নিঝুম নীরবতায় প্যারিস নগরী

হামলার পর প্যারিসের একটি এলাকা
হামলার পর প্যারিসের একটি এলাকা

১৩ নভেম্বরের শুক্রবার ফ্রান্স-জার্মানির প্রীতি ফুটবল ম্যাচ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই টেলিভিশনের পর্দায় ফরাসি ভাষায় ভেসে উঠল প্যারিস অ্যাটাক। একটু অবিশ্বাস বোধ নিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম কী ঘটেছে। ফ্রান্স জার্মানির কাছে ২-০ গোলে ম্যাচ জিতেছে। কিন্তু ম্যাচ পরবর্তী খেলার বিশ্লেষণ, পুরস্কার বিতরণী, দর্শকদের বিজয় উল্লাসের কোনো মুহূর্ত টেলিভিশনে আর প্রচার না দেখে মনে হলো সত্যি প্যারিসের বুকে কোনো অশুভ তাণ্ডব চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেলের পর্দায় ভেসে আসতে লাগল ঘটে যাওয়া নির্মমতার বাস্তব চিত্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা। যা দেখে মনে হচ্ছিল রোমাঞ্চকর নগরী যেন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। মনের মধ্যে কিছুটা আশঙ্কা বোধ কাজ করছিল। কারণ প্যারিসের গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল স্থান ও এলাকায় সন্ত্রাসী হামলায় একের পর এক মৃত্যুর সংখ্যা গণনা করে টিভি চ্যানেলগুলো সংবাদ পরিবেশন করে চলছে।

হামলার পর প্যারিসের একটি এলাকা
হামলার পর প্যারিসের একটি এলাকা

আমি যে এলাকায় বাস করি সেটি প্যারিসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি জনবহুল পর্যটন স্থল—নাম মনমাদ। এখানে সব সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা থাকে। শার্লি এবদোর অফিসে সন্ত্রাসী হামলার পর এখানে এক সেকশন সেনা সদস্য মোতায়েন করা হয়। এই বাড়তি নিরাপত্তা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রাখা হয়েছে। তাই এখানে এমন কোনো ঘটনা ঘটে কিনা সেই দোদুল্যমান ভীতি নিয়ে ঘুমাতে গেলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফেসবুকে চোখ বুলাতেই দেখি মেসেজ ইনবক্সে জমা পড়ে আছে অনেকগুলো মেসেজ। পরিচিত বন্ধু-স্বজনদের অনেকেই আমাদের পরিস্থিতির জানতে চেয়েছেন। প্যারিসে অবস্থানরত পারিবারিক বন্ধুদের অনেকেই ফোনে সতর্ক করে প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিলেন।
এত বড় ঘটনা ঘটার পরে আরও অনেক কিছুই ঘটার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া জরুরি অবস্থা জারির কারণে বাইরে না বের হয়ে টিভি পর্দায় চোখ রেখেই সারা দিন কাটিয়ে দিলাম গৃহবন্দী হয়ে। ঘটনার একদিন পর রোববার প্যারিসে জনমনের আতঙ্ক কিছুটা স্বাভাবিক। শোকার্ত স্বজন ও শান্তিকামী হাজার হাজার জনতা রিপাবলিক চত্বরসহ হামলার স্থানগুলোতে নিহতদের স্মরণে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য প্রদর্শন করতে বাইরে বের হয়েছেন। তাই বিকেল পাঁচটার দিকে আমি আমার মেয়ে মিশেলকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম বেদনার্ত প্যারিসের বাস্তব রূপ পর্যবেক্ষণের জন্য। ঘর থেকে বেরিয়েই মনমাদে যেতেই দেখা মিলল পুলিশের বিশেষ ফোর্স জনদারমোরীর (Gendarmerie) সতর্ক প্রহরা। যেন প্রতি মুহূর্তই তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সন্ত্রাসীর বক্ষ ভেদ করার জন্য সদা প্রস্তুত। পর্যটকদের আনাগোনা ও পথশিল্পীদের সংগীত মূর্ছনায় মুখরিত প্রাণোচ্ছল এলাকাটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক প্রহরায় এক যুদ্ধক্ষেত্রের রূপ নিয়েছে।

হামলার পর প্যারিসের একটি এলাকা
হামলার পর প্যারিসের একটি এলাকা

অভ্যর (Anvers) থেকে ৩০ নম্বর বাসে চড়ে রওনা দিলাম আইফেল টাওয়ারের উদ্দেশে। রোববারে সাপ্তাহিক ছুটির কারণে এখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ভিড় কম থাকে। কিন্তু এ দিন অস্বাভাবিক যাত্রীশূন্যতা মনে হলো। বাসের মধ্যে চার পাঁচজনের যে সহযাত্রী পেলাম তাদের মধ্যে লক্ষ্য করলাম গভীর নীরবতা। প্যারিসের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে উঠলে যাত্রীদের মধ্যে যে ব্যাপারগুলো সহজেই চোখে পড়ে তা হলো কেউ হেডফোন দিয়ে গান শুনছে, কেউ বই পড়ছে, কেউ কাউকে বিরক্তিকর কোনো কিছু না করে সুসভ্য মানুষের মতো নীরবে বসে আছে। যা নীরব প্রাণচাঞ্চল্য আবহের সৃষ্টি করে। কিন্তু এদিন মনে হলো বাসের মধ্যে এক দারুণ বিষাদের পরিবেশ তৈরি হয়ে আছে।
সপ্তাহের প্রতি শনিবার ও রোববার ছুটির দিনগুলোতে এখানকার বার রেস্তোরাঁগুলো আড্ডায় সরগরম থাকে। কিন্তু এ দিন প্রাত্যহিক দিনের চিরচেনা প্যারিসকে একেবারের অচেনা মনে হচ্ছিল। অধিকাংশ রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ। চলার পথে দু-চারটি যা চোখে পড়ল সেখানে সরকারি নির্দেশে আড্ডা বন্ধ রাখা হয়েছে। ভেতরের মৃদুমন্দ আলোয় দেখতে পেলাম কিছু মানুষ। জনমানবহীন রাস্তার এমন দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল, গভীর বন বা বিরাণ ভূমির পথ দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ চোখে পড়া কুপি জ্বালানো পুরোনো পানশালা যেন। আইফেল টাওয়ারে পৌঁছানোর পর দেখলাম টাওয়ারের সামনে পানির ফোয়ারাগুলো আগের মতোই ক্ষিপ্র গতিবেগে জলের ধারা প্রবাহিত করছে, কিন্তু এই সৌন্দর্য উপভোগের জন্য সৌন্দর্যপিপাসুদের ভিড় নেই। নিরাপত্তাজনিত কারণে আইফেল টাওয়ারের বিরামহীন ছুটে চলা লিফটগুলোকে অনির্দিষ্ট দিনের জন্য অবসর দেওয়া হয়েছে। সেন নদীর বুকে ভেসে বেড়ানো প্রমোদতরীগুলো ভ্রমণার্থীদের অভাবে নিজ নিজ ঘাটে নোঙর করে আছে।

হামলার পর প্যারিসের একটি এলাকা
হামলার পর প্যারিসের একটি এলাকা

ফিরতি বাসে বাসায় ফেরার পথে চোখে পড়ল প্যারিসের জনপ্রিয় অ্যাভিনিউ ও অভিজাত এলাকাগুলোতে ক্রিসমাস ও নিউ ইয়ার উদ্‌যাপনের বাহারী আলোকসজ্জার বৈচিত্র্যময় প্রতিকৃতিগুলো রাস্তার পাশ দিয়ে অবস্থান নিয়ে উৎসব আনন্দ দেবার জন্য ক্রমাগত জ্বলছে আর নিভছে। কিন্তু বিষাদের এমন দিনে উৎসব আনন্দের আলোকসজ্জার সৌন্দর্য ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। তারুণ্যের আড্ডাস্থল অপেরাকে মনে হলো এক নিঝুম নিস্তব্ধতার চাদরে ঢাকা পড়েছে।
এই রোমান্টিক নগরীতে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে এলেও জনমনে রয়েছে সংশয়। হয়তো খুব দ্রুতই ভয় ও সংশয়ের প্রভাব কাটিয়ে আবার প্যারিস জেগে উঠবে তার স্বরূপে। সন্ত্রাস ও অপশক্তির নির্মূলের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর বৈচিত্র্যময় মানুষের বসবাসের এই নগরী আরও বেশি মানবতার চর্চায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে, এটাই প্রত্যাশা।