না জেনে বিচার করা...

প্রতীকী ছবি৷ সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি৷ সংগৃহীত

সাধারণত কাউকে জানা ও বোঝার আগে আগেই তার সম্পর্কে যেকোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর বাতিক আমাদের সবার কম–বেশি হলেও আছে। যখন দেখা যায় সিদ্ধান্ত ভুল, তখন কজনে লাজুক হেসে বলি ‘সরি শ্রেক’! কখনো বলিই না হয়তো।
প্রশ্ন উঠতে পারে, কে শ্রেক? তাকে কেন ‘সরি’ বলতে হবে?
সবুর। দয়া করে সবুর করুন। ধৈর্য ধরে পড়ুন। তবেই যাঁরা জানেন না শ্রেক নামের ‘ওগর’কে, তারা চিনতে পারবেন তাকে। যে বলেছিল Judge people even before...'
ভিসিই (অর্থাৎ আমাদের দেশের উচ্চমাধ্যমিক সমতুল্য) পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির এক অনুষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। হাই অ্যাচিভার কিছু ছেলেমেয়ে ও তাদের অভিভাবকেরা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন একটি স্কলার প্রোগ্রামের আওতায়। ঘটনাক্রমে মুষলধারে ঝরা বৃষ্টির মাঝেও কৌতূহলী আর উৎসাহী বাচ্চারা উপদেশের কথামৃত শুনতে নাকি এই স্কলার প্রোগ্রামের আওতায় একটা সেমিস্টার পৃথিবীর অন্য যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ পাবে, সেই আনন্দে হইচই করে ছুটেছিল। বৃষ্টি থামলেও এর পানিতে ইউনির ওই সড়ক, গ্র্যাটেন স্ট্রিট যেটির নাম মুহূর্তে যেন অগভীর পানির নহর হয়ে উঠেছিল, গাড়ি পার্কিংয়ে রেখে পানিতে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে তবেই পৌঁছা গেল গন্তব্যে। ঢোকার মুখেই আমন্ত্রণপত্র সতর্কভাবে নিরীক্ষণ শেষে নির্বাচিত বাচ্চাদের নেম ট্যাগ ও নানা কিছুতে ঠাসা এক ব্যাগ হাতে ধরিয়ে দিয়ে একটি মেয়ে প্যাসেজে চা-কফির আয়োজন দেখিয়ে দিচ্ছিল। সামনের ছেলেটির চকচকে বুদ্ধিদীপ্ত চোখ খুব পরিচিত মনে হলো। গোল মুখ, কদমফুলের মতো মাথার চুল যত্ন করে তা কোঁকড়ানো, গোলগাল গড়ন, বেশি লম্বা নয়, সাদা হাফহাতা টি–শার্ট, নীল থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরনে হেলেদুলে হেঁটে প্যাসেজে যাচ্ছে। দেখেছি কোথাও ওকে। আরে তাই তো পরিচিত মুখই সে। ও হচ্ছে ম্যাট। ম্যাট হোয়াইট। কিশোরদের জন্য আয়োজিত বিজ্ঞানবিষয়ক এক ফোরামে ক্যানবেরা–যাত্রী একদল বাচ্চার মাঝে গত বছর ওকে দেখেছিলাম। গত দুদিনে পত্রপত্রিকায় ওর ছবি বেরিয়েছে, চ্যানেল সেভেনের ‘টু ডে টু নাইট’ অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎ​কার নেওয়া হয়েছে। নামীদামি স্কটিশ চার্চ কলেজ বা সেইন্ট বিডস নামের প্রাইভেট স্কুল নয় সাব আড়বান সাধারণ এক পাবলিক স্কুল থেকে ভালো ফলাফল করা ম্যাট প্যাসেজে পা রাখতে না রাখতেই ছফুট লম্বা এক ক্যামেরাম্যান ও মাইক্রোফোন হাতে এক মহিলা ওকে ঘিরে ফেললেন। ম্যাট ও আরও কজন বাচ্চা যখন ইন্টারভিউ দিতে ব্যস্ত, বাকিরা বৃষ্টিভেজা শীতার্ত সন্ধ্যায় গরম চা-কফি, কেক ও নানা জাতের নুনতা মিষ্টি মজার খাবারের স্বাদ গ্রহণে তৎপর। চা ছিল নানা পদের। পিকউইকের মনোরম কাগজের মোড়কে প্রতিটি টি ব্যাগ আলাদা করে সংরক্ষিত। ইংলিশ আলগ্রে থেকে শুরু করে আফ্রিকান রুইবাস ভ্যানিলা টি পর্যন্ত। নামীদামি সব চা। রুইবাস ভ্যানিলা এমন এক চা, যা দেহ–মনকে উদ্দীপক ও চাঙা করে না বরং সমস্ত অঙ্গে কেমন এক আবেশ করা স্বস্তি এনে দেয়, মনে আনে প্রশান্তি। যা হোক ঘণ্টা খানেকের চা-নাশতা পর্বের সমাপ্তি হলো। এরপর প্যাসেজের পাশে বেশ বড় লেকচার হলে ঢুকে সবাই বসল।
মেলবোর্ন ইউনির প্রো–ভাইস চ্যান্সেলর, পূর্বতন ভাইস চ্যান্সেলরসহ আরও দু–একজন ছিলেন বক্তৃতা মঞ্চে। কে কী, জানা হয়নি তখনো। এদের মাঝে চৈনিক আদলের তবে যথেষ্ট লম্বা, ঋজু ভঙ্গি, নম্র হাস্যমুখের ছিলেন একজন। তাঁকে দেখে আমার সামনে বসা দুটি ছেলে টিপ্পনী কাটা শুরু করলো। দুজনের একজন আবার নিজেও চৈনিক। সে–ই বলল যে ওই লোকের হাস্যকর চাইনিজ ইংরেজি শুনলে ঘুম পাবে এখন। বন্ধু সাদা ছেলেটিও কথাটার সমর্থনে মাথা ঝাঁকিয়ে খুব হাসল। ওদের দুজনের ধারণাকে ভন্ডুল করে দিয়ে সেই পূর্বতন ভাইস চ্যান্সেলর শিক্ষাবিদ ভদ্রলোক এমন চমৎকার ভাষায় বক্তব্য রাখলেন যে, অন্য সবার মতো ছেলে দুটিও ঘুম ভুলে গভীরভাবে কান পেতে তা শুনল। এই স্কলার প্রোগ্রাম হলো ওই শিক্ষাবিদেরই ‘ব্রেইন চাউল্ড’। তাঁর বক্তব্য শেষ হতেই সাদা ছেলে কিছুটা লজ্জা দেওয়ার জন্যই যেন হলদে চৈনিককে বলল, ইউ স্টার্ট জাজিং পিপল ইভেন বিফোর নোইং দেম!
দ্বিতীয়জন লাজুক হেসে বললো 'Sorry Shreak!'
এদের কথাবার্তা থেকে বুঝলাম, শুধু বই পড়ুয়া নয় এরা। অনেক খবর রাখে আর সুযোগ পেলে কাজে লাগাতেও পিছপা হয় না। ওরা ‘ওগর’ (গল্পে কল্পিত দৈত্য) শ্রেককে ভোলেনি, শ্রেকের উচ্চারিত সংলাপও মগজের ভল্টে জমিয়ে রেখেছে। কোনো কিছুই অপচয় করতে রাজি নয় এরা। ছাই পেলে তা–ও উড়িয়ে দেখতে জানে ওরা। তাতে মানিকরতন পেয়ে যেতেও পারে। কথাটা প্রতিভাবান রবীন্দ্রনাথের। একেই বোধ হয় বলে মেধা! শ্রেক হচ্ছে অস্কার পাওয়া মজার একটি কার্টুনচিত্র। যে কার্টুনটি প্রচলিত ধারণাকে পাল্টে দেয়, ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দেয় মানুষকে। এখানে চিরকাল শোনা গল্পের মতো শাপগ্রস্ত ব্যাঙ রাজকুমার রাজকন্যার চুম্বনে অপূর্বদর্শন যুবরাজ হয়ে ওঠে না। বরং উল্টো ঘটনা ঘটে। শ্রেককে ভালোবেসে সুন্দরী রাজকন্যা ফিয়োনা নিজেই শ্রেকের মতোই অসুন্দর এক বিশাল দৈত্যই থেকে যায়, আর সুখী হয় দুজনে, ভীষণ সুখী। এই কার্টুনছবির বক্তব্যটা এমন যে সুখের জন্য সুদর্শন যুবরাজ হতে হবে, রাজত্ব বা অজস্র সম্পদ থাকতে হবে, কথাটা সতত সত্য নয়। দুষ্টুদের একজন যেই ঝাড়লো শ্রেকের সংলাপ, অন্যজন সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দিল কথাটা কার সে জানে। নীরবে তাকিয়ে দুই মেধাবী দুষ্টুর চতুরালি খুব উপভোগ্য লাগল। সবচেয়ে ভালো লাগল ভুল স্বীকার করে ‘সরি’ বলাটা। আন্তরিক ছিল ‘সরি’ বলায়। তখন মনে পড়ল আমি নিজেও একবার না জেনে, না বুঝে একজনকে খুব খারাপ লোক ভেবেছিলাম, প্রায় বদমাশ ভেবে ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিলাম, ছিঁটকে পালিয়ে বেঁচেছিলাম। আমারও বলা উচিত ছিল ‘সরি শ্রেক’!

প্রতীকী ছবি৷ সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি৷ সংগৃহীত


ঘটনাটা ১৯৯২-এর। বছরেরও বেশি পার হয়ে গেল। আমি নর্থ লন্ডনে ফিঞ্চলি এলাকা থেকে সেন্ট্রাল লন্ডনের এলএসইতে (লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স)আসা-যাওয়া করছি। লন্ডন টিউবের (পাতাল রেলে) যাতায়াতের সুবিধা আমার বিদ্যা অর্জনের কিছুটা হলেও সহায়ক ছিল সেই সময়ে। তখন মনে প্রশ্ন জাগত, জীবনকে সহজ ও আরাম আয়েশে কাটানোর জন্য এই যে উন্নত ইনফ্রাস্ট্রাকচার, বরফজমা শীতেও ঘরবাড়ির উষ্ণতামোদির পরিবেশ জনসাধারণের জীবনের প্রায় সব মূল চাহিদা (ব্যাসিক নিড) মিটিয়ে ফেলা সম্ভব করা গেছে কী করে? তা কি শুধুই ওদের শ্রম ও মেধার গুণে, নাকি দুই–আড়াই শ বছর ধরে কলোনি দখল করে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে সম্পদ লুটেপুটে সংগ্রহ করে তা নিজেদের উন্নতির জন্য কাজে লাগিয়েছে বলে? হয়তো দুটোই ঠিক। কলোনি লুটপাট করে সম্পদ জোগাড় করেই ক্ষান্ত হয়নি। শ্রম ও মেধা খাটিয়ে সে সম্পদ কাজেও লাগিয়েছে এরা। জীবনের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে চুরি–বাটপাড়ি, ধুন্ধরীপণা করতে হয় না বলে এখানে বেশির ভাগ মানুষ ভালো ও সৎ। প্রশ্ন জাগে মনে, কত পুরুষ, কত পুরুষ ধরে মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত থাকলে এমনি সৎ ও বিবেচক হবে? উন্নতির ফলে দারিদ্র্য দূর হয়। উন্নতির জন্য শিল্পায়ন দরকার আর শিল্পায়নের জন্য সম্পদ দরকার।
ব্রিটিশরা একসময় কলোনি থেকে সম্পদ হাতিয়ে নিয়েছিল, যে সম্পদ তাদের উন্নতিতে কাজে লাগিয়েছে। অসহায়ভাবে চিন্তা করি, এখন অনুন্নত দেশগুলো তাদের উন্নতি সাধনে শিল্পায়নের জন্য কোথা থেকে সম্পদ জোগাড় করবে?
উন্নতির আগে ও ঊষালঙ্গে এই ব্রিটিশদ্বীপেও ভুখানাঙ্গা মানুষেরা চুরি-ডাকাতিসহ নানা অপরাধে ব্যাপৃত ছিল। ছিল প্রতিবাদী, ছিল আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রামীরাও। বুদ্ধিমান ব্রিটিশরা হতদরিদ্র চোরছ্যাচরদের যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে, প্রতিবাদীদের ও সংগ্রামীদের শায়েস্তা করতে সেসব অভাগা অপরাধীদের জাহাজে বোঝাই করে বহু বছর আগে বহু দূরে অস্ট্রেলিয়া নামের কলোনিতে পাঠিয়ে দেয়।
বর্তমান বিশ্বেও আমাদের বাংলাদেশের মতোই অনেক অনুন্নত দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ বেঁচে থাকার জন্য অপরাধে জড়িয়ে আছে। তাদের দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করা উচিত নয় কি? নাকি ব্রিটিশদের পথ অনুসরণ করে কোনো দ্বীপে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়াই ঠিক? (তবে লোভের খাই মেটাতে যারা দুর্নীতি করে মানুষকে বঞ্চিত করে সম্পদ কুক্ষিগত করে, তাদের কথা স্বতন্ত্র। তাদের জেলে ঢোকানো কী আন্দামান দ্বীপ থাকলে তাতেই পাঠানোই উচিত।) এসব নানা জিজ্ঞাসা মাথায় নিয়ে ব্রিটিশেরই স্কলারশিপে ব্রিটিশের টিউবে চড়ে অনায়াসে পথ পাড়ি দিতাম প্রতিদিন।
অনুন্নত দেশকে নানা সহযোগিতা (স্কলারশিপও তার মাঝে একটি) দান ওদের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টা বোধ হয়।
ইস্ট ফিঞ্চলি থেকে নর্দান লাইনের টিউব ধরে প্রায় নয়টা স্টপেজ পার হয়ে তবে কিংক্রসে পৌঁছাতাম। এক স্টপেজ থেকে আরেক স্টপেজে পৌঁছাতে ট্রেনের এক মিনিটও লাগত না। ট্রেনে বসে গভীর মনোযোগে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেছি মর্নিংটন স্টপ থেকে ক্যাম্পডেন টাউন স্টপে পৌঁছাতে সবচেয়ে বেশি সময় লাগল। তা–ও মাত্র পঞ্চান্ন (৫৫) সেকেন্ড। আশ্চর্য যে, এক প্লাটফর্ম থেকে আরেক প্লাটফর্মে যেতে কখনো কখনো সময় লেগে যেত তার চেয়েও অনেক বেশি। মাটির নিচেই যে দোতলা–তিন তলায় ছোটাছুটি করে প্লাটফর্ম বদলানোর দরকার হয় লোকজনের।
কিংক্রস টিউব স্টেশন হচ্ছে লন্ডনের পাতাল রেলের বিরাট জংশন। নর্দার্ন লাইন ধরে কিংক্রসে পৌঁছে ওখান থেকে পিকাডেলি লাইন ধরে পাঁচটা স্টপেজ ছাড়িয়ে হলবর্ন স্টেশন। ওখানে নেমে কয়েক মিটার হাঁটলেই আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
সাধারণত আমি পিক আওয়ারে আসা–যাওয়া করতাম। লেকচার-সেমিনার ও লাইব্রেরি ওয়ার্ক শেষে প্রায়ই পাঁচটার রেল ধরে ফিরতাম।
আমার ছোট্ট মেয়েসহ খালাতো ভাই ও ভাবির (জাতীয় পুরস্কার পাওয়া মেঘের অনেক রং ছবির নায়ক ওমর এলাহী ও তাঁর স্ত্রী মাথিন) সঙ্গে নর্থ লন্ডনের ফিঞ্চালিতে ছিলাম। স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে আসা বোনের জন্য ভাই-ভাবির আনন্দ-গর্ব যেমন ছিল, আন্তরিকতা ছিল তারও চেয়ে বেশি। আমার নিরাপত্তার জন্য উৎকণ্ঠিত ছিলেন দুজনেই। আত্মীয়-বন্ধুরা বলেছিলেন, টিউবে পিক আওয়ারে যাতায়াত করা নিরাপদ ও সোনাগহনা না পরাই উত্তম। ভাই বলেছিলেন টিউবরেলের সেই কামরাতে উঠতে যেখানে লোকজনের ভিড় থাকে। জনশূন্য নির্জন কামরা নিরাপদ নয়।
একদিন দুপুরবেলা। তিনটা–সাড়ে তিনটা বাজে। লাইব্রেরি ওয়ার্ক বাদ দিয়ে বাড়ি ফিরছি। সন্তানটির ঠান্ডা লেগেছে সামান্য। শিক্ষয়িত্রীকে বলেছি মাঠে খেলতে না পাঠাতে। ওরা যত্নশীল। তবু বাচ্চাটার জন্য মনটা অস্থির, ব্যাকুল।
অস্থিরতার কারণে ট্রেন থামতেই হুট করে এক কামরায় উঠে পড়লাম। জনবহুল নাকি জনবিরল, খেয়াল করার মতো সুস্থির মন ছিল না। উঠে দেখি আমি ছাড়া আরেকজন যাত্রী মাত্র রয়েছেন। আমি বাঁ দিকের সিটে আর উল্টোদিকে অর্থাৎ ডানদিকে বসে আছেন ভদ্রমতো দেখতে লোকটি।
সুস্থির হয়ে বসে সামনে তাকালাম। সাদা চামড়ার মধ্যবয়সী দাড়িওয়ালা লোকটির চেহারা কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর মতো হলেও কোথাও যেন খটকা আছে। মনে হলো মাথা সিটে এলিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসা লোকটি গভীর মনোযোগে আমাকে দেখছে। ঝটিতে পলক সরিয়ে চোখ ফেলে চারদিক দেখলাম। আমরা দুটি প্রাণী ছাড়া আর কেউ নেই কামরায়। আবার ভদ্রলোকের ওপর ক্ষণিকের জন্য পলক ফেললাম। মনে হলো তার ঠোঁট যেন বিড় বিড় করছে। ভয় আর শঙ্কা ঘিরে ধরল। সেকেন্ড কয়েক মাত্র, তা–ও মনে হলো অন্তহীন। আল্লাহকে ডাকতে শুরু করেছি মাত্র। তখনি ধাক্কা দিয়ে টিউবরেল থামলো।
প্রায় ছিটকে ওই কামরা থেকে বেরিয়ে লোকজন বোঝাই এমন কামরায় উঠে গেলাম। টিউব দ্রুত চলে বলে ঐদিন আন্তরিকভাবে ওই ট্রেনকে দোয়া দিলাম। মনে হলো সাধুর মতো দেখতে হলেও আসলে সে কি তা–ই? নাকি শয়তান?
আমার আতঙ্কিত হওয়ার কারণ ছিল। কারণটি হলো একটি খবর। প্রায় মাস দু–এক আগে লন্ডনের পত্রপত্রিকা একটি খবর অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ছাপিয়েছে। তারপর এর ওপর লেখালেখিও হচ্ছে প্রচুর। টিউবে নিরাপত্তা নিয়ে তর্ক শুরু হয়ে গেছে। খবর হল বন্দনা প্যাটেল নামে এক ইন্ডিয়ান-ইংলিশ মহিলা টিউবে অত্যাচারিত হয়ে খুন হয়েছেন। অপরাধী ধরা পড়েনি।
বাসায় ফিরে ট্রেনের নির্জন কামরায় ওঠা, সাধু নাকি শয়তানের দেখা পেয়ে ভয় পাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে কিছুই বললাম না। এসে দেখি দৌড়ঝাঁপ করে মেয়ের ঠান্ডাও কেটে গেছে মনটা আপনাআপনি ভালো হয়ে গেল। কোন ভয়ংকর বিপদ আসার কথা ভুলে গেলাম।
জুনের মাঝামাঝি পরীক্ষা শেষ। থিসিস শেষ করতে হবে এখন। আবহাওয়াও চমৎকার। ঝকঝকে রোদ, মায়াবী রোদের উষ্ণ আদরের চাদর জড়ানো চারপাশ। বরফে না হয় চার দেয়ালের মাঝে বন্দী থাকতেই ভালো লাগে আর এখন সুন্দর সময়ে? লাইব্রেরি ও কম্পিউটারের মাঝেই দারুণ ব্যস্ত সময় দৌঁড়াচ্ছে। থিসিস শেষ করে প্লেনে উঠতে পারলে বাঁচি।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের বেইজমেন্টে ইন্টারন্যাশাল অর্গানাইজেশনের পাবলিকেশনস ও ডকুমেন্ট সংরক্ষিত। ওগুলো বাইরে আনা যায় না। ওখানে বসে কাজ করতে হয়। কেউ যদি গবেষণাপাগল হন, তবে তার জন্য সোনার খনি হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরি। অবাক কাণ্ড যে লিফলেট পর্যন্ত যত্নে রক্ষিত আছে এখানে।
কিন্তু ভয়ংকর নির্জনতা লাইব্রেরিতে। বেইজমেন্টে আরও বেশি নীরবতা। মানুষের শব্দহীন চলাফেরা মনে হতো কম্বলের ওপর দিয়ে পিঁপড়া হেঁটে যাওয়ার মতো কাণ্ড।
এক নির্জন দুপুরে দীর্ঘক্ষণ শেলফ ঘেঁটে, আঁতিপাঁতি খুঁজে আমার কাঙ্ক্ষিত ডকুমেন্টটি পেয়ে টেবিলে ফিরছি। একটি দৃশ্য দেখে চমকে উঠলাম। সামনের টেবিলে মোটা এক ডকুমেন্ট মেলে ট্রেনে দেখা ফিদেল কাস্ত্রোর মতো দেখতে লোকটি বসা। গালে হাত, দৃষ্টি বইতে নিবদ্ধ। লিখছেন না। হাতের কলম থুতনিতে ঠেকিয়ে গভীর পঠনে মগ্ন। মনে হলো ঠোঁট বিড়বিড় করছে। সন্তের মতো পণ্ডিত লোকটিকে অযথা বদলোক ভেবেছিলাম বলে নিজের কাছে নিজেই লজ্জিত হলাম।
এই জ্ঞানপিপাসু লোক টিউবের কামরায় আমার দিকে তাকিয়ে থেকেও দেখেননি আমাকে। শুধু অকারণে ভুল সিদ্ধান্ত টেনে তাঁকে দুষ্টুবদমাশ ভেবে নিয়েছিলাম। তাই এখন বলতে ইচ্ছে হচ্ছে ‘সরি শ্রেক’!
দিলরুবা শাহানা
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া