নাড়ির টান

আসলে মনটা অনেক খারাপ যাচ্ছে কিছুদিন থেকে৷ উচ্চশিক্ষার তাগিদে এর আগে ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত একটানা দেশের বাইরে ছিলাম৷ তারপর ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে আবার দেশের মায়া ত্যাগ করতে হয়৷ কারণ, মহানবী (সা.) বলেছেন, বিদ্যার্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীন দেশেও যাও; আজ সত্যি সত্যি আমি সেই সুদূর চীনে। আজ কেন জানি মনে হচ্ছে, এত দিন বাইরে থাকিনি কখনো, মা-বাবার জন্য, দেশের জন্য মনটা খারাপ লাগে। প্রিয় মানুষটির কথাও মনে পড়ে অনেক, আর বন্ধুদের কথা না-ই বললাম। গবেষণার ঝামেলা, খাবারের সমস্যা সঙ্গে আরও আছে দুই ঘণ্টা সময়ের ব্যবধান আর আমার ভুলোমনা হওয়ার কারণে সবার সঙ্গে ফোনে ঠিকমতো কথাও হয় না সব সময়। এতটাই দূরে আছি, মনকে এই প্রবোধটুকুও দিতে পারি না। সব ঝাপসা হয়ে আসছে, মাতৃভূমির মাটিতে জড়িয়ে যদি একটু কাঁদতে পারতাম, মা! আজ বেশ কয়েকবার করে শুনেছি, ভাইব ব্যান্ডের নষ্টালজিয়া শিরোনামের সেই গানটি: ‘কবে যাব ফিরে কবে যাব ফিরে বুড়িগঙ্গার তীরে আমার শীতলক্ষ্যার তীরে সাঁতার কেটে করব গোসল ঘোলা ঘোলা নীরে ...কবে যাবো ফিরে, কবে যাবো ফিরে....বাউণ্ডুলে হয়ে ঘুরতাম চকের থেকে বাড্ডা সংসদ মাঠ আর রমনা পার্কে দিতাম কত আড্ডা...ফুচকা পেঁয়াজু, ডালপুরি পোয়া মোয়া হায় ঝালমুড়ি আজও জিবে জল আসে যে সেসব স্মৃতি ঘিরে ...এইসব ইট পাথরের হিসাবের মধ্যে। মায়ের শুধু চোখের কোনটা ভিজে উঠে ধীরে...কবে যাব ফিরে, কবে যাব ফিরে...।’
আজ অনেক বেিশ আমার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ছে, আমি তখন সপ্তম শ্রেিণ শেষ করেছি। গ্রামে থাকি, গ্রামের নাম খোসঘর, কুমিল্লা জেলা শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে। বাবা তখন চাকরি করতেন উপজেলাতে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে। আমি পড়ি এক কিলোমিটার দূরে পাশের গ্রামের এক উচ্চবিদ্যালয়ে, সেটিই ছিল আশপাশের ভেতর সবচেয়ে ভালো উচ্চবিদ্যালয়ে। তখন আমার উচ্চবিদ্যালয়ের ফলাফল বোধ হয় একটু খারাপ ছিল, কিন্তু মা-বাবা স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্ন দেখলেন ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার, যা হয়তো অসম্ভব ছিল ওই গ্রামে থেকে। তিনি সাহস করলেন কুমিল্লা শহরের স্কুলে পড়াবেন আমাকে। কিন্তু আমার মামারা আমাকে তাঁদের কাছে নিয়ে গেলেন আর দিদি-মা আমার সব দায়িত্ব নিলেন, তারপর ভর্তি করিয়ে দিলেন ঢাকা শহরের অদূরবর্তী নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ উপশহরের এক বিখ্যাত উচ্চবিদ্যালয়ে।
মা-বাবার কাছে তখন গোটা পৃথিবী ছিলাম শুধুই আমি, আমার মাঝেই তাঁরা দেখতে চাইলেন আগামীকে। গ্রামের সমাজ খুব ভালো চোখে দেখেনি, ছেলেকে মামার বাড়িতে দিয়ে দেওয়াটা অনেকে বলেছিল রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ‘ছুটি’ নায়ক ফটিকের মতো নাকি আমার পরিণতি হতে পারে। গোপনে কটু কথাও হয়তো কম শুনতে হয়নি মা-বাবাকে। আর আমি? আমিও তখন মা-বাবার বিরুদ্ধে, আমার গ্রামই ভালো লাগে, শহরের ছোট্ট বাসায় খাঁচায় বন্দী পাখির মতো মনে হয় নিজেকে, রাতে ঘুমানোর সময় প্রায়ই প্রায়ই অনেক কান্না পেত। গ্রামের অপার স্বাধীনতা—মেঠো রাস্তায় ইচ্ছেমতো দৌড়ে বেড়ানো, ঘণ্টার পর ঘণ্টা পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি, দূরের খেত থেকে মটরশুঁটি-টমেটো চুরি করে চড়ুইভাতি খাওয়া, এত আনন্দ, এত রং কী করে ভুলি?

মামারা অনেক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন আমাকে নিয়ে। আমাকে নিয়ে মা-বাবা এবং দিদিমার পর সবচেয়ে বেিশ সংগ্রাম করেছেন আমার ছোট মামা। যদিও সব মামা আমাকে নিয়ে অনেক চিন্তা করতেন, তাঁদের মধ্যে ছোট মামা কখনো আমাকে বুঝতে দেননি, আমাকে অনেক বেিশ ভালোবাসেন তিনি। সব সময় আমাকে অনেক বেিশ শাসন করতেন। আজ বুঝতে পারি, ছোট মামা আমার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কত শাসন করেছেন, মামা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, প্রায় প্রতি সপ্তাহে বাসায় চলে আসতেন আমার পড়াশোনার কী অবস্থা তা দেখার জন্য; আবার মাঝেমধ্যে ছোট মামা আমাকে তাঁর হলে নিয়ে নিজের কাছে রাখতেন। তবুও এতটুকু আমি মাঝেমধ্যে নিজেকে খুব অসহায় মনে হতো। ছোটবেলায় অন্তর্মুখী ছিলাম বলে বন্ধুও জোটেনি খুব একটা। হু হু করে কাঁদতাম শুধু, ছোটবেলায় আমি অনেক কষ্টে কাটিয়েছি দিনগুলো।
মানুষ যখন অল্প অল্প করে জানতে থাকে, জ্ঞানের পরিধি যখন বাড়তে থাকে, আর তখন সে উপলব্ধি করতে থাকে, সে কতখানি ক্ষুদ্র, কারণ জ্ঞানের পিপাসা কখনো শেষ হওয়ার নয় যে! আমাদের দেশের অনেকের মনেই একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যুগ যুগ ধরে, চায়না উন্নত বিশ্বের সঙ্গে যায় না; কিন্তু আমার মনে হয় কথাটা ঠিক নয়। এখানে এসে দেখেছি, চীনারা লেখাপড়া, এমনকি কোনো ধরনের কাজের কোনো কিছুতেই ফাঁকি দেয় না। এ বছরই আমেরিকাকে পেছনে ফেলে ১ নম্বর অর্থনীতিক শক্তিশালী দেশে পরিণত হয়েছে চীন। এর কারণ খুঁজতে আমাকে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। আগে শুনেছিলাম, জাপানিরা কাজের ক্ষেত্রে কোনো ফাঁকি দেয় না। তাই যদি না হতো, কী করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রেশ কাটিয়ে, এমনকি এত প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে আজও জাপান বিশ্বের বুকে অন্যতম একটি অর্থনৈতিক পরাশক্তির দেশ। চীনারা কী পরিমাণ পরিশ্রমী জাতি, তা কাছে থেকে না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্টের। আমি মনেপ্রাণে চাই এবং বিশ্বাস করি, আমার সোনার বাংলার মানুষেরা একদিন এমন পরিশ্রমী হবে এবং আমাদের দেশটি একদিন বিশ্বের আদর্শ হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি পাবে।
যা হোক আমার সবকিছু ছিল একটা স্বপ্নকে ঘিরে, যে স্বপ্নের কেন্দ্রে ছিলাম আমি। আজ আমি বাংলাদেশের একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক কিন্তু গত বছর দেড় ধরে দেশের বাইরে আছি। চীনে আজ আমি একটা মর্যাদাপূর্ণ বৃত্তিতে পিএইচডি করছি৷ আমি জানি, আমি বুঝি, আমি অনুভব করি, এসব কিছুর পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা কার! সে অন্য কেউ নন, সে যে আমার মাতৃভূমি সোনার বাংলার। আমার মা-বাবা এখনো স্বপ্ন দেখেন, কারণ আমার পথচলা এখনো থামেনি, যেতে হবে আরও আরও অনেক দূর, আমার মা-বাবার ইচ্ছে তাঁদের ছোট্ট সেই ছেলেটি একদিন এ দেশের জন্য কিছু করবে। তোমার জন্য যে মহান শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা বুকের তাজা রক্ত দিয়েছিলেন, সেই দিন, যাঁদের রক্তের বিনিময়ে আজ দিতে পারছি মধুর সুরের মা ডাক, নিজেকে পরিচিত করে দিতে পারছি এক স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক হিসেবে। মা আমিও জানি, আমার প্রতিটি রক্তবিন্দু প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, কতটা দূর পর্যন্ত আমাকে যেতেই হবে। মা, ও আমার মা, মাগো, তোমাকে কথা দিচ্ছি মা, তুমি দেখ, তোমার সে সংগ্রাম তোমার সন্তানেরা ব্যর্থ হতে দেবে না, কিছুতেই না।
রনি ভৌমিক
ইউনিভার্সিটি অব চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্স
বেইজিং, চীন