নারীদের কি সত্যিই আমরা সম্মান করি
পাড়ার ছেলেদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে আমার মা ১২-১৩ বছর বয়সে আলটিমেটাম দিয়েছিলেন, ‘পড়াশোনা ঠিকমতো না করলে বিয়ে দিয়ে দেব।’ হুঁশিয়ার করেছিলেন, এসব পাড়াতুতো ভাইদের দিকে যেন তাকিয়েও না দেখি, বরং পড়াশোনায় যেন ধ্যান দিই।
সেই বয়সে সেই ভয়ের চোটে পড়াশোনা বেছে নিয়েছিলাম! যে দেশে মানুষের মূল্য নেই, সেখানে আমরা সব দিবসই আড়ম্বরে পালন করি। নারী দিবসও! শুধু মানুষদের ভুলে যাই! নারীদের কি সত্যিই আমরা সম্মান করি?
আশা করি, পাড়াতুতো ভাইয়েরা ইভ টিজং বন্ধ করে মেয়েদের নিশ্বাস নিয়ে বাঁচতে দেবেন। অযথা মিসড কল বা উত্ত্যক্ত করতে কল করে বেড়াবেন না। ফেসবুক, মেসেঞ্জারে তাঁদের সঙ্গে অশালীন ব্যবহার করার আগে একটু ভেবে নেবেন।
এতটুকু করতে পারলে আপনার নিজের মেয়েও হয়তো ভালোভাবে বেঁচে থাকবে। আর একটা কথা, সংসারটা আপনারও, তাই ঘরের কাজে হাত লাগান। এতে সম্মান যাবে না, সোনার সংসার হবে।
ঘরে ঘরে শিক্ষিত মায়েরা যদি ছেলে-মেয়ের ভেদাভেদ না করে সবাইকে ঘরের কাজ করতে, রান্না করতে শেখান, তাহলে ছেলেমেয়েরা শিখবে পারবে—প্রতিটি কাজে কতটুকু শ্রম দিতে হয়।
পানিটা, খাবারটা এগিয়ে না দিয়ে তাদের নিজেদেরই কাজগুলো করে নিতে বলুন। ঘর, কাপড়চোপড় তাদের নিজেদের পরিপাটি করে রাখতে শেখান। লাভ? তারা স্বাবলম্বী হবে, কাজ করতে শিখবে, পরমুখাপেক্ষী হবে না।
নারী দিবস মানে এই না—আমার জন্য স্বামী চা বানাবে, রান্না করে খাবার পরিবেশন করবে। এর মানে এই যে তারা তাদের কাজটুকু করে নিয়ে আমাদের ওপর চাপ কমাবে।
এর মানে এই না, এদিনেই আমি শুধু সেজেগুজে বেগুনি শাড়ি পরে পুতুল সাজব। এর মানে এই না, এদিনেই শুধু পুরুষেরা মেয়েদের গায়ে হাত তোলা বন্ধ রাখবে। এর মানে এই না, এদিনেই নিপীড়ন বন্ধ থাকবে।
নারী দিবসের মানে এই হোক, প্রত্যেক পুরুষ শিখুক, জানুক—নারীদের সম্মানের সঙ্গে বাঁচার অধিকার আছে, ঠিক ততটাই যতটা তার। দিনটি প্রত্যেক নারীর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা, সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠুক। তাকে যেন ভয় পেতে না হয় বাসে কিংবা ভিড়ে অসুস্থ ছোঁয়ার। একাকী নিরাপদে ঘরে ফেরায় নারীর অনিশ্চয়তার ভয় নেই—এ কথাই যেন নারী দিবসে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উচ্চারিত হতে পারে।
যেন তাকে অস্বস্তি বোধ না করতে হয় পরনের জামার প্রতি স্তর ভেদ করা লোলুপ চাহনির জন্য। তাদের যেন অযথা হয়রানি না করা হয় বন্ধু, স্বামী বা আত্মীয়ের সঙ্গে বাইরে গেল বলে।
যেন ছেলেরা শেখে কারও দিকে তাকানোরও শিষ্টাচার আছে। নারীরা হাঁ করে দেখার বস্তু নয়। চিড়িয়া নই আমরা। বাসে, ঘাটে, মাঠে, ট্রেনে, কর্মক্ষেত্রে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক। প্রতিটি ঘরে নারীরা নিরাপদ থাকুক। ঘরগুলো থেকেই তাদের প্রতি করা বৈষম্যগুলো বন্ধ হোক। নাটক, সিনেমাগুলো বিশ্রীভাবে ইভ টিজিংয়ের প্রোমোট বন্ধ করুক ভালোবাসার নামে। নারীর প্রতি সহিংসতাকে নিরুৎসাহিত করা হোক প্রতিটি ক্ষেত্রে।
লেখক: চিকিৎসক