দেশের বাইরে সবুজ মাচা
খানিক দূরেই সবুজ লাউয়ের মাচাটা ঝুলে আছে ঠিক মাথার ওপর! গাঢ় সবুজের ভেজা ভেজা আবেগ মেখে লাউগাছের ডগাগুলো যেন বড়ই উষ্ণতা নিয়ে লেপটে আছে শুকনা মাচাটার কোলেপিঠে। আহা! মুহূর্তেই এক অচেনা অনুভূতির ভিড়ে ঢিপঢিপ করে উঠল ভেতরটা!
এই দূরদেশে ড. কামাল ভাই ও ড. কণা আপার সুখী আবাস সংলগ্ন সরুপথ ধরে খানিকটা এগিয়ে গেলে এমনটাই নজর কাড়ে যেকোনো হেঁয়ালি মনের।
এই তো দিনকয়েক আগে লাল ইটের ছোট্ট শহর অবার্নের প্রিয় মুখ কামাল ভাই বললেন, ‘বিকেল পাঁচটার মধ্যে এসে সবজি নিয়ে যাবি। সঙ্গে তন্ময়, মুনতাসির, অভি আর মুস্তাকিমকে নিয়ে আসিস...।’ বললাম, ‘ভাই আমি তো মুসতাসিরকে ছাড়া বাকি কাউকে চিনি না...।’ কামাল ভাই বললেন, ‘তোর চেনা লাগবে না। মুনতাসির চেনে সবাইকে। ওরা এই ফল-এ আসছে অবার্নে...!’
একটা ভেজা আদরমিশ্রিত তলব! ভাবলাম, এমন তলব তো আজকাল খুব একটা মেলে না! সেই জন্য কি না কে জানে, এমন আর্দ্র তলব পেলে সরু নাকটার ফাঁক দিয়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস এমনি এমনিই বের হয়ে আসে! আমারও হলো তাই।
ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল তিনটা বা সাড়ে তিনটা। বেশ কয়েকটা কাজ হাতে নিয়ে বের হয়েছিলাম টাইগার টাউনের দিকে। পরে কাজের লিস্ট থেকে দু-একটা বাদ দিয়ে কামাল ভাইয়ের বাসার দিকে ছুটলাম। সবাইকে তুলে নিয়ে যখন ভাইয়ের বাসায় পৌঁছালাম, তখন বিকেল ছুঁই ছুঁই করছে। দূর আকাশের গায়ে হেঁয়ালি মনে ভাসছিল খণ্ড খণ্ড কালো মেঘ! চরাচরে পাতলা হাওয়ার সঙ্গে একটা গুমোট ভাবও লেপটে ছিল!
অনেকটা আনমনে ওই সরুপথ ধরে এগোচ্ছি। শেষ বিকেলের মিষ্টি–মিহি নরম রোদ কোনো নিয়ম ছাড়াই আছড়ে পড়ছে চোখে–মুখে, গায়ে-পিঠে। শেষে একটা অচেনা অনুভূতির ধাক্কা খেয়েই যেন মাচাটার কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালাম। কী গাঢ় সবুজ লাউয়ের মাচা! কদিন ধরে যা খই ভাজা মচমচে রোদ, তাতেই হয়তো খানিকটা নেতিয়ে পড়েছে লাউয়ের দু-চারটি ডগা। তাতে কী! এখনো যে লাউয়ের গা থেকে সবুজ রূপ ঝরে পড়ছে পাহাড়ি খেপাটে ঝরনার মতো!
লতাপাতার এমন গাঢ় সবুজ রূপে মনের ভেতরে কী যেন বিড়বিড় করতে থাকে। কেমন যেন একটা গোঁ–ধরা ভাব। কিছুতেই আসবে না মুখে! খানিক বাদে শজারুমুখো গাঢ় সবুজ ঢ্যাঁড়স গাছগুলোর ওপর নজর পড়তেই ভেতরের বিড়বিড় ভাবটা বুদবুদের মতো ভেসে উঠল মুখে। ‘কুমড়ো ফুলে ফুলে নুইয়ে পড়েছে লতাটা, সজনে ডাঁটায় ভরে গেছে গাছটা,...।’
কণা আপু খুব মায়া করে সবুজ লতার ফাঁকে লুকিয়ে থাকা ঢ্যাঁড়সগুলো দেখিয়ে দিচ্ছেন একেক করে। আর ধারালো কাচি দিয়ে কচকচ করে কেটে নিচ্ছে সানাম। আহা, কী আনন্দ! কী এক অদ্ভুত অনুভূতি! সেই হৃদয় গলানো অনুভূতির ছিটেফোঁটা যে কখন প্রিয় কামাল ভাই তার মুঠোফোনে স্থির আবেগীয় স্মৃতি করে তুলেছেন, টের পাইনি।
শুধু লাউ আর ঢ্যাঁড়সই নয়, এ–মাথা থেকে ও–মাথা ছড়িয়ে পড়া বাগানটার পুরো অঙ্গে জড়িয়ে আছে চ্যাপ্টা সবুজ পাতার তাজা পুঁই, বেগুন, মোচড়ানো সবুজ আপেলের মতো টসটসে ক্যাপসিকাম।
এ–প্রান্তে একেবারে ঘরের সঙ্গেই শিমের ঝোপালো সবুজ বাগান। ঠিক দেশি গড়নে। বেগুনি রঙের শিমের ফুলগুলো কচি কচি মুখ করে ফুটে আছে। লিকলিকে সরু সবুজ ডগাগুলো যেন আকাশমুখো হতে চেয়েও নুয়ে পড়েছে রূপের ভারে। আহা! মনের জমানো আনন্দ যেন নোলক হয়ে ঝুলে আছে সবুজ ডগার গায়ে।
সন্ধ্যার মুখে এমন কাঁচা সবুজের প্রেমে তাড়িত হয়ে হয়তো ঠিক ঠাওর করতে পারিনি বেলাটা কখন মিলিয়ে গেছে বনের পাতলা আঁধারে।
ভালোবাসার এমন সবুজ ডালি নিয়ে যখন ফিরছিলাম নিজ নিজ আলয়ে, তখন নিজের অজান্তেই আনমনা হয়ে পড়ছিলাম। বার কয়েক এমনটা হলো। দু-চারটি বড় নিশ্বাসও বের হয়ে গেল তখন।
ভাবলাম, এমন তো হওয়ার নয়। হুমায়ূন আহমেদ কোথায় যেন একবার বলেছিলেন, প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসেই থাকে কোনো না কোনো দুঃখ, থাকে বেদনা। তাহলে? আজ তো আমার এমন কোনো দুঃখ নেই, বেদনাও নেই। তাহলে এমন সুখানুভূতিতেও এমনটা হয়? হয় হয়তো!
লেখক: মনির হোসেন, পিএইচডি গবেষক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট, অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, আলাবামা, আমেরিকা