নিজেকে সময় দিন
সেদিন আমার এক ডাক্তার বান্ধবী প্রশ্ন করছিল, মেডিটেশনে আমি কেন, কীভাবে আসলাম? এই উত্তরটা ঠিক আমি নিজেও জানি না। ওকে বললাম, নিজের অজান্তেই সব সময় একটা স্পিরিচুয়াল স্পিরিটের সঙ্গে সংযোগ ছিল, যা আমি কখনো বন্ধ করিনি। সেটা এসেছে পারিবারিক শিক্ষা থেকেই। বলা যায়, আমার নানির কাছ থেকে বেশি পেয়েছি, যা দেখেছি তা শিখেছি। এটাই হচ্ছে পরিবেশগত ভাইব্রেশন, যাকে বলা যায় বাতাবরণ। মার্কিনরা বলে, ‘তোমার তখনই একজন ভালো শিক্ষকের সঙ্গে পরিচয় হবে, যখন তোমার প্রয়োজন।
‘আপনার ভেতরে, মনের তলদেশে আপনার মধ্যে, এমন জায়গায় যেখানে আপনি সবই জানেন, সেখানে আগুন, একটি আধ্যাত্মিক আগুন। এটি আপনার অনুপ্রেরণার উৎস। এটি জ্ঞানের আগুন, আপনার মধ্যে গভীর মন, চর্মের মতো জ্বলন্ত, আপনার ত্রুটিগুলো এবং ব্যথা গ্রাস করে, আপনাকে শুদ্ধ করে, আশীর্বাদ করে, আপনাকে পরিচালনা করে।’—এটি হলো আধ্যাত্মবাদের আগুন। সম্ভবত এ আগুনই আমার কাছে ছিল। কিন্তু আমি একে চিনতাম না, জানতাম না। একে চিনব কীভাবে, নিজেকেই তো জানতাম না। মানবপ্রেমে নিজেকে পুড়িয়েছি। কেঁদে কেঁদে সে আগুন নিভিয়েছি। জীবন অনেক দিয়েছে, অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। তারপর অনেক পাওয়ার পরও মনে হলো কী যেন নেই।
সেই কী যে কি! আমি নিজেই তো নিজেকে জানি না। মন যা চায়, তা হয় না। তখন আবার পুড়েছি মনের আগুনে। এ মনকে শান্ত রাখা কঠিন কাজ। সেই কঠিন কাজটা নিজের অজান্তে কখন জানি সহজ হতে শুরু করল। অভিযোগ আমার কোনো কালেই ছিল না। এ জন্য আশপাশের মানুষ দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে এসে মানুষ টাকা-পয়সা উপার্জন করে, ক্যারিয়ার গড়ে। সবার একই চিন্তা ‘সপ্তাহে কত ডলার আয় করছি?। চিন্তা হবেই তো, এটি ছাড়া যে জীবন চলে না।
আমি আবিষ্কার করলাম, আমার অর্থের প্রতি স্পৃহা কমে যাচ্ছে। বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম যতটুকু না হলে নয়, ততটুকুর বাইরে যেতে পারিনি। কিছু একটা দেখার ভাবনা সমানে নিজেকে তাড়িত করেছে। যার ঠিকানা আকাশে-বাতাসে, সূর্যের আলো-আঁধারিতে, পূর্ণিমার চাঁদে। অমাবস্যার অন্ধকারে। পাহাড়ে-পর্বতে খুঁজেছি মনে মনে। নারী হয়ে জন্মাবার সীমাবদ্ধতা এখানেই। মন চাইলেই বোদ্ধা হওয়া যায় না। চাইলেই আঁধারে পা রাখা যায় না। চাইলেই গুরু ভেবে কারও সঙ্গী হওয়া যায় না। তবে সময় বদলেছে। জয় শেঠী সব সময় বলেন, ‘live like a monk’ মানে এক সন্ন্যাসীর মতো জীবনযাপন করো। করপোরেট দৌড় আর আধ্যাত্মিক জীবন দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত। কিন্তু বিশ্বের সব মেধাবী এখন আবেগীয় নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। সেদিন গুগল টকে বক্তারা বললেন, ২০৫০ সালে ইয়াং জেনারেশন ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সের প্রতি ঝুঁকবে।
আধুনিক জীবনের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সংযুক্তি ঘটিয়েছেন সাধ গুরু। তিনি বললেন, ওনার এক প্রাণবন্ত মাসির জীবন যখন সবকিছু প্রাপ্তির শেষে ঝরে গেল, তখন তিনি আবিষ্কার করলেন মনস্তত্ত্ব আর দেহতত্ত্বের মাঝখানে মানুষের একটা কিছু থাকা প্রয়োজন, যাতে সে দিন শেষে নিজেকে শেষ বলে না ভাবে। জীবনে প্রয়োজন এক বিন্দু স্পিরিচুয়াল সম্পর্ক। সেটার জন্যই তিনি ঈশা ক্রিয়া নামে একটি ধ্যান তৈরি করেন। যা বলছে, ‘I am not a body, I am not a mind’। পৃথিবীজুড়ে ১০ মিলিয়ন মানুষ এটি অনুশীলন করে। আমাদের এই আত্মা যখন এই বার্তা গ্রহণ করছে, তখন প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ঊর্ধ্বে সব অবস্থান করছে, যা মানুষকে অন্য রকম প্রশান্তি দেয়। ঊর্মিকে (অকালে ঝরে যাওয়া আমার বোনের মেয়ে) হারানোর পর এটি করে আমিও বের হয়ে এসেছিলাম এক কঠিন পরিস্থিতি থেকে।
মানুষের জীবনে যখন সমস্যা আসে, পৃথিবীতে মানুষ তখন ফেরেশতা খোঁজে। কোনো ফেরেশতা আসবে, সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। আরেক হলো, মানুষ তুমি নিজেই ফেরেশতা হয়ে যাও। ফেরেশতা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন তার চেয়ে সহজ নিজে বনে যাওয়া। ফেরেশতা মানে এনজেল। আমরা জানি এনজেল উড়ে। তেমন উড়তে পারা। উড়া তখনই সম্ভব, যখন আপনি নিজেকে হালকা রাখতে পারবেন। মন থেকে ভারী পাথর সরিয়ে ফেলতে পারবেন। যাকে ইংরেজিতে বলে ‘light feelings’। স্পিরিচুয়ালিটি বলে ফেরেশতা বনে যাও। এর জন্য প্রয়োজন মনের পরিশুদ্ধতা। কী কী আমাদের মনকে ভারী করে, তা চেক করা প্রয়োজন। নিজেকে হালকা রাখতে পারলে দেখা যাবে এনজেল অফিস করছে, এনজেল রোগী দেখছে, এনজেল বাজার করছে। এনজেল সব করছে। মনের বিশুদ্ধতার জন্য কারও প্রতি বিদ্বেষমূলক চিন্তা থেকে দূরে থাকতে হবে। সত্য-সুন্দর এটিই স্পিরিচুয়ালিটি। মানুষ যখন সত্যের হাত ধরে হাঁটতে শুরু করে, তখন সমস্যা আপনা-আপনি কমে যায়। এ জন্য হয়তো আমাদের বন্দী জীবন এসেছে। আমরা সত্য থেকে বহু দূর ছিটকে পড়েছি।
বহু বছর পর নিজেকে পরিপূর্ণভাবে দেখার ইচ্ছা জাগল। সেই ইচ্ছাই একটু একটু করে বদলে দিয়েছে আমাকে। মনে হয়, কত মিথ্যা এক পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আছি। যখন মার্কেটিংয়ে এমবিএ করি, তখন মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির মার্কেটিংয়ের শিক্ষক তানভির স্যার একদিন কথা প্রসঙ্গেই আলোচনা করেছিলেন, মিস ম্যানেজমেন্ট। নাহ, কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়, মানব জীবনের মিস ম্যানেজমেন্ট নিয়েই কথা হয়েছিল। সেটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। ডাক্তার বন্ধুকে এটিও ব্যাখ্যা করলাম। সে আবার এটির ভিডিও বানানোর অনুরোধ করল। দূরে দাঁড়িয়ে থেকে আজ যখন দেখি, তখন মনে হয় বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে এই মিস ম্যানেজমেন্ট কাজ করে।
আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাই, তখন আমার আব্বা-আম্মা কেউ এই পৃথিবীতে নেই। ভাইবোন যে যার মতো তাদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের সংসারে অভাব-অনটনে ভরা। এমতাবস্থায় আমার ঢাকায় পড়তে যাওয়াটা যুক্তিসংগত ছিল না। আমি ঠিক জানি না, আমার বড় ভাই এটি অ্যাপ্রিশিয়েট করেছেন কি না। একটু অন্য ধরনের ছিলেন, সম্ভবত নারাজও। আমি ছোট ভাই কামরানের কিছুটা সাপোর্ট নিয়েই বলা যায় একা পথ চলতে শুরু করলাম। সে পথ সহজ ছিল না। আমি কিছুই চিনি না। কিন্তু আমি ঢাকায় গেলাম, পড়াশোনা শুরু করলাম। ছোটবেলা থেকেই যে সব ভালো অভ্যাস ছিল, আমি সেগুলো কখনোই ছাড়িনি।
নানির কাছ থেকেই শিখেছিলাম শেষ রাতে উঠে আধ্যাত্মিক পাঠ, যা ছিল আমার দিনের প্রথম কাজ। রাজধানী শহরের আধুনিকতা কখন আমার পারিবারিক শিক্ষাকে মুছে দেয়নি। নানির শিক্ষা আমাকে গাইড করত। এখন বুঝি, এটি মানরজীবনে খুব প্রয়োজন। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ, সেটিকে সঙ্গে নিয়েই আমি চলেছি। আমার আধ্যাত্মিক মন শেষ রাতে ঘুমাতে দিত না। আমার সাজগোজ ও চালচলনের সঙ্গে হয়তো এই বৈশিষ্ট্যগুলো ঠিক মানায় না। সে জন্য আমার রুমমেট একদিন বলেছিল, ‘আপা আপনাকে দেখে কেউ তো হিসাব মিলাতে পারবে না’। জীবনের হিসাব মিলুক বা না মিলুক, আমি আমাকে ধরে রাখতে পেরেছি দৃঢ়ভাবে। ঝড়ে ভেঙে পড়িনি, নদীর মতো নাম হলেও গতিহারা হইনি।
আজ হঠাৎ এত সব ভাবনার কারণ, ডাক্তার বন্ধুকে এই কাহিনিটুকু বলতে বলতে বললাম। এটিই হয়তো সাহায্য করেছে একাকী পথ চলতে। জ্ঞান এটাই বলে, প্রতিটি মানুষের জীবনে আধ্যাত্মিক বিকাশ থাকা প্রয়োজন। আমি যে জিমে যাই, প্রতি ২০ মিনিট অন্তর একটা ঘোষণা দেয়, আগামী এক মাস মেডিটেশন ফ্রি। তারপর তো অবশ্যই তারা একটা ভালো অঙ্ক পাশে বসাবে। জিমে গিয়ে শরীর যেমন ঠিক রাখতে হয়, তেমনি ইমোশনাল ইমিউন সিস্টেম বাড়ানোর জন্য হলেও মেডিটেশন করতে হয়। মার্কিনদের অনেকেই এ ব্যাপারে সচেতন। আমার ডাক্তার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কী বলো রোগীদের? বলল, না এসব এখানে তেমন সাধারণ হয়ে ওঠেনি এখনো। তবে কোয়ান্টামে কিছু মানুষ সংযুক্ত হচ্ছে ইদানীং। মেডিটেশন শারীরিক মানসিক দুটি অবস্থানেই শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। শেষ কথা নিজেকে সময় দিন।