দেশের বই মেলারই প্রতিচ্ছবি

বই মানুষের বন্ধু। একাকিত্বের সাথি ও জ্ঞান আহরণের মাধ্যম। আমেরিকায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের কর্মময় ব্যস্ত জীবনে এই তিনটি বিষয়ের গুরুত্ব বহন করে চলছে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন। বিশ্বের এই উন্নত দেশে বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত যত রকম বইয়ের ভান্ডারই থাকুক না কেন, প্রবাসী বইপ্রেমী বাঙালিদের বাংলা বই চাই-ই চাই। আর এ কারণেই মুক্তধারার সঙ্গে আমার ২৪ বছরের সম্পৃক্ততা।
খুব ছোট বেলায় যখন বই চিনি কিন্তু পার্থক্য করতে পারি না বই, খবরের কাগজ আর পত্রিকার মধ্যে। তখন থেকেই আমাদের ও আশপাশের বেশ কয়েকটি বাড়িতে একটি কাচের আলমারিতে প্রতিটি তাকে সারি সারি বই গুছিয়ে রাখতে দেখেছি। বইগুলো এমনভাবে গোছানো থাকত, তাতে বই ও লেখকের নাম সহজে পড়া যেত। যখন পড়তে শিখলাম, তখন আবিষ্কার করলাম বই ও লেখকের নাম। রাতের রজনী গন্ধা, ধূপশিখা, কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী—লেখক নিহারঞ্জন গুপ্ত। সাহেব বিবি গোলাম, কড়ি দিয়ে কিনলাম—লেখক বিমল মিত্র। আবার একেবারে আলাদা করে সাজানো বইগুলো ছিল উল্টোরথ, প্রসাদ, দেশ, ঝিনুক ও বেগম পত্রিকা। এ ছাড়া আমার মা ও আমাদের আশপাশের বাড়িতে মায়ের বয়সী নারীদের অবসর সময়ে বই পড়তে দেখেছি। প্রায় প্রতিটি বাসায় দেখা যেত রান্না ঘরের চুলার আশপাশ থেকে শুরু করে ঘরে টেবিলে ও বালিশের কাছে একটি করে গল্পের বই পড়ে আছে।
একজন ভাবি ছিলেন যিনি পড়তেন মাসুদ রানা, দস্যু বনহুর—এ জাতীয় বই। আমরা ছোটরা যারা পড়তে পারি এসব বইয়ের পাতা উল্টোতে পারতাম না। কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে উল্টোরথ ও প্রসাদ পত্রিকার পাতা উল্টাতাম এবং উত্তম কুমারের সঙ্গে রহমান, শওকত আকবর ও রাজ্জাকের এবং নায়িকাদের সঙ্গে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) নায়িকাদের চেহারার মিল খুঁজে পেয়ে আনন্দিত হতাম। আরও আনন্দিত হয়েছিলাম যখন অভিভাবকেরা হতে তুলে দিলেন, রূপকথা, গোপালভাঁড়, বাঙালির হাসির গল্পসহ ঈসপের গল্পের বই। এরপর যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, তখন একদিন দেখি ঘরের এক কোণে বসে আমার মামাতো বোন খুব কাঁদছে, হাতে একটি বই। কাঁদার কারণ জিজ্ঞেস করায় সে আমাকে বইটি ধরিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর সে আমার খোঁজে এসে দেখল, আমিও কাঁদছি। বইটি ছিল শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবদাস এবং এই কান্নার মধ্য দিয়ে শুরু হলো আমার বড়দের বই পড়া। উপন্যাস পড়া। এই প্রবাস জীবনে এত ব্যস্ততার মধ্যেও যাতে এতটুকু চিড় ধরেনি। এর কারণ হচ্ছে মুক্তধারা।
১৯৯৪ সালের নভেম্বর মাসে আমেরিকায় আসার সময় সঙ্গে কিছু বই নিয়ে আসি। আমি আনি আমার জন্য ঈদ ও পূজা সংখ্যা আর আমার বড় ছেলে আনে তার জন্য হ‌ুমায়ূন আহমেদের বেশ কিছু বই। আমাদের ধরনাই ছিল না, এখানে এসে আমরা বাংলা ভাষায় লেখা বই পাব। আসার কয়েক মাস পরেই সম্ভবত ১৯৯৫ অ্যাস্টোরিয়ার মেঘনা গ্রোসারিতে এসে আমরা (আমি আর আমার দুই ছেলে) অবাক। গ্রোসারির সঙ্গেই একটি কামরায় একটি ভিডিওর দোকান। সেখান থেকেই সন্ধান পেলাম বিশ্বজিৎ সাহার, যিনি পারেন পছন্দ মাফিক বাংলা বই ও নাটকের ভিডিও জোগাড় করে দিতে। আমাদের আনন্দের আর সীমা রইল না। একদিন দেখা হয়ে গেল মুক্তধারার বিশ্বজিত সাহার সঙ্গে। তিনি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দিদি ভালো আছেন তো’। জানতে চাইলেন কী ধরনের বই আমাদের পছন্দ। এরপর থেকে আমরা আমাদের পছন্দ মাফিক বই পেতে থাকলাম বিশ্বজিত সাহার কাছ থেকে।
আমার বড় ছেলেটির প্রতি বিশ্বজিত সাহার ছিল বিশেষ স্নেহ। একটি ১৮ বছরের ছেলে আমেরিকায় এসে লেখাপড়ার পাশাপাশি বাংলা বই পড়ছে, বাংলা গান শুনছে—এতেই তিনি মহাখুশি। কত টাকার বই নিল আর কত টাকা দিল সে হিসাবও তিনি রাখতেন না। স্টুডেন্ট ভিসায় পড়ার কথা শুনে তিনি আরও অবাক। সপ্তাহে মাত্র দুই দিন কাজ করে আমেরিকায় বই কিনে পড়ছে—এ বিষয়টিতে তিনি এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন। এক সঙ্গে অনেক বই দিয়ে দিতেন এবং ধাপে ধাপে টাকা নিতেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল, যখন আমরা টাকা দিতে যেতাম তিনি জানতেন না, আমরা কত টাকার বই, ক্যাসেট আর সিডি নিয়েছি।
অর্থ উপার্জনের চেয়ে মানুষের বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি, মানুষ বই পড়ুক ও নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চা করুক—এ বিষয়েই তিনি বেশ উৎসাহী। এটি আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি। সেই যে ১৯৯৫ সালে মুক্তধারায় যাওয়া শুরু করেছি আর থামিনি। যেখানেই থাকি না কেন, প্রতিটি বই মেলায় আমরা হাজির হই। এ এক অন্য রকম আনন্দ। বই, রকমারি খাবার ও শাড়ি-গয়নার দোকানসহ এখানে রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ছোটদের অঙ্কন প্রতিযোগিতা, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, প্রকাশক ও বুদ্ধিজীবীদের নানা বিষয়ের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠান। ছোট আকারে হলেও এ যেন বাংলাদেশের বই মেলারই প্রতিচ্ছবি। মুক্তধারার বিশ্বজিত সাহা তার অক্লান্ত পরিশ্রমে এই সুদূর প্রবাসে আয়োজন করতে সক্ষম হয়েছেন বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার এক মহাসমাবেশ। উন্মুক্ত করেছেন সংস্কৃতি আদান-প্রদানের দ্বার।
বিশ্বজিত সাহার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তার সঙ্গে দেখা না হলে আমার ছেলেরা হয়তোবা এই দেশের মাটিতে বসে বাংলা গান শুনত না, বাংলা বই পড়ত না। ২৪ বছর হয়ে গেল, যখনই মুক্তধারায় যাই বা কোথাও বিশ্বজিত সাহার সঙ্গে আমার দেখা হয়, অত্যন্ত আন্তরিকভাবে একই স্বরে একই ভঙ্গিতে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘দিদি ভালো আছেন তো’। এটি আমার পরম পাওয়া। মুক্তধারা ফাউন্ডেশন থাকবে, বাংলা বই থাকবে, প্রতি বছর বই মেলা হবে। আমি যত দিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকব, মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের বই মেলায় উপস্থিত থাকব।