নতুন বিশ্ব রেকর্ড টেনিসের জগতে

আজ ইতিহাস গড়লেন নাদালছবি: রয়টার্স

লেখাপড়া আর চাকরি করা—এই আমাদের পৃথিবী। এর বাইরেও জগৎ আছে, তা কি জানি না! যে কাজটি করার কথা ছিল গত ইউএস ওপেনে জোকোভিচের, কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি, তবে তা পূরণ করল এ মুহূর্তে নাদাল।

পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই প্রতিযোগিতা শুরু, টিকে থাকার প্রতিযোগিতা দিয়ে মানুষের যাত্রা। তারপর উদ্ভাবনের প্রতিযোগিতা, ধর্মের প্রতিযোগিতা, রূপ এবং গুণের প্রতিযোগিতা। বড়লোক হওয়ার প্রতিযোগিতা, ভালোবাসার প্রতিযোগিতা, এমনকি ঘৃণারও প্রতিযোগিতা বিরাজমান সারা বিশ্বে।

খেলাধুলার প্রতিযোগিতা তো সর্বজনস্বীকৃত। খেলাধুলায় দুটি দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সৃষ্টি হয়, সৃষ্টি হয় বিনোদনের, গড়ে ওঠে উত্তেজনা, উদ্দীপনা এবং সবশেষে জয়-পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয় তার বহিঃপ্রকাশ। বিজয় অর্জনে দরকার সাহসিকতার এবং খেলতে দরকার সহযোগিতার। যুগ যুগ ধরে খেলাধুলার মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হয় সেরাদের মধ্যে সেরা, যাকে বলে বিশ্বসেরা। আবার কখনো বা বিশ্ব রেকর্ড ধারণকারী হিসেবে অনেকের নাম ফুটে ওঠে।

পৃথিবী সৃষ্টির পর শুধু দৌড়ের ওপর কতবার বিশ্ব রেকর্ড হয়েছে, তা কি আমরা জানি, বা কতবার তা ভেঙে নতুন রেকর্ডের সৃষ্টি হয়েছে? তবে এ মুহূর্ত পর্যন্ত উসাইন বোল্টের রেকর্ডই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রেকর্ড। অতি সত্বর চীনে শুরু হতে যাচ্ছে উইন্টার অলিম্পিক, দেখা যাক এমন কেউ আছে কি বিশ্বে যে এ যুগের রেকর্ড ভঙ্গ করে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে?

আজ আমি টেনিসের জগৎ এবং তার রেকর্ড ও ভবিষ্যৎ রেকর্ড নিয়ে আলোচনা করব। অন্যান্য খেলাধুলার মতো টেনিসেও বিশ্ব রেকর্ড বা খ্যাতি অর্জন করা সম্ভব।
কথায় বলে ‘everything is impossible until someone makes it possible’ যেমন পৃথিবী সৃষ্টির পর পুরুষদের মধ্যে প্রথম যিনি টেনিসে সবচেয়ে বেশি গ্রান্ড স্ল্যাম (গ্র্যান্ড স্ল্যাম হলো চারটি স্ল্যাম টুর্নামেন্ট, যে টুর্নামেন্টগুলোকে বেশি পয়েন্ট, ঐতিহ্য, প্রাইজমানি ও জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টেনিস ইভেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গ্র্যান্ড স্ল্যামকে মেজরও বলা হয়। গ্র্যান্ড স্ল্যামগুলো হলো অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, ফ্রেঞ্চ ওপেন, উইম্বলডন এবং ইউএস ওপেন) জয়লাভ করেন তিনি হলেন রাফায়েল নাদাল (২১টি)। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো বর্তমানে তিনজন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় ২০টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম শিরোপা অর্জন করেছেন এবং তাঁরা তিনজনই টেনিসের জগতে কিংবদন্তি চলমান খেলোয়াড়। তাঁদের তিনজনেরই নতুন বিশ্ব রেকর্ড তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। এবারের বছরের শুরুতে যে গ্র্যান্ড স্ল্যামটি শুরু হয়েছে, সেটা হলো অস্ট্রেলিয়ান ওপেন। ভাবতেই অবাক লাগে একবার নয়, দুবার নয়, ২০ বার গ্র্যান্ড স্ল্যাম বিজয়ী বর্তমান তিনজন ছিলেন একই সারিতে এবং তিনজনই অ্যাকটিভ খেলোয়াড় এবং তাঁরা হলেন রজার ফেদেরার, রাফায়েল নাদাল ও নোভাক জোকোভিচ। এবারের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে এই তিনজনের মধ্যে শুধু নাদাল খেলেছেন। রজার ইনজুরির কারণে যোগ দিতে পারেননি, অন্যদিকে জোকোভিচ করোনার টিকা না নেওয়ার কারণে অস্ট্রেলিয়ান সরকার তাঁর ভিসা বাতিল করে দেয়।

যেহেতু খেলাধুলোয় রয়েছে প্রতিযোগিতা,সেহেতু পুল ও পুশ কনসেপ্টটি ভীষণভাবে কাজ করে এখানে, যার ফলে টেনিসের জগতে বিশ্বের তিনজন নামকরা সুপারস্টার রজার ফেদেরার, রাফায়েল নাদাল ও নোভাক জোকোভিচ পরস্পর পরস্পরকে সারাক্ষণ পুল ও পুশ করার কারণেই এমনটি অবিরল ঘটনা ঘটেছে।

বর্তমানের টেনিসে যা বেশি লক্ষণীয়, তা হলো শারীরিক যোগ্যতা। যেহেতু রজারের বয়স চল্লিশের ওপরে, শারীরিক দিক দিয়ে আগের মতো পারদর্শিতা দেখাতে পারছেন না। তারপরও শুধু পদবির কারণে নয়, তাঁকে টেনিস কোর্টে সবাই দেখতে চায়, কারণ তিনি কিংবদন্তি এবং টেনিসে সেরাদের মধ্যে সেরা।

নাদালের বয়সও কম নয়, তারপর তাঁর যে খেলার স্টাইল তাতে শারীরিক দক্ষতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সে ক্ষেত্রে বলা কঠিন কী অবস্থা তাঁর। তবে জোকোভিচের বর্তমান খেলার কৌশল, শারীরিক দক্ষতা এবং খেলার পারফরম্যান্স দেখে মনে হচ্ছে তিনিই ভবিষ্যৎ টেনিসের সর্বকালের সর্বশেষ বিশ্ব গ্রান্ড স্ল্যাম রেকর্ডধারী হয়ে থাকবেন কমপক্ষে কয়েক যুগেরও বেশি সময় ধরে। কত দিন এই রেকর্ড ধরে রাখবেন, সেটা নয়, প্রশ্ন এখন কত বছর ধরে রাখবেন? বর্তমান নতুন প্রজন্মদের খেলা দেখে যতটুকু মনে হচ্ছে, তাতে বলতে চাই, বারবার একই খেলোয়াড় সেরা ট্রফিজয়ী হবে বলে মনে হচ্ছে না।

সেই মুহূর্তের পর নাদাল
ছবি: রয়টার্স

কারণ, প্রতিযোগিতার যুগে বলা মুশকিল কে, কখন, কাকে, কীভাবে পরাজিত করে!
আমি কিছুদিন আগে লিখেছি টেনিস এবং রজার ফেদেরার ও জোকোভিচকে নিয়ে। যেমন উল্লেখ করেছি, যা-ই হোক না কেন, আর যে যা-ই ভাবুন না কেন, কিছুই যায়–আসে না। কারণ রজার ফেদেরার টেনিস ক্যারিয়ারও একদিন শেষ হবে, প্রশ্ন কবে, কখন ও কোথায়? তবে রজার ফেদেরারের টেনিসের ওপর যে আসক্তি, তা শুধু তার খেলা দেখলেই বোঝা যায়।

রজার শুধু বিশ্বের সেরা টেনিস খেলোয়াড়ই নন, তিনি একটি আনন্দঘন মুহূর্ত। তিনি সবার হৃদয়ের এক ভালোবাসা। একদিন টেনিস জগৎ তাঁকে ছাড়া টেনিস খেলবে, হয়তো তাঁর কথাও ভুলে যাবে সময়ের সঙ্গে। নতুন চ্যাম্পিয়নের জন্ম হবে ঠিকই, তবে আমার মনে হয় রজার ফেদেরার সবার হৃদয়ে টেনিসের আইকন হয়ে বেঁচে থাকবেন দুনিয়াতে।

তবে যে বিষয়টি এখন তুলে ধরব, যা হয়তো নতুন ইতিহাসের এক পূর্বাভাস। সেটা আবার কী? রজার বা নাদাল যত সহজে বিশ্ববাসীর মন জয় করেছে, জোকোভিচের পক্ষে সেটা তত সহজ হয়ে ওঠেনি। কারণ একটাই, সেটা হলো জোকোভিচের জন্ম হয়েছে ইস্ট ব্লকে। পশ্চিমা দেশগুলো খুব সহজে ইস্ট ইউরোপের কারও প্রতিভা মেনে নিতে এখনো অভ্যস্ত হয়নি, বিশেষ করে টেনিসের ওপর।

কিন্তু তাতে কিছু যায়–আসে বলে মনে হয় না। কারণ জোকোভিচ ২০টি গ্রান্ড স্ল্যাম শিরোপা জিতে যদি ২১তম শিরোপাটা অর্জন করতে পারেন, তখন ক্ষণিকের তরে সব ভুলে বিশ্ব তাঁকেই বরণ করবে সর্বকালের সেরা টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে। কিন্তু এই মুহূর্তে ঘটনার মোড় ঘুরে গেল। জোকোভিচ নয়, রজার নয়, নাদাল অস্ট্রেলিয়ান ওপেনজয়ী হয়ে ২১তম শিরোপাটা অর্জন করে ক্ষণিকের তরে বিশ্বের প্রথম টেনিস তারকা পুরুষদের হয়ে গেল। What a wonderful achievement! তবে জোকোভিচ যদি এভাবে খেলতে থাকেন, তাহলে কম করে হলেও আরও ৪ থেকে ৬টা গ্রান্ড স্ল্যাম শিরোপা অর্জন করবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। প্রশ্ন, কে, কবে, কখন তাঁকে ব্রেক করে নতুন বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করবে? লেখাটিতে সব খেলার মধ্যে টেনিস কেন এত বেশি করে উঠে এল? এমন প্রশ্ন হতেই পারে। আমার ছেলেমেয়ে এর ওপর ডেডিকেটেড এবং মোটিভেটেড বিশেষ করে আমার ছেলে জনাথান মৃধা। খুব ইচ্ছা ছিল সে বাংলাদেশের হয়ে টেনিস খেলবে, সেখানে বাংলার পতাকা উড়বে।

নাদালের দ্বিতীয় অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জয়
ছবি: রয়টার্স

এখন আমার ভাবনা থেকে যেটা বলতে চাই, সেটা হলো আমরা কবে লাল–সবুজের পতাকা দেখতে পাব বিশ্বাঙ্গনে। কীভাবে সেটা সম্ভব! নতুন করে ইনোভেটিভ হতে হবে তার জন্য? শুধু কানাডার পরিকাঠামো ফলো করলেই আমার বিশ্বাস খেলাধুলোর ওপর, বিশেষ করে ফুটবলের সফলতা আনা সম্ভব। যে দেশে বাংলাদেশের অর্থে বেগমপাড়া গড়ে উঠেছে এবং যারা এর পেছনে জড়িত, তারা অতি সহজে কানাডাকে ফলো করতে পারে। কানাডা লেখাপড়ার সঙ্গে খেলাধুলার গুরুত্ব দিয়েছে এত বেশি যে তাদের প্রতিটি জাতীয় একাডেমি থেকে সৃজনশীল খেলোয়াড় তৈরি করছে দশ বছর ধরে। বর্তমান বিশ্বের সব খেলাধুলোয় কানাডার অবদান লক্ষণীয়।

আমরা ফুটবল হ্যান্ট একাডেমির কাজ শুরু করেছি। ধীরগতিতে চলছে আমাদের কাজ রাষ্ট্রের পরিকাঠামোর দুর্বলতার অভাবে। লেখাপড়ার সঙ্গে খেলাধুলার সম্পৃক্তি ঘটাতে না পারলে কোয়ালিটিসম্পন্ন জীবন, শিক্ষা এবং ফুটবলকে বিশ্বাঙ্গনে আনা সম্ভব হবে না।

জন্মের সূচনালগ্ন থেকে বাংলাদেশ এক স্বপ্নতাড়িত দেশ। স্বাধীন দেশ হিসেবে সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, স্বাধীনতার এত বছর পরেও সেই স্বপ্ন অর্জিত হয়নি। এটা অনস্বীকার্য যে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য একটা দক্ষ ও সুশিক্ষিত নাগরিক সমাজ গঠন করতে হলে যে কার্যকর শিক্ষা, কর্ম, খেলাধুলাসহ নৈতিকতার প্রয়োজন, আমরা তা এখনো গড়ে তুলতে সক্ষম হইনি। দেশের প্রতিটি উন্নয়ন-রূপকল্পের ভিত্তিমূলেই রয়েছে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের প্রতিধ্বনি। কিন্তু স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তর করতে সবার সক্রিয় উদ্যোগের প্রয়োজন।

লড়াকু নাদালের প্রকৃত রূপ দেখেছেন মেদভেদেভ
ছবি: রয়টার্স

২০৩৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হওয়া সম্ভব। সম্ভব হবে না এমনটি না ভেবে বরং ভাবতে হবে কীভাবে এই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করা যায়। প্রিয় দেশবাসী, আসুন শুধু চার বছর পরপর এক মাস শয়নে, স্বপনে বা জাগরণে নয়, এবার সত্যিকারে ফুটবল খেলি এবং আসুন খেলি প্রতিযোগিতার মধ্যে।
এ মুহূর্তে দূর পরবাস থেকে আমি ৬৮ হাজার গ্রামের কথা ভাবছি। ভাবছি ৬৪টি জেলার কথা। আমি নতুন প্রজন্মের কথা ভাবছি, আমি সোনার বাংলার কথা ভাবছি।

আমি মানুষের কথা ভাবছি। আমি তোমাদের কথা ভাবছি। তোমারা চেষ্টা করলে অবশ্যই পারবে। চলছে এখন জাগ্রত জনতার একান্ত প্রচেষ্টা সোনার বাংলা গড়ার। আমার মতো তোমাদের মধ্যে নতুন চেতনার বন্যা আসুক। তোমরাও একদিন অনেক বড় হবে আর তোমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমার মতো করে এমনই আশার কথা শোনাবে এবং সেটাকে বাস্তবে রূপ দিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমি ক্রীড়াজগতে লাল–সবুজের পতাকা উড়তে দেখতে চাই। আমি শুনতে চাই আমার জাতীয় সংগীত, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’


লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন