দেখা হয়েছিল
সে বছর (১৯৯০ সালের কথা) বেইজিংয়ে খুব গরম পড়েছিল। আমি চীনের রাজধানীর কথা বলছি। চীনে সামারের তিনটি মাস চান্দি ফাটানো গরম পড়ে। কিন্তু তাপমাত্রার হিসাবে এ গরম আমাদের বাংলাদেশের থেকে একটু ভিন্ন মনে হয়। তবে অন্য মাসগুলো বিভিন্ন রকমের, নির্ভর করে চীনের কোন শহর এবং কোথায়, তার ওপর। আমি থাকি সুইডেনে, সেখানে খুব ঠান্ডা, তাই স্বল্প সময়ের জন্য কোথাও গরম হলে খুব বেশি গায়ে লাগে এবং ভালোই লাগে।
আমি সুইডেন থেকে কাজে গিয়েছিলাম বেইজিংয়ে। স্টকহোম থেকে বেইজিংয়ে বিমানে ৯ ঘণ্টার মতো সময় লাগে। প্রায়ই তখন স্টকহোম থেকেই দেশ-বিদেশে ফ্লাই করি। আমি সব সময় চেষ্টা করি প্লেন এমনভাবে নিতে, যাতে রাতে ঘুমতে ঘুমতে ফ্লাই করা যায় এবং সকালে গিয়ে সেসব দেশে গিয়ে হাজির হই। এ অভ্যাস অনেক বছর ধরে অর্জন করেছি।
আমি আবার মাগুরার ছেলে। মাছ, নানা ধরনের পিঠা, নদী আর খেজুরের রসে মাগুরা বেশ পরিচিত। তাই দেশে থাকতে ঢাকা থেকে দেশের বাড়িতে যেতে নদী পারাপার ছাড়া তখন গতি ছিল না। বাংলাদেশে অনেকের সঙ্গে যখন আলাপ করি তখন শুনি, বাস, ট্রেন এবং ব্রিজের যুগ হলেও আরিচা ঘাট লঞ্চ বা ফেরিতেই যাতায়াত করতে হয়। বহু যুগের পুরোনো অভ্যাস ছাড়ে কী করে! তা ছাড়া ফেরি চলাচলে আরাম আছে। ইলিশ মাছের পাতলা ঝোল, সঙ্গে ভাত—বাংলার জাহাজে রাজকীয় যাতায়াতের মধ্যে মজা আছে। বাংলাদেশে বাস বা গাড়িতে জান হাতে নিয়ে চড়তে হয়। প্রায়ই শুনি, বাস, ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তার বাইরে ছিটকে পড়ে। লঞ্চ ডুবে যায়, তারপরও কেন যেন বাংলাদেশের লঞ্চের জার্নিতে মজাই আলাদা। আমি আবার বাসে উঠতেই ঘুমিয়ে পড়তাম। তাই আমি বাংলাদেশের মতো বিশ্বভ্রমণে প্লেনে উঠে প্রথমেই মহাশান্তিতে এক ঘুম মারি।
বেইজিংয়ে কয়েক দিন থেকে কাজ শেষে টোকিওতে যাব। আমি হোটেল থেকে সকাল সকাল চলে এসেছি। বিমানবন্দরের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছি। হঠাৎ খিদে লেগেছে। বিমানবন্দরের কাছাকাছি দেখলাম, ভিয়েতনামিদের অনেক খাবারের দোকান। পচা খাবার না তো? পচা না বলে বাসি বলাই ঠিক হবে। তবে পথে যখন নেমেছি, তখন পচা খেতেও আপত্তি নেই।
খাবার নিলাম। খেতে ভালোই। ভিয়েতনামি খাবার খেতে ভালো লাগে। বিমানবন্দরে কাছের এক মাঠে পা মেলে বসে আরাম করে খাচ্ছি। আমার ঠিক কাছে আরেকটি মেয়ে বসে বসে খাচ্ছে। তার সঙ্গে বড় একটি ব্যাগ। মেয়েটি খুব আরাম করে ঘাসের ওপর বসে খুঁটে খুঁটে খাবার খাচ্ছে। কোনো দিকে নজর নেই। আমি একটু গলা চড়িয়ে, মেয়েটি যাতে শুনতে পায়, বললাম, ‘বন এপেটাইট।’ মেয়েটি আমার দিকে ঘুরে তাকাল, বলল, ‘হাই।’ এই সুযোগে জিজ্ঞেস করলাম, ‘খাবার খেতে নিশ্চয়ই ভালোই টেস্ট, মনোযোগ দেখে তা-ই কিন্তু মনে হচ্ছে!’ মেয়েটি বলল, ‘টেস্ট না ছাই। চার ঘণ্টা পরে প্লেন। বিমানবন্দরে খাবারের অনেক দাম। সেই রাতে, কখন প্লেনে খাবার দেবে। তাই খেয়ে নিচ্ছি। আর তুমি?’ এবার মেয়েটি জানতে চাইল আমার বিষয়ে।
উত্তরে বললাম, ‘আমার প্লেনও চার ঘণ্টা পর। তা তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ মেয়েটি বলল, ‘টোকিও’। আমি বললাম, ‘আমিও সেখানে যাব।’
আমি মনে মনে ভাবলাম, একই প্লেন যেন হয়। মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলাম, ওহে দয়াময়, মিলিয়ে যখন দিয়েছ, আরেকটু কাছাকাছি করে দাও। একই প্লেন আর সিটটাও যেন পাশাপাশি হয়। এর মধ্যে মেয়েটি আমার কাছে এসে বসল। খাবারে এত ঝাল যে ঝালে মেয়েটির চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। আমি বললাম, ‘তুমি একটু বসো আমি আসছি।’ তার জন্য আইসক্রিম কিনে আনলাম।
তার নাম আনিকা। নরওয়ের মেয়ে। খাবার শেষে আনিকা আর আমি বাসে চড়ে একসঙ্গে এয়ারপোর্টে এলাম।
এসে দেখি, আমাদের একই প্লেন। আল্লাহ মহান। মনে মনে বললাম, ‘সবই তো করলে, এবার সিট দুটি পাশাপাশি করে দাও।’ প্লেনে উঠলাম সিট পাশাপাশি হলো না। একটু দূরে দূরে। তবে বেশি দূরে না। চোখাচোখি হওয়ার মতো কাছে। আমরা হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলতে পারব। ইশারা ইঙ্গিতে, চোখের দৃষ্টিতে। পরে দেখি, প্লেনে বেশি যাত্রী নেই। অনেক সিটই খালি।
আমরা SAS-এ ফ্লাই করছি। আমি যেহেতু সুইডিশ জানি। চীনে সুইডিশ জানা থাকলে স্ক্যান্ডিনেভিয়ানদের কাছে সাত খুন মাফ। এয়ার হোস্টেসকে বললাম, আমাদের সিট পাশাপাশি করে দাও। সঙ্গে সঙ্গে সিট পাশাপাশি হয়ে গেল। আনিকা অবাক হলো শুনে যে আমি বাংলাদেশি সুইডিশ, রাতে প্লেনে অনেক কথা হলো। গল্পের পর গল্প বলতে বলতে কখন ঘুমিয়ে গেছি, জানি না। ঘুম থেকে উঠে দেখি, আনিকা মহা আয়াসে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। আমি মনে মনে গাইছি, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো, তুমি বলো তো?’
রাত শেষ হয়ে সকাল হয়ে গেল। ব্রেকফাস্ট ছেড়ে ল্যান্ড করলাম। আনিকা এসেছে বেড়াতে, তার বাবার কাছে। আনিকার বাবা টোকিওতে নরওয়ের রাষ্ট্রদূত। আমি এসেছি কাজে। কাজ করব প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা, তারপর ফ্রি। বললাম, ‘তাহলে আমার কাজ শেষে তুমি আর আমি সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে পারব।’ আনিকা বলল, ‘আজ হবে না, তবে কাল থেকে সম্ভব।’ টোকিওতে আমি থাকব এক সপ্তাহ, আনিকা অনির্দিষ্টকালের জন্য। বয়স আমার খুব একটা বেশি না, সিঙ্গেল জীবন, একটু-আধটু প্রেমে পড়াটাই স্বাভাবিক। আনিকার সঙ্গে এমন কিছু ঘটেনি, তবে তার প্রতি কিছুটা করুণা হয়েছে।
বেচারি, প্রেমে ঘায়েল হয়েছে। আনিকার বয়ফ্রেন্ড আনিকার ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর সঙ্গে ঘটনা ঘটিয়েছে এবং আনিকা বিষয়টি জানতে পেরেছে। নিজের বয়ফ্রেন্ড এবং নিজের বান্ধবী কীভাবে এমনটি করতে পারল, এটাই তাকে কষ্ট দিয়েছে। তাই অসলো ছেড়ে ভাবছে বাবার সঙ্গে কিছুদিন থাকবে। প্লেনে পরিচয় এবং স্বল্প সময়ে মনের কথা শেয়ার করেছে, সেই জন্যই সব জানা। আমার হোটেলের ঠিকানা জানা সত্ত্বেও দুই দিন হয়ে গেছে, আনিকা আসেনি। ভাবলাম, হয়তো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বা বিষয়টি বিমানবন্দরেই শেষ হয়ে গেছে। যাহোক, আমি আমার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। টোকিও ছেড়ে দুই দিনের জন্য কিটিওতে এসেছি। কিটিও জাপানের অন্য একটি শহর। কাজ শেষ, ফিরতে হবে স্টকহোমে। শেষের দিন টোকিওতে শপিং করা থেকে শুরু করে ঘোরাঘুরি করলাম, শেষের রাত জাপানিজদের সঙ্গে। সকালে এয়ারপোর্টে এসে প্লেনে ঢুকে দেখি, আমার পাশের সিটে আনিকা বসে আছে। বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার তুমি? এক সপ্তাহ কোনো যোগাযোগ করলে না! বলেছিলে অনির্দিষ্টকালের জন্য এসেছ, হঠাৎ ব্যাক টু অসলো নাকি বেইজিং?’ উত্তরে বলল, ‘না টিকিট কেটেছি সরাসরি স্টকহোমে যাব। তুমি আজ ফিরবে জানতাম, কিছুটা সারপ্রাইজ এবং যদি তুমি চাও কয়েক দিন তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে চাই স্টকহোমে।
’ আমি বললাম, ‘বলো কী? তোমার মাথা ঠিক আছে তো? আগুন নিয়ে খেলা?’ আনিকা বলল, ‘মানে?’ আমি বললাম, ‘আমি সিঙ্গেল, রুম একটা, আমার সঙ্গে থাকবা, হঠাৎ যদি ঘটনা ঘটে যায়, তখন পুরো দোষ হবে আমার। না বাবা, বিশ্বাসের অবমাননা করতে পারব না। তবে আমার বাসার পাশে একটি হোটেলে তুমি কয়েক দিন থেকে বাড়িতে চলে যেয়ো।’ আনিকা বলল, ‘ঠিক আছে।’ এই শর্তে রাজি হয়ে চলে এলাম স্টকহোমে। আনিকাকে নিয়ে কয়েক দিন ঘোরাঘুরির পর বিদায়ের পালা। যাওয়ার বেলা হাত দুটি ধরে বলেছিল, ‘আবার দেখা হবে, তবে হোটেলে নয়, তোমার সঙ্গে এবং তোমার রুমে।’ আনিকার কথাবার্তা শুনে মনে পড়ে গেল স্বপ্ন বসুর ভাওয়াইয়া গান, ‘মুইতো পিরিত করং না, চ্যাংরা বন্ধু ছারে না, আরও দিয়া যায়, পিরিতের বায়না...’।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন