নিরাপদ সড়ক: দেশে ও প্রবাসে

পার্থে ব্যস্ত ইন্টারসেকশন
পার্থে ব্যস্ত ইন্টারসেকশন

ছেলেবেলা থেকেই যেসব কাজ মেয়েরা সহজে করতে পারে না শুধুমাত্র বাংলাদেশের মেয়ে হওয়ার কারণে, সেসব কাজের প্রতি আমার আকর্ষণ। সাইকেল চালানো তার মধ্যে একটি। শহরের পরিবেশে কাজটা প্রায় অসম্ভব ছিল। আমার একমাত্র সুযোগ ছিল, গ্রামের বাড়িতে গিয়ে শেখা। বছরে বড়জোর দুবার। স্বভাবতই সাইকেলটা প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের, যার উচ্চতা আমার তুলনায় অনেক বেশি। তার ওপরে আমাদের বাড়িটি অনেক বড় জায়গার ওপরে হলেও গাছপালায় ভর্তি। সাইকেল চালানো শেখার জন্য যতটা ফাঁকা জায়গা দরকার ঠিক ততটা নেই। এতসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যে কখনই কাজটি ঠিকঠাক শেখা হয়ে ওঠেনি। এরপর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার প্রচণ্ড চাপ, লেখালেখি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিতর্ক, ছাত্র রাজনীতি—সবকিছু মিলিয়ে সাইকেল চালানোর শখটা প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল।

এরপর মাস্টার্স করতে গেলাম নেদারল্যান্ডসের জার্মান সীমান্তবর্তী ছোট্ট শহর এনস্কেডেতে। আমার মতো যারা প্রথম ইউরোপ এসেছে, তাদের জন্য স্বপ্নের মতো একটি শহর। রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন। লাইন দিয়ে গাড়ি চলে। সাইকেলের জন্য আলাদা লেন। পথচারী পারাপারের সিগনাল না দিলে কেউ রাস্তা পার হয় না। আমাদের থাকার ব্যবস্থা পাঁচতারা হোটেলের বিশেষ অংশে। প্রতিদিন সকালে ইউনিভার্সিটিতে যেতে একটি বড় ইন্টারসেকশনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হতো পথচারী পারাপারের সিগনালের অপেক্ষায়। অনেক মানুষের ভিড় জমে যেত। বিশেষত শিক্ষার্থীদের। কিন্তু কেউ আইন ভাঙছে না। রাস্তায় কোনো গাড়ি না থাকলেও দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছে না।

আমার সাইকেল চালানোর ইচ্ছা আবার জেগে উঠল। রাস্তায় যন্ত্রচালিত যানের সঙ্গে একসঙ্গে চলতে হবে না। মেয়ে হয়ে সাইকেল চালাচ্ছি দেখে কেউ চাপা হাসি দেবে না। এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর কী হতে পারে। বিদায়ী এক ছাত্রের কাছ থেকে পুরোনো একটি সাইকেল কিনে ফেললাম। এক নেপালি বন্ধুর সহায়তায় মোটামুটি চালানোও শিখে ফেললাম। যত দিন নেদারল্যান্ডস ছিলাম, সাইকেল চালিয়েছি নিয়মিত।

একদিনের ঘটনা এমন, সব বাঙালি ছাত্ররা মিলে পিএইচডি অধ্যয়নরত বড় ভাইয়ের বাসায় গেলাম—‘লর্ড অব দ্য রিংস’ দেখতে। ফেরার সময় অনেক রাত। এদিকে আমার সাইকেলের লাইট কাজ করছে না। সকলে আমাকে নিষেধ করল সাইকেল চালিয়ে বাসায় (হোটেলে) ফিরতে। পুলিশ দেখলে ফাইন করে দেবে। অগত্যা ওই রাতে শীতের মধ্যে অন্যদের সঙ্গে হেঁটে ফিরলাম।

আরেকদিন আমার সেই নেপালি বন্ধুর সঙ্গে শপিং এলাকা দিয়ে যাচ্ছি, দেখি শুধু পথচারী সাইন দিয়ে রেখেছে। কোনো ইভেন্ট ছিল। প্রচুর লোকের সমাগম। তাই এই ব্যবস্থা। আমি তাড়াতাড়ি সাইকেল থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। বন্ধুটি ভাবল, আমি নতুন চালানো শিখেছি তাই লোকজনের মধ্য দিয়ে যেতে সমস্যা হচ্ছে। আমি তাঁকে সাইনটি দেখালেও সে পাত্তা দিল না। ধীরে ধীরে সাইকেল চালিয়ে যেতে লাগল যেন আমি খুব পেছনে পড়ে না যাই। কিছু দূর যেতেই পুলিশ তাকে ২৫ ইউরো ফাইন করে দিল। ওর অবস্থা দেখে দুঃখিত হলেও ট্রাফিক আইনের সার্থক প্রয়োগ দেখে সেদিন মনে মনে খুশি হয়েছিলাম। আর ভেবেছিলাম, কবে আমার দেশে এমন দিন আসবে!

বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে প্রথম কিছুদিন রাস্তায় হাঁটতেই আমার ভয় করত। রাস্তা পার হতে তো গলদ ঘর্ম। সময়ের সঙ্গে আবার অভ্যস্ত হয়ে যাই অনিয়মের নিয়মে। কিন্তু বেশি দিন নয়। নেদারল্যান্ডস থেকে ফিরে আসার আড়াই বছর পরে বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ার পার্থে এলাম পারমানেন্ট রেসিডেন্ট হিসেবে। আমাদের পরিচিত ঢাকা শহরের সঙ্গে এই নির্জন শহরের কোনো দিক থেকেই কোনো মিল নেই। এমনকি নেদারল্যান্ডসের ছোট্ট শহর এনস্কেডের তুলনায়ও পার্থ অনেক বেশি নীরব। ট্রাফিক আইন খুব কড়া, বিশেষত যন্ত্রচালিত যানের ক্ষেত্রে। তবে পথচারী ও সাইকেল আরোহীদের ক্ষেত্রে নেদারল্যান্ডসের তুলনায় অনেকটাই ছাড় দেয় এখানকার পুলিশ। তারপরেও আমার পরিচিত অনেককে পথচারী পারাপারের সিগনাল ছাড়া রাস্তা পার হতে গিয়ে অথবা ফুটপাথে সাইকেল চালাতে গিয়ে ফাইন খেতে দেখেছি।

অস্ট্রেলিয়ায় ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া বেশ কঠিন। ভবিষ্যতের চালকেরা যেন সঠিকভাবে শিখে তবেই রাস্তায় গাড়ি নিয়ে নামে, সে জন্যই কড়াকড়ি। লাইসেন্স পেতে প্রথমে একটি থিওরি পরীক্ষা দিতে হয় কম্পিউটারে রোড রুলের ওপর। এরপর হলো আসল চ্যালেঞ্জ—প্র্যাকটিক্যাল ড্রাইভিং টেস্ট। অনেকের কাছে শুনেছি, অস্ট্রেলিয়াতে পারমানেন্ট রেসিডেন্ট হওয়ার চেয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া কঠিন। যথারীতি আমিও প্রথমবার ড্রাইভিং টেস্টে ফেল মারলাম। বলা যেতে পারে জীবনে প্রথমবার কোনো পরীক্ষায় ফেল! কারণটা ছিল, ট্রাফিক সিগনাল হলুদ হয়ে গেলেও আমি দাঁড়াইনি। দ্বিতীয়বার ফেল করলাম রিয়ার ভিউ মিরর নিয়মিত বিরতিতে চেক না করার জন্য। তৃতীয়বার টেনশনে পাসপোর্ট না নিয়ে যাওয়াতে পরীক্ষাই দিতে পারলাম না। চতুর্থবার লাইসেন্সিং সেন্টার থেকে বের হওয়ার আগেই গাড়ির চাকার মধ্যে কী একটা ঢুকে গেল। ব্যাস, পরীক্ষা বাতিল। এদিকে অফিসের বস লাইসেন্সের জন্য তাড়া দিচ্ছে। অবশেষে পঞ্চমবারে লাইসেন্স পেলাম।

লেখিকা
লেখিকা

সেই সব হতাশার দিনগুলো কখনো ভুলব না। কিন্তু এখন মনে হয়, এতসব কড়াকড়ি তো নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করবার জন্যই। তবে এত সতর্কতা সত্ত্বেও সড়ক দুর্ঘটনা পুরোপুরি বন্ধ করা কী সম্ভব হয়েছে? না তা হয়নি। অস্ট্রেলিয়াতে প্রতি বছর বহু মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে। অকালে প্রাণ হারায় বহু মানুষ। আংশিক বা সম্পূর্ণ পঙ্গু হয়ে যায় আরও কত লোক। ড্রিংক ড্রাইভিং আটকাতে নিয়মিত পুলিশ টহল, ব্রেথ টেস্ট চলে। ওভার স্পিডিং বন্ধ করার জন্য হাজার হাজার স্পিড ক্যামেরা আছে। তারপরেও এসব অপরাধ বন্ধ হয় না। আবার কখনো কখনো কোনো অপরাধ ছাড়াই শুধুমাত্র মুহূর্তের ভুলে দুর্ঘটনা ঘটে যায়। আমার এক প্রিয় বন্ধুকে হারিয়েছি এই অস্ট্রেলিয়াতে সড়ক দুর্ঘটনায়।

দুর্ঘটনা কখনো বলে কয়ে আসে না। যেকোনো সময় যেকোনো দুর্ঘটনা কেড়ে নিতে পারে মূল্যবান জীবন। মানুষ হিসেবে আমরা শুধু এর হার কমানোর চেষ্টা করতে পারি নিয়মনীতি জোরদার ও তার যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে। ট্রাফিক লেন ও স্পিড লিমিট মেনে গাড়ি চালানো, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের অন্যতম দুটি মূলমন্ত্র। প্রতিবার বাংলাদেশে গিয়ে বিমানবন্দর থেকে বাসায় যেতে আমার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার উপক্রম হয় শুধুমাত্র রেকলেস ড্রাইভিং দেখে। কয়েক দিন ঢাকাতে থাকার পর কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে উঠি বাস্তবতার সঙ্গে। তবে আমি কখনো মাইক্রো বা প্রাইভেট কারে করে গ্রামের বাড়ি যাই না—তারেক মাসুদ আর মিশুক ‍মুনীরের কথা মনে পড়ে যায়। শত কষ্ট হলেও বাসে যাই। মনে মনে শুধু ভাবি, বাংলাদেশের মানুষ আসলে কতটা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পথ চলে। প্রতিবেশী দেশে ভারতে গিয়েও আমার অভিজ্ঞতা বিশেষ সুখকর নয়। দিল্লি থেকে চণ্ডীগড় ভাড়ার গাড়িতে গিয়ে ফেরার সময় আর সাহস হয়নি—ট্রেনে এসেছি। সে তুলনায় কলকাতার ট্রাফিক কন্ট্রোল অনেক উন্নত মনে হয়েছে।

তবে স্বীকার করতেই হবে, অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মতো ঘন বসতিপূর্ণ জনপদে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। তার ওপরে প্রভাবশালীদের সদিচ্ছার অভাব, বাস ট্রাক চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব, ফিটনেসবিহীন গাড়ির ব্যবহার বিষয়টিকে আরও জটিল করে তোলে। সর্বোপরি অসংখ্য যাত্রীর চাপের কারণে বাস মালিকেরা পুরো ব্যবস্থাকে জিম্মি করার সুযোগ পায়। এ ছাড়া অবকাঠামোগত ঘাটতিও কম নয়। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে চাইলে ধীরে ধীরে এই সবগুলো বিষয়ের দিকেই নজর দিতে হবে। শুধুমাত্র আইন প্রণয়ন করে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ট্রাফিক আইনের প্রতি সকলকে শ্রদ্ধাশীল করে তুলতে গণসচেতনতামূলক প্রচারণা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। সর্বস্তরের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সদিচ্ছার মধ্য দিয়েই কেবল সড়কের নিরাপত্তা বাড়ানো সম্ভব।
...

শর্মিষ্ঠা সাহা: পার্থ, অস্ট্রেলিয়া।