নানান আয়োজনে ডানেডিনে বর্ষবরণ
বাংলা নতুন বছরকে নানা আয়োজনে বরণ করেছেন নিউজিল্যান্ডের ডানেডিনে বসবাসরত বাংলাদেশিরা। ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএসএ) উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের অউসা ক্লাবস অ্যান্ড সোসাইটিস সেন্টারের ইভিশন লাউঞ্জে ডানেডিনে বসবাসরত বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণে এক আনন্দমুখর উৎসবের মধ্য দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। শিক্ষার্থীদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বৈশাখের লাল-সাদা রঙের বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নানা পোশাকে বর্ণিল সাজে সেজে এ আনন্দ উৎসবে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি যোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, চাকরিজীবীসহ নানান পেশার মানুষ ও তাদের পরিবারের সদস্যরা।
অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল বাংলাদেশি পান্তা-ইলিশসহ নানা পদের ভর্তায় সাজানো খাবার। জিলাপি, বাতাসা, গজা, পাটিসাপটা, মুখপাকন পিঠা ও পায়েসসহ নানা মিষ্টান্নে ইভিশন লাউঞ্জ হয়ে উঠেছিল একখণ্ড বাংলাদেশ। সঙ্গে ছিল নানা ধরনের প্রতিযোগিতা আর খেলার আয়োজন। এসব আয়োজন শুরু হয় নারীদের বালিশ-বদল খেলার মাধ্যমে। নানা মজার ক্ষণের জন্ম দিয়ে এই খেলায় বিজয়ী হন রোজী জাফরউল্লাহ। এরপর ছিল ব্যতিক্রমী উপস্থিত বক্তৃতা। যার শর্ত ছিল বাংলা ব্যতীত অন্য কোনো শব্দ ব্যবহার না করা। উৎসাহী অংশগ্রহণকারীগণ বিদেশি শব্দ ছাড়াই দীর্ঘক্ষণ বাংলায় কথা বলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। আবদুল মান্নান তার বক্তব্যে বিদেশি শব্দ হতে পারে বিবেচনায় নিউজিল্যান্ড শব্দটিও ব্যবহার করেননি। নাজমুল হোসেন পাত্রী হিসেবে পর্দানশিন ভাবিকে দেখতে যাওয়ার ঘটনা শুনিয়ে সবাইকে আমোদিত করেন।
অংশগ্রহণকারীদের আধিক্যে পুরুষদের মার্বেলসহ চামচ মুখে নিয়ে দৌড় (মার্বেল দৌড়) প্রতিযোগিতার জন্য দুবার হিটের আয়োজন করতে হয়। ফটোফিনিশে এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন আশিকুর রহমান। সবশেষে ছিল দুজনের দলভিত্তিক ‘বোঝাও-বোঝ’ নামের আনন্দদায়ী প্রতিযোগিতা। এখানে একজনকে একটি বিষয় জানানো হয়। তার দায়িত্ব হচ্ছে সেই বিষয় বা বক্তব্যের কোনো সমার্থক শব্দ ব্যবহার না করে তার দলের অন্য সদস্যকে বোঝানো। ইমরান খানের পরিচালনায় বাংলার নানান বাগধারা, স্মৃতিময় নানান বিষয় উপস্থাপিত হওয়ায় সবাই আগ্রহের সঙ্গে এই আয়োজনে সম্পৃক্ত হন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সম্মানিত শিক্ষক ড. আযম আলী ও ড. শ্যামল দাস এই খেলায় অংশগ্রহণ করে খেলাটিকে আরও উপভোগ্য করে তোলেন। সময় স্বল্পতায় এই আয়োজনেরও সমাপ্তি টানতে হয়।
সকল খেলা ও প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। অনুষ্ঠানের মূল উপস্থাপক ছিলেন সংগঠনের কোষাধ্যক্ষ তাজুল ইসলাম। সবাইকে উপস্থিতি, অংশগ্রহণ ও সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে এবং ভবিষ্যতে এমন আরও আয়োজনের আশাবাদ ব্যক্ত করে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন সংগঠনের সভাপতি ইমরান খান।
এমন আয়োজনের পেছনের গল্পটা বেশির ভাগ সময় অজানা থেকে যায়। উজ্জ্বল আলোর মাঝে যে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি সে আয়োজনের শুরুটা হয় প্রবাসী শিক্ষার্থীদের মন খারাপ করা অনুভবের মধ্য দিয়ে। একেকটা উৎসবের দিন এগিয়ে আসে আর মন ফিরে চায় ফেলে আসা স্বজন আর বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো পুরোনো সব আনন্দস্মৃতির দিকে। সেই উদাসী মনের কোণে জেগে ওঠে এমন আয়োজনের ভাবনা। তারা জানে দেশে থাকা পরিবার ও বন্ধুরাও জানতে চাইবে কী করলাম এমন দিনে। একটু কিছুর মধ্যে নিজেদের না জড়ালে দেশের মানুষদের জন্যও কষ্টকর। আয়োজন ছাড়া কাটালে এমন আনন্দের দিনগুলো বরং হয়ে ওঠে আরও বিষাদময়। সঙ্গে থাকে নিজের দেশ আর সংস্কৃতিকে অন্যদের মাঝে উপস্থাপনের সুযোগ।
কিন্তু প্রবাসে এমন আয়োজন সহজ নয়। বাংলাদেশের জাতীয় বা সাংস্কৃতিক দিনগুলো এ দেশের কর্মব্যস্তদিনেই পড়ে। কারও গবেষণা, কারও পরীক্ষা বা কারও অন্য কাজের মধ্য থেকে সময় বের করে নিতে হয়। অনুষ্ঠানের দিনেও অনেককেই যেতে হয় কাজে। এর মধ্যে দক্ষিণ গোলার্ধের নিউজিল্যান্ডে এখন শুরু হয়েছে শীতের আনাগোনা। গত সপ্তাহজুড়ে বাতাস আর বৃষ্টিতে জনজীবন জড়সড়। সূর্যের দেখা মিলছে না। তাই কাজের সমন্বয় করাটা মাঝে মাঝে কাজের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়ায়।
ডানেডিন শহরে বাংলাদেশি কোনো দোকান নেই। এমন আয়োজন তাই বাংলাদেশি স্বাদ ফেরাবার সুযোগও। কিন্তু এ শহরে ইলিশ শুধু নয় বাংলাদেশি কোনো মাছই পাওয়া যায় না। শাক বা সবজি নিউজিল্যান্ডের গ্রীষ্মের ফসল। তাই এ সবও এখন দুষ্প্রাপ্য। এ জন্য আরেক শহর থেকে আনাতে হলো ইলিশ মাছ। আলু-কুমড়া-ডাল-ডিমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ভর্তা-ভাজির আয়োজন। পিঠা পায়েসের জন্যও নানা উপকরণে থাকে ঘাটতি। আবার কারও কাছেই একসঙ্গে এতজনের রান্নার উপযোগী হাঁড়ি-কড়াই থাকে না। তাই রাঁধতে জানলেও নানা উদ্ভাবনী বুদ্ধির প্রয়োজন হয়। একেকটি পদ সবার জন্য বানানো তাই একেকটি আলাদা আলাদা গল্প।
ডানেডিনে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি নয়, তাই জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের ভাগ সবাইকেই নিতে হয়। যে রাঁধছে সে চুলও বাঁধছে। আবার বিদেশে থাকে বলেই শিক্ষার্থীরা ধনবান নয়। তাই খরচের হিসাবও শক্ত হাতে ব্যবস্থাপনা করা চাই। তাই কেউ সূর্য ওঠার আগেই হিমশীতল ভোরে যাচ্ছেন কৃষকদের বাজারে-কেউ আস্ত মাছ কিনে ছুরি-কাঁচি নিয়ে লেগে পড়ছেন কাটাকুটিতে। তারাই আবার কাগজ কেটে বাংলা অক্ষরে সাজাচ্ছেন ব্যানার, উপহার মুড়িয়ে দিচ্ছেন রঙিন কাগজে। এর মধ্য দিয়ে ব্যস্ততায় ভুলে থাকতে চাইছেন বন্ধুবান্ধব আর পরিবার থেকে দূরে থাকার বেদনা। তারপরও এই সব কাজের আয়োজনে তৈরি হচ্ছে আরেক রকমের বন্ধুত্ব-নতুন নতুন সব এগিয়ে চলার গল্প। এক সময় এই আয়োজনগুলোও হয়ে উঠবে একেবারে নিজের। এই সব পেছনের বিষাদের গল্প তখন হয়ে যাবে আনন্দ স্মৃতি। নতুন বছরে নতুন প্রেরণায় এমন আনন্দ আয়োজন আরও ব্যাপক পরিসরে আয়োজনের ভাবনা এখনই চলছে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি আরও উজ্জ্বল হয়ে ছড়িয়ে পড়বে দেশে-বিদেশে। এমন শপথে বাংলাদেশি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পথ নির্দেশনায় এগিয়ে চলছেন ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি প্রবাসী শিক্ষার্থীরা।
সাইফ আই খান: পিএইচডি শিক্ষার্থী, ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়, ডানেডিন, নিউজিল্যান্ড।