নিউইয়র্ক কনস্যুলেট ও বাংলাদেশি চিকিৎসকদের ভূমিকা

করোনাভাইরাস
প্রতীকী ছবি

করোনা মহামারির শুরু থেকে পুরো পৃথিবী যখন দিশেহারা, নিউইয়র্ক শহর তখন হয়ে উঠল মৃত্যুপুরী। বাঙালিরাও দুর্যোগে দিশেহারা। হাসপাতালে জায়গা নেই। কেউ জানে না কীভাবে চিকিৎসা হবে। মৃত্যুর মিছিলে স্বজনের সারি। লাশ দাফন করতে যাওয়া তো দূরের কথা, স্বজনকে শেষ দেখারও কারও সুযোগ নেই। সেই ভয়াবহ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বাঙালি আমেরিকান চিকিৎসক শুরু থেকেই মানবসেবায় অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন।

বিপদের ঝুঁকির কথা জেনেও হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের কাছ থেকে সেবা করে গেছেন। পরিবারে সংক্রমণ এড়াতে বাড়িতে থেকেও স্বজনদের কাছ থেকে দিনের পর দিন দূরে অবস্থান করেছেন। অনেকে করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন, অনেকের মৃত্যুও হয়েছে।

ঠিক সেই সময় নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেট একটি বিরাট উদ্যোগ গ্রহণ করে। নিউইয়র্কের কনসাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুন্নেসা নিজেও চিকিৎসক। দূরদর্শিতার কারণেই আমার কাছে ফোন করে সাহায্য চাইলেন। এ ব্যাপারে কথা বলে কয়েকজন চিকিৎসককে রাজি করালাম।

মার্কিন বাংলাদেশি চিকিৎসক সমাজ করোনার প্রথম দিক থেকে শুরু করে এখনো অনেক অবদান রেখে চলেছেন। জুম মিটিং করে বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকদের সঙ্গে করোনা চিকিৎসার প্রণালি, আইসিইউতে প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদির ওপর নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা এবং নতুন নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি আলোচনা করেন। তাঁরা করোনার ওপর দ্রুত গতিতে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা ও বই ও প্রকাশনা করেছেন। নিউইয়র্কের চিকিৎসক মাসুদুল হাসান করোনা চিকিৎসায় বাংলাদেশে আইভারমেকটিন নামক ওষুধের প্রবর্তন করেন।

নিজের রেজিস্টার্ড রোগী ছাড়া অন্য রোগীকে ফোনে চিকিৎসা এ দেশে আইনগত করা যায় কিনা কেউ জানে না। তবুও ফিলাডেলফিয়া থেকে আমি নিজে আর নিউইয়র্ক থেকে চিকিৎসক জিয়াউর রহমান, মহম্মদ আলম, প্রতাপ দাস ও ইউসুফ আল মামুন এই কাজ করতে রাজি হলেন।

এই সেবা দেওয়ার জন্য কনস্যুলেট অফিসের ওয়েবসাইটে একটি হটলাইন খোলা হলো। এই হটলাইনের খবর প্রথম আলো উত্তর আমেরিকাসহ সব সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হলো। এরপর নানা ধরনের রোগীর দিন-রাত ফোন আসতে থাকল। নিজেরা হাসপাতালে রোগীদের সেবা দেওয়ার পাশাপাশি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত থাকার পরও ফোনে আমাদের সেবা দেওয়া অব্যাহত থাকল।

কিছুদিন পর ডা. জিয়াউর রহমান নিজেও করোনায় সংক্রমিত হয়ে শয্যাশায়ী হলেন। নিজে করোনায় সংক্রমিত হয়েও ফোনে তিনি চিকিৎসা সেবা দেওয়া অব্যাহত রাখলেন। তাঁর বড় ভাই ফার্মাসিস্ট হাসপাতালে করোনার সঙ্গে লড়াই করে প্রাণ হারালেন।

কনসাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুন্নেসা আবার ফোন করলেন। করোনায় যুক্তরাষ্ট্রে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু এতে বাঁধ সাধল করোনা সার্টিফিকেট নিয়ে। এই সার্টিফিকেট না পেলে, তাঁরা প্লেনে উঠতে পারবেন না। চিকিৎসকদের অফিস বন্ধ, দ্রুত করোনা টেস্টেরও কোনো ব্যবস্থা নেই।

এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে জানাল, টেলিমেডিসিন বা ফোনে একজন চিকিৎসকের কাছ থেকে করোনার উপসর্গ নেই মর্মে সার্টিফিকেট নিলে তাঁরা প্লেনে উঠতে পারবেন।

যুক্তরাষ্ট্রের আইনে চিকিৎসকেরা এভাবে পরীক্ষা চাড়াই সার্টিফিকেট দিলে লাইসেন্স বাতিল হবে কিনা, কেউ জানে না। আমি এক এক করে ফোন করতে থাকলাম। স্পষ্ট জানালাম, পেশাগত ঝুঁকি আছে, তবু মানুষের বিপদে এই কাজ করতে তাঁরা রাজি আছেন কিনা! কিন্তু অধিকাংশ চিকিৎসকই ঝুঁকি জেনেও রাজি হলেন।

দুই দফায় প্রায় দুই শর মতো আটকে পড়া বাংলাদেশি নাগরিকদের প্লেনে ওঠার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সাক্ষাৎকার নিয়ে ইমেইলে সার্টিফিকেট পাঠানো হলো।

এ ব্যাপারে যারা নিজেদের ব্যস্ত সময়ে নিজ দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসা থেকে ঝুঁকি উপেক্ষা করে আমার সঙ্গে এসেছিলেন তাঁদের শ্রদ্ধা জানাই।

আমার সঙ্গে যারা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চিকিৎসকেরা হলেন—নিউইয়র্ক থেকে মোহাম্মাদ আলম, শিল্পী ফেরদৌসী, ইউসুফ আল মামুন, প্রতাপ দাস, মাকসুদ

চৌধুরী, ফ্লোরিডা থেকে বাসার আতিকুজ্জামান, বশীর আহমেদ, নর্থ ক্যারোলাইনা থেকে রিয়াজ চৌধুরী, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ইকবাল মুনির, কেনটাকি থেকে আয়েশা শিকদার, মিশিগান থেকে নাজমুল হক ও মোতাহার আহমেদ, নেভাদা থেকে চৌধুরী হাফিজ আহসান, ইন্ডিয়ানা থেকে তাসবীরুল ইসলাম, মেরিল্যান্ড থেকে রফিক আহমেদ, বোস্টন থেকে ইসমত হাকিম প্রমুখ।

যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সরকারের কনস্যুলেট প্রবাসে দেশবাসীর সেবায় বিশাল উদাহরণ স্থাপন করেছে।

কনস্যুলেট জেনারেল সাদিয়া ফয়জুন্নেসা শুধু করোনার সময় চিকিৎসা ক্ষেত্রেই নয়, বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়াতে তিনি অনেক কিছুই করতে পেরেছেন। এর মধ্যে নিউইয়র্কের কুইন্স লাইব্রেরিতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন।

এ ছাড়া মার্কিন বাংলাদেশি চিকিৎসক সমাজ করোনার প্রথম দিক থেকে শুরু করে এখনো অনেক অবদান রেখে চলেছেন। জুম মিটিং করে বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকদের সঙ্গে করোনা চিকিৎসার প্রণালি, আইসিইউতে প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদির ওপর নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা এবং নতুন নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি আলোচনা করেন। তাঁরা করোনার ওপর দ্রুত গতিতে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা ও বই ও প্রকাশনা করেছেন। নিউইয়র্কের চিকিৎসক মাসুদুল হাসান করোনা চিকিৎসায় বাংলাদেশে আইভারমেকটিন নামক ওষুধের প্রবর্তন করেন।

এই সব চিকিৎসকদের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের মানুষ ও বাঙালি সংগঠন বিপন্ন মানুষের কাছে দাঁড়িয়েছেন। নিউইয়র্ক বাংলাদেশ সোসাইটি বহু মানুষের জন্য বিনা মূল্যে কবরস্থান দিয়েছে। অনেকে করোনায় সংক্রমিত পরিবারের কাছে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী পাঠিয়েছেন। সবগুলো গণমাধ্যমই জনকল্যাণে দারুণ ভূমিকা নিয়েছে।

সবার এই কর্মযোগ এক অনিশ্চিত সময়ে মানবতার এই অগ্নিপরীক্ষায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে আমাদের ইতিহাসে। এই স্মৃতিগুলো আমাদের শক্তি ও সম্মান জুগিয়ে সামনে চলার পাথেয় হতে পারে।