নাচই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান

মঞ্চে সহশিল্পীর সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনে অনুপ কুমার
মঞ্চে সহশিল্পীর সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনে অনুপ কুমার

তিনি সুদর্শন কোনো পুরুষ নন। অর্থবিত্ত, শান-শওকত তাঁর নেই। সেই অর্থে অসাধারণ মেধাবী ছাত্র তিনি ছিলেন না। তবু এই শহরে প্রায় সব বাঙালি তাঁকে চেনেন। শুধু চেনেনই না, শ্রদ্ধা করেন। সমীহ করেন। একজন মানুষ শিল্পের প্রতি কতখানি দায়বদ্ধ হলে এভাবে ভিনদেশে, ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে থেকে উপহার দিতে পারেন মায়ার খেলার মতো একটি নৃত্যনাট্য, তাও আবার কুইন্স থিয়েটারের মতো এক বিশাল প্ল্যাটফর্মে, একজন অনুপ কুমার দাসই সেটা করে দেখালেন।

এই শহরে লাখো বাঙালির মধ্যে ব্যতিক্রমী একজন মানুষ তিনি। নাচই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। আর এই নাচই তাঁকে দিয়েছে খ্যাতি, ভালোবাসা আর স্বীকৃতি। অথচ তাঁর এখানে আসার পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। পুরুষেরা কেন নাচবে? আমাদের মনমানসিকতায় বিষয়টা যেন সহজে খাপ খায় না। আমরা ধরেই নিই, নাচ মেয়েদের কাজ। পুরুষদের নাচতে দেখলে আর সেই নাচ যদি ধ্রুপদি নৃত্য হয়, তাহলে প্রকাশ্যে না হলেও, আড়ালে হাসাহাসি করি। একজন পুরুষ নৃত্যশিল্পীর আত্মসম্মানবোধের জায়গাটি নিয়ে আমরা বিশেষ ভাবি না!
এমন বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেই বেড়ে উঠেছিলেন একজন অনুপ কুমার দাস। তিনি হৃদয়ের কথা বুঝতে পেরেছিলেন। বুঝেছিলেন এই নাচের মধ্যেই তিনি স্বতঃস্ফূর্ত, এখানেই রয়েছে তাঁর ভালোবাসা। চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে জন্ম হলেও বেড়ে উঠেছেন ঢাকার পুরোনো বিমানবন্দর এলাকায়। ওখানে মহল্লার বখাটে ছেলেরা অনুপ কুমারকে পথে দেখলে খেপাত। নাচেন বলে কত বাঁকা কথা শুনতে হয়েছে মানুষের। কেউ বলত, ‘এই তুমি মেয়েদের মতো নাচো কেন?’ কেউ বলত, ‘তোর তো অনেক মেয়ের সঙ্গে খাতির। দে না আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে!’
অনুপ কুমার বেশির ভাগ সময় ওদের কথা কানে নিতেন না। মাঝে মাঝে প্রতিবাদ করতেন। তবু ওদের খেপানো বন্ধ হতো না। তবে মানুষের একসময় সুসময় আসে। যখন বিটিভিতে সম্প্রচারিত হলো অনুপ কুমার দাসের নাচ, তখন তারা রীতিমতো স্তব্ধ। সাদাকালো সেই টিভির যুগে বিটিভিই ছিল ঘরে ঘরে সবার বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। ১৯৭৬ সালে অনুপ কুমার যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, তখন স্কুল বিচিত্রা নামে এক অনুষ্ঠানে প্রথম অংশ নেওয়ার সুযোগ পেলেন। সেই শুরু, তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। শৈশব-কৈশোরের ভালোবাসাই হয়ে গেল পরবর্তী জীবনের নেশা ও পেশা।
১৯৯৪ সালের এপ্রিল কিংবা মে মাসে নিউইয়র্কে পা রেখেছিলেন অনুপ কুমার দাস। সবাই বলেছিল সময়টা স্প্রিং হলেও হালকা ঠান্ডা থাকবে। তাই একটা কোট গায়ে দিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু বাইরে এসে মনে হচ্ছিল মাঘের শীত। এভাবেই এই শহরে পা রেখেছিলেন এই নৃত্যশিল্পী। এখানে স্থায়ী হবেন, এই ভাবনাটা শুরুতে ছিল না। এসেছিলেন পারফরমার হিসেবে। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে আয়োজিত বিপার ড্যান্স ড্রামায় আর্টিস্ট হিসেবে অংশ নিতে আসেন। ভাইবোনেরা আগে থেকে নিউইয়র্কে ছিলেন। তাঁরা সবাই অনুরোধ করলেন এখানে থেকে যেতে। এভাবে একদিন ব্রঙ্কসের পার্কচেস্টারে গড়লেন স্থায়ী ঠিকানা।
তারপর একসময় সম্পর্ক হলো বাফার সঙ্গে? সেই ইতিহাসটা অনুপ কুমারের মুখেই শুনি, ‘বাফার বর্তমান সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় উদীচীতে। আমি তখন উদীচীতে নাচ শেখাই। উনি আমাকে প্রস্তাব দেন দুজনে একটা সংগঠন করার। এভাবে দুই বছর ধরে আলোচনা চলতে থাকে। অবশেষে ব্রঙ্কসে একটা জায়গা খুঁজে পাই। এভাবে যাত্রা শুরু হয় বাফার। ফরিদা এখানে একটি নারী সংগঠনের নেতৃত্বে আছেন। ওই সংগঠনের সদস্যদের সন্তানদের নাচের তালিম দেওয়ার মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় বাফার। খুব বেশি দিন নয়, মাত্র সাত বছর আগের ঘটনা এটা। এখন বাফায় শুধু নাচ নয়, গান ও বিনা খরচে শিশুদের বাংলা ভাষা শেখানো হয়।’
মাত্র সাত বছরের যাত্রায় সেই বাফা এখন কুইন্স থিয়েটারে মায়ার খেলার মতো নৃত্যনাট্য পরিবেশনের কৃতিত্ব দেখিয়েছে। তার আগে রবীন্দ্রনাথের আরেকটি নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকাও পেয়েছে ভূয়সী প্রশংসা। ভিনদেশের মাটিতে এভাবে একের পর এক অসাধারণ নৃত্যনাট্য উপহার দেওয়া সহজ ব্যাপার নয়। কথায় আছে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। তাই ভিন্ন দেশে, ভিন্ন সংস্কৃতিতে এসেও অনুপ কুমার দাস তাঁর নিজের পরিচয়ে উদ্ভাসিত থাকলেন। আসলে জীবনে আর কিছু হবেন ভাবতে পারেননি।
বয়স যখন তিন কি চার বছর, টিভিতে লায়লা হাসানের নাচের অনুষ্ঠান দেখে নিজেও নাচতেন। বড় হয়ে সেই লায়লা হাসানের সঙ্গেই কাজ করেছেন। তবে দিল্লিতে পাওয়া স্কলারশিপই অনুপ কুমারের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তাঁর পায়ের তলার মাটি শক্ত করে। নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। বাংলায় অনার্স শেষ করার পর ওই স্কলারশিপটি পান। তারপর মাস্টার্স শেষ না করেই চলে যান দিল্লিতে।
প্রথম এক বছর ছিলেন শান্তিনিকেতনে। ওখানে কথাকলি ও মণিপুরি শিখলেও অনুপ কুমারের মন ভরছিল না। কারণ, তাঁর শেখার আগ্রহ ভরতনাট্যম ও কত্থক নৃত্য। যে দুটি শাখা বিশ্বভারতীতে ছিল না। তাই আবার চলে আসেন দিল্লিতে। সেখানে শ্রীরাম ভারতীয় কলা কেন্দ্রে লীলা স্যামসনের কাছে ভরতনাট্যম ও মুন্নালাল শুক্লার কাছে কত্থক শেখেন অনুপ কুমার। কত্থক নাচের জন্য আরেক গুরু রেবা বিদ্যার্থীর কাছেও কৃতজ্ঞ তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স শেষ করে একটা নিরাপদ পেশা বেছে নিতে পারতেন অনুপ কুমার। কিন্তু তিনি ঝুঁকি নিলেন। কারণ, তিনি জানতেন, নাচই তাঁর নিয়তি। ১৯৯১ সালে দিল্লি থেকে চার বছরের ডিপ্লোমা করে আসার পরে সব জায়গায় তাঁর চাহিদা বেড়ে গেল। একই সঙ্গে বাফার ওয়াইজঘাট ও ধানমন্ডি শাখায় নাচের শিক্ষক হিসেবে চাকরি পেলেন। কোরিওগ্রাফি করতে লাগলেন প্রচুর। এই ব্যাপারে তাঁর সৃজনশীলতা ছিল বরাবর। শুধু নাচ নয়, নাচের শিল্পীরা কী ধরনের পোশাক পরবে, কী গয়না পরবে, সেটা নিয়েও তিনি রাতের পর রাত কাজ করেন।
প্রশ্ন করলাম, পারফরমার ও প্রশিক্ষক দুই ভূমিকাতে আপনার সেরা কাজ কোনটি?
অনুপ কুমার উত্তর দিতে বেশি সময় নিলেন না। ‘আমি দিল্লিতে থাকার সময় বিরজু মহারাজের নির্দেশিত নৃত্যনাট্য রঘুনাথ-এ কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। মহাভারতের কাহিনি অবলম্বনে নৃত্যনাট্যটি রচিত হয়েছিল। আমাকে তিনি নির্বাচন করবেন ভাবতে পারিনি। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সেখানে অঙ্গদেবের চরিত্রটি করার সুযোগ পাই। ওই প্রযোজনায় আরও ছিলেন শাশ্বতী সেন ও বিরজু মহারাজের সন্তান জয় কৃষ্ণান।’
অনুপ কুমার বললেন, প্রশিক্ষক হিসেবে আমার সেরা কাজ অবশ্যই মায়ার খেলা। কারণ, এত বড় প্ল্যাটফর্মে এত বেশি শিল্পী নিয়ে নৃত্যনাট্য নির্দেশনা দিইনি আমি।’ এ জন্য আপনাকে অনেক জায়গায় ছাড় দিতে হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে জানালেন, শিশুশিল্পীদের দিয়ে মায়া কুমারীর দল কি সাজানো যায়? তারপর পুরুষ পারফরমাররা ছিলেন আড়ষ্ট। অনুপ কুমার দাস স্বীকার করলেন, ‘আমি বাফাতে যেখানে নাচ শেখাই, সেখানে শিখতে আসার আগ্রহই আসল। এই শহরে বাবা-মা ও তাঁদের সন্তানদের অনেক কিছু বিসর্জন দিয়ে নাচ চর্চা করতে হয়। তাই আমার চেষ্টা থাকে সবাইকে সুযোগ দেওয়ার।’
এরপর অনুপ কুমার যুক্ত করেন, ‘আসলে মায়ার কুমারীর দলে বাংলাদেশ হলে আমি তরুণী মেয়েদের নিতাম। কিন্তু এখানে বাধ্য হয়ে শিশুদের নিতে হয়েছে। কারণ, আমার দলে এর বেশি শিল্পী নেই। বসন্ত নৃত্যে ইচ্ছা ছিল মঞ্চজুড়ে নাচের আয়োজন। কিন্তু সেই সংখ্যক শিল্পী নেই। তারপর পুরুষশিল্পীরা কেউ নাচের ছিল না। ওদের জন্য নাটকটি আমাকে সম্পাদনা করতে হয়েছে। পুরুষের জন্য কোনো নাচের অংশ রাখিনি। ওরা যাতে কেবল এক্সপ্রেশন আর কোরিওগ্রাফি দিয়ে কাজ চালাতে পার। এভাবে অনেক কিছু আপস করতে হয়েছে।’
সবাই মঞ্চে মায়ার খেলা দেখেছে। কিন্তু কেউ কি খোঁজ নিয়েছে, কতজনের কত ত্যাগ-তিতিক্ষার ফসল এই নৃত্যনাট্য? কেউ কি জেনেছে আয়োজনটি সফল করতে বাফার সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন ও সাধারণ সম্পাদক ফারজানা ইয়াসমিনের দিন রাতের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের কথা! অনুপ কুমার দাসকে ছোট জায়গায় শিল্পীদের নিয়ে রিহার্সাল করে, বড় জায়গায় নাচের কল্পনা করতে হয়েছে। উনি কল্পনাপ্রবণ মানুষ বলেই হয়তো পেরেছেন। একটা অর্জনের পরে আবার তিনি ভাবতে শুরু করেছেন আগামী বছরের জন্য আরেকটি নৃত্যনাট্য নিয়ে।
এই যে নৃত্যশিক্ষক, এই পরিচয় টিকিয়ে রাখতে জীবনের অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়েছে অনুপ কুমারকে। মেইন স্ট্রিমে অংশ নেওয়া একটি ড্যান্স কোম্পানির সঙ্গে বেশ কয়েক বছর ব্রডওয়েতে শো করেছেন। কিন্তু কাজটা অনিয়মিত, আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে পরে তিনি ব্যানানা রিপাবলিকে কাজ শুরু করেন। সেখানে চোখ-কান বুজে কাটিয়ে দেন ১০ বছর। উদ্দেশ্য ছিল কিছু টাকা জমিয়ে আর্থিকভাবে নিজেকে নিরাপদ একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া। তারপর যখন কিছু টাকা জমল, তখন আবার নাচে ফিরলেন। পাবলিক স্কুলে অনুপ কুমারের ভাষায় কিছুটা ‘ফ্ল্যাক্সিবল’ চাকরি নিলেন। তারপর পুরোদস্তুর শুরু করলেন নাচের প্রশিক্ষকের কাজ।
মারজিয়া স্মৃতি আর অন্তরা সাহাই শুধু নয়, অনুপ কুমার দাস উপহার দিয়েছেন অনেক নামকরা নৃত্যশিল্পীকে। বাংলাদেশের রিচি, চাঁদনী, রিয়া—সবাই তাঁর হাতে গড়া। রিয়ার প্রথম কমার্শিয়ালের কোরিওগ্রাফি করেছেন তিনি। বাফার নৃত্যশিক্ষক থাকাকালে তাঁর কাছে কত্থক নাচ শিখেছেন মৌ, রতন, স্বপন, বেবী, তান্নার মতো দেশসেরা নৃত্যশিল্পীরা। মারজিয়া স্মৃতি ও অন্তরা সাহাকে নিয়ে অনুপ কুমারের মূল্যায়ন, ‘ওরা দুজনেই খুব এনার্জিটিক। আগে ওদের মধ্যে নাচের প্রতি এতটা টান ছিল না। আমি সেটা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছি। লেখাপড়াতেও ওরা মেধাবী। আর যেকোনো মেধাবী মানুষকে দ্রুত কোনো কিছু শেখানো সম্ভব। আমি যখন ওদের পোশাক নির্বাচন করি, সব সময়ই ভাবি ওদেরকে যেন ভালগার না লাগে, যেন সবাই ওদের দেখে শ্রদ্ধা করে।’
শিবলী মহম্মদ, সোহেল রহমান, আনিসুল ইসলাম হিরু, কবিরুল ইসলাম রতন—সবাই অনুপ কুমার দাসের সমসাময়িক নৃত্যশিল্পী ও বন্ধু। তাঁদের ছেড়ে নিউইয়র্কে চলে এলেও নাচকে কিন্তু ছাড়েননি তিনি। অথচ পরিবারের কেউ নাচের মানুষ ছিলেন না। বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশের নায়িকা পূর্ণিমা সেন গুপ্তা তাঁর দূরসম্পর্কের এক পিসি। এর বাইরে কেউ নেই। তিন ভাই ও এক বোনের সংসারে আর কেউ নাচ শেখেনি।
চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে অমূল্য দাস আর সুপ্রিয়া দাসের কোল আলো করে আসা শিশুসন্তানটি আজ এই শহরের একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। বাবা সব সময় উৎসাহ দিয়েছেন। তবে মায়ের আগ্রহ ছিল বেশি। সন্তানদের মধ্যে একটু খেপাটে এই সন্তানটির প্রতি কেন যেন বেশি ভালোবাসা তাঁর। নাচকে ভালোবেসে ছেলে এখনো বিয়েই করেনি। তাই তো সব ছেলেমেয়েকে ছেড়ে অনুপ কুমারের পার্কচেস্টারের বাসাতেই আছেন বাবা-মা। রাত জেগে বসে থাকেন, কখন ছেলে আসবে? কখন খাবে!
শুধু নাচ শেখানো নয়, নিজের একটি নাচের প্রোগ্রাম করার ইচ্ছা আছে অনুপ কুমার দাসের। সঙ্গে থাকবে প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা। অপেক্ষা এখন সেই দিনের।