি। আমার নিজের মনে হলো, নীলাকে যেন কতকাল থেকে চিনি! ভীষণ ভালো লাগছিল তার সঙ্গে কথা বলতে। জানতে চাইলাম কোন গান শুনতে চায়। তার পছন্দ শ্রেয়া ঘোষালের গান। গান শোনা আমার তেমন হয় না। কিন্তু এই কয়দিন ধরে সময় পেলেই শ্রেয়া ঘোষালের গান শুনছি। গান যখনই শুনি, মনে হয় নীলা আমার পাশে বসে আছে।
এমন কিছু কিছু সম্পর্ক আছে যার নাম দেওয়া না গেলেও সেগুলো খুব মূল্যবান সম্পর্ক হয়ে থাকে। শুধু সম্পর্কের খাতিরে সম্পর্ক রাখতে গেলে বহু হিসাব-নিকাশ যুক্ত হয়ে যায়, তার থেকে দাবি-দাওয়াহীন বেহিসেবি সম্পর্ক অনেক বেশি মধুর হয় হয়।
প্রতিদিনের রুটিনের বাইরেও কথা বলার জন্য জায়গা লাগে, যা আমার নেই। আমার বউ মিনু সংসার খুব ভালো বোঝে কিন্তু রোমান্টিকতা বোঝে না। অবশ্য আমি যে মাত্রায় রোমান্টিক, দুজন এক রকম হলে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে এই সংসার করা কঠিন হয়ে যেত। মিনুর সবকিছু রুটিনে চলে, রুটিনের বাইরে রাতে তার গায়ে হাত পড়লেও সরিয়ে নেয়। আমি মিনুর রুটিনে চলি বা রুটিনই আমাকে চালিয়ে নেয়। মাঝে মধ্যে মন চায় সব নিয়ম ভেঙে বেড়িয়ে আসি। মিনুকে বলি, চলো এক মাস আমরা নিজেদের মতো চলি রুটিনের বাইরে, কিন্তু পারি না। মিনুর কথার বাইরে না যাওয়া আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। দিন শেষে দুই মেয়ে যখন গলা জড়িয়ে ধরে, তখন পৃথিবীতে নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে মনে হয়। তখন মনে হয় চলুক, চলছে যেমন।
সেদিন নীলাকে তাদের বাসার গেটে নামিয়ে দেওয়ার সময় আমার মোবাইল নম্বর দিয়ে বলেছিলাম, ঘরে ঢুকে যেন মেসেজ দেয় ঠিকঠাক পৌঁছেছে কিনা। রাত বারোটায় নীলার মেসেজ পেলাম, ঘরে গিয়ে মেসেজ দিতে ভুলে গেছি। সঙ্গে সঙ্গে মেসেজের উত্তর দিলাম—কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু এখনো ঘুমাওনি? সে জানাল, রাতে তার জেগে থাকতেই ভালো লাগে। মিনুর চোখ ফাঁকি দিয়ে বেশিক্ষণ মেসেজ চালাচালি সম্ভব হবে না বুঝে পরে কথা বলার সুযোগ রেখে ফোন থেকে বিদায় নিলাম। কিন্তু ছোট্ট মেসেজ চালাচালির মধ্যেও যেন কেমন এক নেশা ছিল, যা ওই দিন থেকেই আমাকে ঘোরের মধ্যে নিয়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে নিজ থেকেই তার খোঁজ খবর নিতাম, সে-ও মনে হয় খুশি হতো আমার ফোন পেলে। ধীরে ধীরে মিনুর রুটিনের মতো নীলার সঙ্গে ফোনে কথা বলাও আমার রুটিনে তৈরি হলো। বেশ যাচ্ছিল সময়। সেদিন নীলা যখন বলল, সামনে তার জন্মদিন, মন চেয়েছিল সারা শহরজুড়ে জন্মদিনের উৎসবের আয়োজন করি। নীলাকে বললাম, জন্মদিনে কী গিফট চাও? নীলা বলল, যা চাই তা তো দিতে পারবেন না। বললাম, তুমি চেয়েই দেখ। নীলা বলল, আমি যা চাই তা কারও কাছে নেই, এমনকি আমার বাবা-মায়ের কাছেও নেই। কথাটির মধ্যে যেন এক করুণ সুর ছিল। নীলা শুধু আমাকে নিয়েই তার জন্মদিন পালন করল। আমার দেওয়া সোনার চেন নীলা তাকে পরিয়ে দিতে বলল। চেন পরিয়ে দিতে দিতে আবিষ্কার করলাম নীলার গা থেকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ বের হচ্ছে। মন হচ্ছিল, দীর্ঘ সময় নিয়ে নীলাকে চেন পরিয়ে দিই। এভাবে হুটহাট নীলা মনের মধ্যে জায়গা করে নেওয়াতে এক ধরনের অনুশোচনাও কাজ করছিল নিজের মধ্যে। বুঝতাম কোথাও ভুল হচ্ছে, কিন্তু নিজের ওপর ছিলাম নিয়ন্ত্রণহীন। আমি বুঝতাম, ওর সঙ্গে না যায় আমার বয়সে, না যায় চিন্তায়। একদিন নীলা প্রশ্ন করেছিল, আচ্ছা এই যে আমরা দুজন মানুষ প্রতিদিন কথা বলি, মাঝে মাঝে দেখা করি, আমাদের সম্পর্কটা আসলে কী? আমি বলেছিলাম, এমন কিছু কিছু সম্পর্ক আছে যার নাম দেওয়া না গেলেও সেগুলো খুব মূল্যবান সম্পর্ক হয়ে থাকে। শুধু সম্পর্কের খাতিরে সম্পর্ক রাখতে গেলে বহু হিসাব-নিকাশ যুক্ত হয়ে যায়, তার থেকে দাবি-দাওয়াহীন বেহিসেবি সম্পর্ক অনেক বেশি মধুর হয় হয়। নীলার সঙ্গে কথা বলার পর নিজেকে এত রিফ্রেশ লাগে, তখন মনে হয় দুনিয়ার যেকোনো কঠিন সমস্যার সমাধান তুড়ি মেরে করে দিতে পারি। অথচ কথাবার্তা হয় সব আবোলতাবোল। যারা সব সময় সিরিয়াস কথা বলে অভ্যস্ত, তারা কোনো সময়ই তা অনুভব করতে পারবে না এই অদরকারি কথাবার্তার মধ্যেও এক ধরনের প্রশান্তি আছে।
কিছু কিছু সম্পর্কের পরিণতি বলে কিছু নেই। কিন্তু অস্বীকার করার উপায়ও নেই। নীলার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাও সে রকম। নীলা কিছুদিন ধরে আমাকে কিছু একটা বলতে চায়, কিন্তু কাল রাত থেকে নীলা ফোন ধরছে না কেন বুঝতে পারছি না। মারুফ ছাড়া নীলার আর কোনো কাছের মানুষকেই আমি তেমন চিনি না। এই মারুফকেও ফোন করে যাচ্ছি, ধরছে না। এইমাত্র মারুফের মেসেজ চোখে পড়ল, একটু ব্যস্ত আছি, পরে কথা হবে।
ঠিক করেছি আগামীকাল নীলার সঙ্গে দেখা করব। ভিক্টোরিয়া সিক্রেটের পারফিউম নীলার খুব পছন্দের। গতকাল পারফিউমটি কিনেছি নীলার জন্য। পারফিউমের প্যাকেট করা বক্স হাতে নিয়ে নীলার কথা ভাবতে ভাবতে মিনু বিকেলের চা নিয়ে হাজির। কাপে চা ঢালতে ঢালতে মিনু বলল—আজকের খবর দেখেছ? বললাম, বিশেষ কোনো খবর নাকি?
—নাহ বিশেষ কিছু নয়, তবে আজকাল যে কী হয়েছে মা-বাবার কলহের জের ধরে নীলা নামের ২২-২৩ বছরের একটি মেয়ে দেখলাম সুইসাইড করেছে। টিভিতে বারবার এই নিউজ দেখাচ্ছে।
কথাটি শুনে আমার হাত-পা যেন অবশ হয়ে আসছিল। দৌড়ে গেলাম টিভির সামনে। পেছনে পেছনে মিনুও আসছিল। পারফিউমের প্যাকেট করা বক্সটি হাতে দিয়ে বলল, প্যাকেটটি ফেলে এসেছিলে। বললাম—মিনু, এটা তোমার জন্য।