ধারাবাহিক রচনা: কৃষ্ণকলি-ছয়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘আচ্ছা, এ দেশের মানুষ বন্দুক রাখতে পারে ঘরে?’ একদিন খাবার টেবিলে তোড়ার আচমকা প্রশ্ন।

ফলের রসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বিষম খেল হামিদ। ‘ধুর, তুমি কি খাবার টেবিলে গোলাগুলি শুরু করবে নাকি? দিলে তো নাশতাটা পণ্ড করে!’

তোড়াকে হামিদ চেষ্টা করেও তুই বলতে পারেনি কখনো। ওর মন সাড়া দেয় না। বড় ভাই আর ছোট বোনের ভেতর যেমন টক-ঝাল-মিষ্টি সম্পর্ক থাকে, তোড়ার আচরণই তেমনটা ঘটতে দেয়নি।

ছেলের পিঠ চাপড়ে দিয়ে জবাব দিলেন তানিশা। ‘পারে। এ দেশের সংবিধানেই আছে, এখানকার নাগরিক নিজের সুরক্ষার জন্য চাইলে লাইসেন্সধারী বন্দুক রাখতে পারে ঘরে।’

‘সে জন্য আমেরিকায় বন্দুকঘটিত অপরাধ অনেক বেশি। একটু কিছু হলো, ব্যস গুড়ুম। দিল গুলি ছুড়ে!’ চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলে হামিদ।

‘আর বাংলাদেশে যেমন কিছু ধর্মীয় গোঁড়ামির ধারক আছে, সবকিছুতে ধর্মীয় বাধা খোঁজার চেষ্টা তাদের, এখানেও কি তেমনটা?’ তোড়া আবার প্রশ্ন করে।

‘না, যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে, বাধা দেওয়া চলবে না। সংবিধান সেই অধিকারও দিয়েছে নাগরিকদের।’ তানিশা নয়, এবার জবাব এল বন্ধুর সঙ্গে নাশতা করতে আসা কৃষ্ণার কাছ থেকে।

‘তোকে কে প্রশ্ন করেছে রে সবজান্তা বেগম? কী আমার বিদ্যাধরী এলেন রে!’ তোড়ার কণ্ঠে বিদ্রূপ।

‘অপরাধ করে ফেললাম মনে হয় প্রশ্নের উত্তর দিয়ে?’ তোড়ার এমন স্বভাব জানলেও আর থাকতে পারল না কৃষ্ণা। সহ্যের সীমা পার হয়ে গেছে তার।

‘আরে কী শুরু করলি তোরা? আর এই তোড়া মেয়েটাকে এত বলি, তবু যদি বোঝে! মুখটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখ। শেষে এই মুখই তোর কাল হবে।’

‘হ্যাঁ ফুফু, এখন তো সব দোষ আমার। আমিই তো খারাপ! আর এই কালো পাথর তো কিচ্ছু করে না, শিশু একেবারে!’ কৃষ্ণার দিকে তর্জনী উঁচিয়ে বলে তোড়া।

‘ব্যস, আর নয়। অনেক বলেছ!’ কড়া গলায় বলে হামিদ।

‘যা রে বাবা যা, আজ তো ক্লাস কাজ দুই-ই আছে না? একটু আগেই যা না।’ ছেলেকে চোখ টিপলেন তানিশা।

পেছন থেকে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল হামিদ। ‘ও আম্মা...শোনো না...আজ গাড়ি নিয়ে যাই কলেজ?’

ছেলের মুখে গাড়ি শুনলেই কেঁপে ওঠেন তানিশা। ‘তুই? গাড়ি? না, না বাবা না...।’

কৃষ্ণা বলে, ‘কিন্তু গাড়ি যদি আমি চালাই তাহলে? আজকে আমি নিয়ে যাই তোমাদের গাড়ি, ফুফু?’

শামসকে তানিশা ভাই ডাকেন। তাই তিনি কৃষ্ণারও ফুফু। তানিশা জানেন, কৃষ্ণা হামিদের গায়ে কাঁটার খোঁচাও পড়তে দেবে না। হ্যাঁ, ওদের দুই বন্ধুতে ছোটখাটো বিবাদ যে হয় না তা নয়, তবে দিন শেষে কৃষ্ণাই হামিদের মন খারাপের কোল।

‘তুই মা ডাকতে পারিস না কেন রে মেয়ে?’ কৃষ্ণার চিবুক ধরে নেড়ে দিলেন তানিশা। ‘যা, তুই চালালে আমার আর চিন্তা কী?’

তবে দরজার আড়ালে তোড়ার ফরসা মুখটায় কালো মেঘ কারও নজরে পড়ল না।

ছোট্ট সাদা গাড়ির দরজা খুলে নিজেকে সিটে আটকে নিল কৃষ্ণা। বেল্ট না পরলে সর্বনাশ। পুলিশে ধরলেই জরিমানা। আর সেই জরিমানার অঙ্কটি বেশ বড়। সিটের পাশে দুজনেরই দুটো বারো আউন্স কফির কাপ। দুজনের গায়েই কালো শার্ট-প্যান্ট। কৃষ্ণার চোখ দুটো রোদচশমায় ঢাকা।

‘অত বড় চশমায় তো চোখ দুটোই ঢেকে গেল রে তোর কৃষ্ণা, আমি আর অন্ধ হই কী দেখে?’ হামিদের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি।

‘জি, আমার চোখ তোমার মতো খারাপ নয়, বুঝলে জনাব চার চোখ? তুই তো চশমা খুললে চোখে দেখিস না বন্ধু।’ কথার জবাব দিলেও কৃষ্ণার সতর্ক দৃষ্টি পথের দিকে।

গাড়ি চালাতে চালাতেই কৃষ্ণার চোখ পড়ে হামিদের ঠোঁটের ওপর দিকে। কফির ক্রিম জমে আছে সেখানে।

‘হি হি...নতুন গোঁফ গজিয়েছে আমার হামিদ সাহেবের।’ কৃষ্ণার প্রাণখোলা হাসিতে মুহূর্তে রঙিন হয়ে ওঠে হামিদের চারপাশ।

‘মুছে দে না...।’ হামিদের কণ্ঠে আবদার।

‘আরে ওই...শুভর গলা নকল করা আমার কাজ, তোর না!’ মৃদু শাসনের চেষ্টা করে কৃষ্ণা।

‘করব, সব করব আমি আমার মানুষটার সঙ্গে। পারলে থামা দেখি?’

‘না, তোকে আর কী আটকাব আমি? আমি তো নিজেই আটকে গেছি তোর সঙ্গে। ছাড়তে চাইও না আর।’ এক হাতে হামিদকে কাছে টেনে কপালে ছোট্ট চুমু খায় কৃষ্ণা।

বাড়ি থেকে কলেজ প্রায় পঁচিশ মিনিটের পথ। গাড়ি না নিয়ে বাস নিলে এই সময়টা প্রায় ঘণ্টা পার হয়ে যায়। দুটো বাস বদল করতে হয় যে!

চলতি পথে কত কিছু চোখে পড়ে। ছোট্ট শিশুর হাত ধরা অল্প বয়সী মা। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকানো কুকুর। যাকে ‘হাই’ বললে সে পালটা দেয়: ঘেউ!

রাস্তার ধারে ফুটপাতে ছড়ানো-ছিটানো তাঁবু। উদ্বাস্তু বসতি। মার্কিনরা এসব উদ্বাস্তুকে বলে হোমলেস। বাসের যাত্রীছাউনি, রেস্তোরাঁর সামনে, ফুটপাতে...কোথায় নেই এরা? কোনো কারণে বাড়ি ভাড়া করতে অক্ষম যারা বা নিজের বাড়ি যাদের কাছে স্বপ্নের মতো, তারাই এমন উদ্বাস্তু।

গাড়ি থামলেই ‘সাহায্য চাই’ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়াচ্ছে সভ্য পোশাকের আমেরিকান ভিখারি। শিশুসন্তানের ঠেলাগাড়ি নিয়ে অনেক মায়েরও দেখা যায় এমন কাজে। ‘চাকরি নেই, ছোট্ট সন্তান, আমায় সাহায্য করবে?’

‘আহা রে...তোড়ার নেশার পেছনে যে টাকা যায়, তা যদি এদেরও দেওয়া যেত, হয়তো কাজে লাগত। কী যে মজা পায় মেয়েটা নেশা করে, ওপরওয়ালা জানেন।’ নিজের মনে বিড়বিড় করে হামিদ।

‘হুম্‌, নেশার পেছনে অযথা অনেক টাকা নষ্ট করে তোড়া। আর শরীরের কথা তো বাদই দিলাম। আমি এ জন্যই ওকে একটু এড়িয়ে চলি, জানিস হামিদ? না হলে তোর বোনকে আমি নিজেই কাছে টেনে নিতাম।’ কলেজে পৌঁছে নামতে নামতে বলে কৃষ্ণা। (চলবে)


ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন