নিউইয়র্কে ব্লক পার্টি

কুইন্স ভিলেজে আয়োজিত ব্লক পার্টিতে অতিথিরা। ছবি: প্রথম আলো
কুইন্স ভিলেজে আয়োজিত ব্লক পার্টিতে অতিথিরা। ছবি: প্রথম আলো

ঈদের দিনই শরিফ ভাই বলেছিলেন, ‘আমাদের এখানে ব্লক পার্টি আছে ২৫ আগস্ট। তোমরা সবাই আসবে।’
ইতিবাচক সাড়া দিয়ে জানতে চাই, ‘ব্লক পার্টিটা কী?’
জানা হয়ে যায়।
শহর তো পরিকল্পিতভাবে গড়া। ব্লকে ব্লকে বিভক্ত। অ্যাভিনিউ আর স্ট্রিটের নাম বললেই বোঝা যায় গন্তব্য কোথায়। আর এখন যে যুগ এসেছে, গাড়িতে জিপিএস লাগিয়ে দিলে ও-ই তো পৌঁছে দেবে দোরগোড়ায়। তাই আপনার আগে থেকে জানা থাকুক আর না-ই থাকুক, প্রতিটি ব্লকই আসলে আপনি চেনেন। ঠিকানা থাকলেই আপনি পৌঁছে যাবেন নিউইয়র্কের যেকোনো জায়গায়।
কোনো ব্লকের মানুষেরা নিজেরা একসঙ্গে যে পার্টি করেন, সেটাই ব্লক পার্টি।
আরও একটু বুঝিয়ে বলি, যে ব্লকে বসবাস করছেন, সে ব্লকের সবাই মিলে ঠিক করবেন, একটি দিন হবে তাদের। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি পেলে সেদিন ব্লকের রাস্তা দুদিক থেকেই বন্ধ থাকবে। গাড়িঘোড়া চলাচল থাকবে না। সবাই বাড়ির বাইরে নিয়ে আসবে চেয়ার টেবিল। সেখানে থাকবে খাদ্য, পানীয়। বন্ধুবান্ধব আসবে। পার্টি চলবে দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত।
এই পার্টি সংগঠিত করার জন্য ব্লকের কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী লাগবে, যারা ঠিক করবে, এখানে কী কী হবে। কোন নোটিশ লাগাতে হবে। কোন খেলার আয়োজন করা হবে। কোন গান বাজবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রথম মহাযুদ্ধের পর নিজের ব্লকের সেনা সদস্যদের অভিবাদন জানানোর জন্য এই নিউইয়র্কে ব্লক পার্টি করা হয়েছিল। আনন্দে নেচে গেয়ে ছিল সেই উদ্‌যাপন। পুরো ব্লকের মানুষ ভেঙে পড়েছিল, নেমে এসেছিল রাস্তায়। দেশাত্মবোধক গানে গানে চলেছিল সে পার্টি। সেই ঐতিহ্যকে মনে রেখেই এখনো এখানে ব্লক পার্টির আয়োজন করা হয়। মূলত স্বাধীনতা দিবস কিংবা মেমোরিয়াল ডে উপলক্ষে এই পার্টি হয়। তবে যেকোনো ব্লকই কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে বছরের যেকোনো সময় এই পার্টি করতে পারেন। শরিফ ভাইদের ব্লক ঠিক করেছিল আগস্টের শেষে এই পার্টি করবে।

বাহ! এ তো দারুণ ব্যাপার! কুইন্স ভিলেজের ৮৯ অ্যাভিনিউ আর ২৩৭ স্ট্রিট-এর এই ব্লকটিতে আমরা গেলাম বিকেল পাঁচটার দিকে। দেখলাম, গাড়ি আড়াআড়ি রেখে দুদিকের রাস্তা বন্ধ করা হয়েছে। ২৩৭ স্ট্রিটে আজ গাড়ি ঢোকা বন্ধ।
নিজের বাড়ির সামনের জায়গাটায় সবাই টেবিল নিয়ে বসে পড়েছেন। সবুজ ছাতার নিচে বসেছে শরিফ ভাইদের টেবিল। একটু ভেতরে বারবিকিউ তৈরি করছেন শরিফ ভাই। একই সঙ্গে তৈরি হচ্ছে বার্গারের প্যাটি, সসেজ, চিকেন ফ্রাই...তৈরি করা আছে কেক, ভুট্টা, সালাদসহ নানা খাদ্য। নানা ধরনের কোমল পানীয়।
আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম, অন্য বাড়িগুলোর সামনেও খাবারের আয়োজন। এক এক বাড়িতে একেক রকম।
সব বাড়ির শিশুদের জন্য লাফানোর একটা ব্যবস্থা হয়েছে। সেখানে হার না মানা শক্তি নিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে শিশুরা। ব্লকের সবাই যে যার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত, কিন্তু শিশুরাই যেন তৈরি করল সাম্যবাদ। সব বাড়ির শিশুরা মিলে মিশে লাফাতে থাকল মনের আনন্দে। সেখানেই ফুর্তিটা হলো সবচেয়ে বেশি।
শরিফ ভাইয়ের বার্গার প্যাটিগুলো ভাজা হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে যার মতো লেটুস পাতা, মেয়োনিজ, টমেটো আর বান রুটি দিয়ে বানিয়ে ফেলল বার্গার। কেউ কেউ যোগ করল টমেটো কেচাপ কিংবা মাস্টার্ড। বেবি চিকেন গ্রিল করার পর ভরে ওঠে লোহার পাতিল। সেগুলোও আস্তে আস্তে শেষ হতে থাকে। এরপর আসে বিফ শাসলিক। এ রকম একটার পর একটা খাদ্য তৈরি হয়ে পূর্ণ করতে থাকে টেবিল। যারা অতিথি, তারাও কেউ খালি হাতে আসেননি। কেউ নিয়ে এসেছেন পাস্তা, কেউ কেক, কেউ ফল। কোমল পানীয় শেষ হলে বাড়ি থেকে ঠান্ডা পানীয় আসতে থাকে। পেপসি, কোক, ফানটা, সেভেন আপের পাশাপাশি থাকে আদা পানি (জিঞ্জার এইল)। এই আদা পানির প্রতিই মানুষের পক্ষপাত দেখলাম। যে কটি বাড়ির মানুষদের চিনলাম, তারা হলো দু ঘর ফিলিপিনো, একঘর আইরিশ, দু ঘর লাতিন (এখানে বলে হিস্পানিক), এক ঘর পাকিস্তানি, দু ঘর ভারতীয়।

শরিফ ভাইয়ের সঙ্গে একটু কথা বলে নিই। বাড়ির পেছনে যে সবজি বাগান করেছেন, তা দেখাতে দেখাতে তিনি বলেন, ‘আমরা বহুদিন ধরে এই ব্লকে পার্টি করে আসছি।’ ‘সে তো বুঝলাম, কিন্তু এখানে দেখছি, কেউ অন্য কারও টেবিলে আসছে না!’ ‘হ্যাঁ, এটা ঠিক বলেছ। লাফানো আর নাচ ছাড়া কেউ এক হয় না। বাঙালিরা নাচে না বলে সেখানেও উৎসাহ কম।’
‘কেউই কারও টেবিলে আসে না?’
‘আসলে সবাই নিজেদের বন্ধুদের দাওয়াত করে। বন্ধুদের সঙ্গেই গল্প, আড্ডা দিয়ে সময় কাটায়। তারপরও কখনো কখনো এক এক টেবিলে যাওয়া হয়।’
রাস্তার ঠিক মাঝখানে ছিল গানের ব্যবস্থা। উৎসাহী তরুণেরা সেখানে নানা ধরনের গান বাজিয়ে চলেছিল। স্প্যানিশ, আফ্রিকান ও ভারতীয় গান শুনতে পেলাম। একটা সময় একদল নারী (আশ্চর্য, একজন পুরুষও যোগ দিল না নাচে) নেমে গেল রাস্তায়, শুরু কর নাচ। বোঝা গেল এই নাচের জন্য পূর্বপ্রস্তুতি ছিল। মানে গানটাই এমন যে গানের কথার সঙ্গে সঙ্গে শরীর সঞ্চালন করতে হয়। প্রথম গানটিতে ছিল নাচেরই কিছু ইনস্ট্রাকশন। সুরে সুরে বলা হচ্ছে, বাঁ পা বাড়াও। ডান পা বাড়াও। ডাইনে ঘোরো। ছোট্ট লাফ দাও। হাঁটু ধরে কোমর দোলাও, এবার দাও তালি ইত্যাদি ইত্যাদি। হঠাৎ করেই পুরো জায়গাটায় একটা ছন্দে দুলে উঠল। সব বাড়ির মানুষই উপভোগ করতে থাকলেন এই নাচ। নাচে যোগ দেওয়া নানা বয়সী নারীদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট মেয়েটার বয়স তিনের বেশি হবে না। এই তিন বছুরে কিছুক্ষণ পর যে নাচ দেখাল, তা কখনোই ভুলব না। সবাই আরও দুটি বা তিনটি নাচ নেচে যখন ক্লান্ত হয়ে ফিরে গেছে যে যার টেবিলে, তখনো ওই ছোট্ট মেয়েটা নেচেই চলেছে। মোট তিন ভাষার তিন গানের সঙ্গে যেভাবে নাচল মেয়েটা, তা অবিশ্বাস্য! ওর রক্তের মধ্যেই যেন নাচ আছে।

দল বেঁধে মেয়েরা যে নাচগুলো নেচেছিল, তার আরেকটিও চোখে লেগে আছে। মিউজিক শুরু হতেই যারা নাচটি জানে, তাদের মধ্যে উৎসাহের শেষ নেই। যারা জানে না, তাদেরও শিখিয়ে দেওয়া হলো। এটা হচ্ছে গানের তালে তালে হাত দুটো মাথা, বুক, কোমর ছোঁবে, তারপর একটা নাচের ভঙ্গি করে অন্যপাশে ঘুরে যাবে সবাই, তারপর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকবে।

সময় যত বয়ে যায়, পার্টির রংও বদলায়। এক সময় দেখা যায়, তরুণেরা একটু সরে গেছে মূল টেবিল থেকে। তারা তাদের পছন্দমতো গল্প করছে। মূল টেবিলে বসে আছেন বর্ষীয়ানরা। তাঁদের গল্পের বিষয় আলাদা। অন্য বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি, সেখানেও একই অবস্থা। শুধু এক বাবা আর মেয়ে আমার চোখকে আরাম দিয়ে যেতে থাকে। দীর্ঘদেহী এই বাবা তার তিন বছরের মেয়েটাকে যেভাবে আগলে রাখছিলেন, তা বলে বোঝানো যাবে না। পুরো সময়টাতেই বাচ্চাটা হয় সাইকেল চালিয়ে, নয়তো দৌড়ে, নয়তো লাফিয়ে ব্যতিব্যস্ত রাখছিল বাবাকে। অসীম ধৈর্য নিয়ে এই বাবা তা সামলে যাচ্ছিলেন। জিজ্ঞেস করা হয়নি, কোন দেশ থেকে আসা অভিবাসী তিনি। কিন্তু বাবা-মেয়ের এই ভালোবাসার কথা ভুলব না কখনো।
খুব ব্যস্ত সময় কাটে নিউইয়র্কবাসীর। সারা সপ্তাহ কাজের পর ছুটির দিনগুলোকে কাজে লাগাতে চান তাঁরা। একটা ভালো অবকাশ পেলে তা ছাড়তে চান না। ব্লক পার্টি সে রকমই একটি অবকাশ। একটি দিন রান্না, খাওয়া, নাচ, গানসহ নানাভাবে জমজমাট হয়ে ওঠে।
ফেরার সময়ও বেজে চলছিল গান। আর ওই যে শিশুদের লাফ ঝাঁপ, চলছিল তাও।