দেশ ছেড়েছিলাম বিতৃষ্ণা থেকে

ছবি: তানভীর আহম্মেদ

তারিখটা মনে নেই। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের একটা অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। আগের দিন বলে দেওয়া হয়েছিল, সকাল নয়টার মধ্যে উপস্থিত থাকতে হবে। এরপর আর ঢুকতে দেওয়া হবে না। নিরাপত্তা সংস্থাগুলো কঠিন সিদ্ধান্ত আগেই জানিয়ে দিয়েছে। সেই অনুযায়ী, সকাল সকাল তৈরি হয়ে ধানমন্ডি সাত মসজিদ রোডে প্রেসক্লাব পল্টনের বাসের জন্য অপেক্ষা করছি।

অফিস টাইমে ঢাকার গণপরিবহনের কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে ওঠে। সেই সময়টুকুতে বাস উঠতে হলে দোয়া পড়ে রীতিমতো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হয়। একের পর এক মোহম্মদপুর–মতিঝিল, মোহম্মদপুর–সায়েদাবাদ, মোহম্মদপুর–খিলগাঁওয়ের বাস যাত্রী নিয়ে চলে যাচ্ছে। কোনো কোনো বাস মোহম্মদপুর থেকেই আসনভর্তি যাত্রী নিয়ে দরজা লক করে চোখের সামনে দিয়ে শাঁই করে চলে যাচ্ছে। তারা যদি অপেক্ষারত শত শত আফিসগামী যাত্রীর ৫–১০ জন করে দাঁড় করিয়েও নিয়ে যেত, তাহলে কিছু মানুষ সময়মতো তাঁদের কর্মস্থলে স্বাচ্ছন্দ্যে পৌঁছে যেতে পারতেন।

অনেক দিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ি দেখে তাই ভেবেছি। কিন্তু ভেবে কি হবে, ঢাকা শহরে তো কারও জন্য কেউ ভাবে না। যার যেভাবে খুশি, সেভাবেই চলছে। এসব যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চলতে–ফিরতে কত ভেবেছি, তার হিসাব নেই। তারপরও সকাল থেকে বিকেল, কাজ, অফিস সেরে বাসায় পৌঁছতে পারার মধ্যে একটা শুকরিয়া ছিল।

পাবলিক বাস
ফাইল ছবি

কিন্তু সেদিন প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান, তার ওপর সকাল নয়টার মধ্যে কার্ড দেখিয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের কাজ শেষ করে মেইন প্যান্ডেলে পৌঁছাতে হবে—এসব ভেবে নিজের মধ্যে তাড়া জাগল। এদিকে কোনো বাস থামছে না। রাস্তায় জ্যামের কারণে কিছু গাড়ি ধীরগতিতে চলছিল। যেগুলোর দরজা খোলা ছিল, তাদের এত বেশি যাত্রী উঠেছিল পাঁচ–সাতজন হাতল ধরে ঝুলে আছেন। উচ্চ ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা যাত্রা করছেন। হয়তো সময়মতো পৌঁছাতে হবে বলে। এসব দেখে নিজের মধ্যে ভয় ও বিরক্ত লাগছিল।

বাসগুলোতে যাত্রীর চাপ দেখে মনে হচ্ছে আজকে আর প্রেসক্লাবে যাওয়া হবে না। আর যেতে হলে ভেতরে দাঁড়ানো যাবে—এমন বাসে দৌড়ে লাফিয়ে উঠতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। ভাবতে ভাবতে মনের মধ্যে হিরো ভাব চলে আসছে। এরই মধ্যে মোহম্মদপুর–খিলগাঁওয়ে চলাচলকারী একটি বাস এল। নতুন রং করা। তারা মোহম্মদপুর থেকে সিট ক্যাপাসিটি যাত্রী নিয়ে দরজা বন্ধ করে আসছে। রাস্তা থেকে আর যাত্রী ওঠাইবে না। কিন্তু জ্যাম থাকায় গাড়িগুলো গতি কমছে, হঠাৎ বাড়ছে—এমন করে চলছিল। আমি বাসটাকে টার্গেট করে তার গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দৌড় দিতেই মুহূর্তের মধ্যে গাড়ির গতি দ্বিগুণ হয়ে গেল। বুঝতে পারছি আমি কঠিন বিপদে ফেঁসে গেছি। আমাকে হয়তো দরজায় ধরে ঝুলে যেতে হবে, তা না–হলে আমি বাসের পেছনের চাকায় পিষ্ট হব। লাফিয়ে দরজা শেষ দিকে বাম হাত এবং ডান হাত দিয়ে ধরতে পারলাম দরজার পাশে প্রথম সিটের জানালায়, তখন ভাবছি আমি নিজেকে নিরাপদ করতে পেরেছি। কিন্তু না, এরই মধ্যে বাসচালকের সহকারী আমার ঝুলন্ত শরীরে সজোরে বরাবর ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করল। কোনোমতে আমি শক্ত করে ঝুলে পরমুহূর্তে বাসে মধ্যে ঢুকে যাই। বাসচালকের সহকারীকে মারতে গিয়েও মারিনি। তখনো আমার বুক ধড়ফড় করছে। ঘটনা বাসের যাত্রীরা দেখেছেন। আমি ভাবছি, তাঁরা আমায় সমর্থন করবেন। কিন্তু কেউ টুঁ শব্দ করলেন না।

বাসটিতে দাঁড়ানো যাত্রী একমাত্র আমি। চোখে পড়ল একেবারে পেছনে সিট খালি। সেদিকেই বসতে যাচ্ছি, এমন সময় আমার বয়সী একজন বাসচালকের সহকারীকে উদ্দেশ করে বলে উঠলেন, এই, ধাক্কা দিয়ে ফালায় দিলি না কেন? আমি তাঁর কথা শুনে থ বনে গেলাম, সঙ্গে বিরক্তও হলাম। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে বলে উঠলাম, দেশে আর থাকা যাবে না। দ্রুত এই শহর ছাড়তে হবে। নিজে নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এলিফ্যান্ট রোডে গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে, সামনে শাহবাগ। দেখছি, গাড়ি থামল, ছেলেটা নেমে গেল। হাঁটার ধরনে মনে হলো, হয়তো ছাত্র নেতা হবে! মেজাজ দেখে আবার মনে হচ্ছে কোনো কারণ সে নিজের ওপর বিরক্ত। হাইকোর্ট পার হয়ে প্রেসক্লাব। নামার সময় বাসচালকের সহকারীর হাতে ভাড়ার টাকা দিয়ে বললাম, তুই তো আজকে আমাকে মেরেই ফেলছিলি। সময়মতো পৌঁছে অনুষ্ঠানস্থলেও প্রবেশ করি। কিন্তু চলন্ত বাসের দরজায় ঝুঁকির মধ্যে থাকা এক যাত্রীকে কীভাবে, কোন বিবেকে বাসচালকের সহকারী ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে যায়, তা দেখে চালক চুপ থাকে, অন্য যাত্রীরা সমর্থন করেন, সেই প্রশ্ন পুরো সময় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। উত্তর মেলাতে পারিনি। কোনো মতে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান কাভার করে অফিসে যাই। সেখানে কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে রাত। কিন্তু ঘটনার রেশ থেকেই যায়।

প্রতিদিন ঢাকা শহরে কত মানুষ রাস্তায় বের হয়। সবাই কি বাসায় ফেরে? ফেরে না। এই শহরে কত মানুষ অন্যের খামখেয়ালির বলি হয়ে যাচ্ছে তার হিসাব রাখারও কেউ নেই। ঢাকার অব্যবস্থাপনার ভয় আমার মনে সব সময় কাজ করত। ছোট থেকে খবরের কাগজে পড়েছি। বড় হয়ে শহরে চলেই দেখালাম। আর শেষমেশ নিজেই শিকার হয়ে যাচ্ছিলাম।