দূরে বহুদূরে হৃদয়ের মাঝে...

একটি জীবনের জন্য ২৫টি বছর নিতান্তই কম নয়, অনেক দীর্ঘ সময়। তদুপরি যদি হয় প্রবাসজীবন। স্বজন ও স্বদেশবিহীন কষ্টক্লান্ত কঠিন জীবন। যেখানে সময় নেই। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত থাকতে হয় অবিশ্বাস্য জীবনসংগ্রামের সাইক্লোনে। ২৫ বছর আগে যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছে সে আজ দুরন্ত যুবা। দুই যুগেরও বেশি প্রবাসজীবনে মাত্র দুবার দেশে গিয়েছি হৃদয়ের টানে।
কবির ভাষায় যখন নিজের অজান্তেই বারবার বলতে ইচ্ছে হয়—স্বদেশ কী গাঢ় সবুজ মায়াভূমি/অমল মাখামাখি জ্যোৎস্না/তাই কী, যত দূরে ফেলে আসি/তত কঠিন বাঁধনে আঁকড়ে ধরে প্রাণের রজ্জুতে।/এ বড় বৃহৎ প্রেম সতত স্বজনের প্রতি...।
দেশে যাব, দেশে যাব বলে প্রবাসের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ আমাকে তাড়িয়ে বেড়াত। কষ্ট–কঠিন কর্মক্ষেত্রে, নিদ্রায়-জাগরণে, স্বদেশকে নিয়ে বুনেছি কত সহস্র সহস্র স্বপ্নের মালা। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় তবুও আসে না সেই শুভক্ষণটি।
আমি আমার জন্মভূমি বাংলাদেশের এক নিতান্তই নিভৃত পল্লির সন্তান। আমার প্রিয় গ্রাম আমাকে টানে। ধলাই নদীর স্রোত আমাকে টানে। মুক্তিযোদ্ধা বৃদ্ধ আফতাব চাচা হাতে হুঁকো নিয়ে খেতের আল ধরে বাড়ি ফেরার পথে আমাকে যেন বলছেন, কেমন আছ বাবা তুমি?
ফেলে আসা প্রিয় গ্রাম, গ্রামের মানুষ, পরিচিত জনপদ আমাকে টানে, ফিরিয়ে নিয়ে যায় ফেলে আসা অতীত বিন্যাসে শৈশব আর কৈশোরের স্বর্ণালি দিনে কিংবা যৌবনের আকাশ কাঁপানো জয় বাংলার উত্তাল স্লোগানে।
ভোরের কুয়াশা অন্ধকারে কোনো গ্রামের মাইকবিহীন মোয়াজ্জিনের কণ্ঠে ফজরের আজানের ধ্বনি আমাকে এখনো নিয়ে যায় সেই শৈশবের কাদামাখা দিনগুলোতে। ভোরের মাইকবিহীন আজানের ধ্বনি আর ত্রিসন্ধ্যায় কাসা-শঙ্খ-ঘণ্টা আর উলুধ্বনি আমার কাছে বড় বেশি পবিত্র মনে হতো। তা ছিল যেন ধর্ম-বর্ণ হিংসা-বিদ্বেষহীন একটি অসাম্প্রদায়িক পৃথিবী গড়ার ডাক। মানে অসাম্প্রদায়িক প্রিয় বাংলাদেশ।
প্রবাস জীবনে প্রায় ২৪-২৫ বছরের মধ্রে ১৭ ধরে খুব বিশ্বস্ততার সঙ্গে একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছিলাম। প্রবাসে ১৭ বছর একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা কম কথা নয়। এ দেশে এক নাগাড়ে দীর্ঘ কয়েক বছর একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করা মানেই সুনাম ও বিশ্বস্ততার প্রতীক। শুরু করেছিলাম খুবই ছোট ও কষ্টের কাজ দিয়ে। কাজটি কঠিন ও কষ্টের হলেও ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদ ম্যানেজারের দায়িত্বে অধিষ্ঠ হয়ে দীর্ঘ কয়েক বছর কাটিয়েছি সুনামের সঙ্গে।

তৃতীয় বিশ্বের এক পাড়া গায়ের সন্তান হিসেবে ও ফ্রেঞ্চ আর ইংলিশ ভাষার জাঁতাকলে তা কম কথা কী? এখানে কাজের কোনো নিশ্চয়তা যেমন নেই তেমনি যে যার খুশি মতো কাজ ছাড়তে পারে, ধরতে পারে এবং কাজ বদলাতে পারে। কাজের শ্রেণি বিন্যাস থাকলেও কে কোন কাজ করছে তা নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। সবার ডলারের দরকার। তাই কাজের প্রয়োজন। কাজ থাকলে আনন্দমুখর পরিবেশে পরিবারপরিজন নিয়ে সুন্দরভাবে সংসার চালানো। যায় ফলে একজন ভালো চাকরিজীবীরও বাড়তি আয়ের জন্য অন্য কাজ করতে দ্বিধাবোধ নেই। এখানে ছোট-বড় কাজ বলতে কিছু নেই। চিকিৎসক–প্রকৌশলী, রেস্টুরেন্টের বয়, হেলপার, সরকারি চাকরিজীবী থেকে ঝাড়ুদার সবই সমান। যেকোনো কাজ করলে লজ্জা নেই, না থাকলেই লজ্জা।
যাক হঠাৎ করে গত ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে গ্লোবাল ক্রাইসিসের কারণে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। যা কিনা আমার জন্য ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হওয়ার পর হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিলাম যা হওয়ার হবে দেশে চলে যাব বেড়াতে। যেমন কথা তেমনি কাজ। সঙ্গে সঙ্গে মন্ট্রিয়েলের সুপরিচিত ট্রাভেল কনসালট্যান্ট সত্যব্রত হালদার দাদাকে ফোন করে টিকিটি বুকিং দিয়ে দিলাম। ২৯ জুন ২০০৯ তারিখের গালফ এয়ারলাইনসের টিকিট পাওয়া গেল। হাতে দুই মাস, আমার জন্য দীর্ঘ সময়। প্রাণে আর সইছিল না, দুই মাস যেন দুই বছর।
আমরা সব সময় স্মৃতিঘেরা মানুষ। স্মৃতিকে চোখের সামনে এনে ভাবতে কতই না ভালো লাগে। আমরা তো প্রতিদিনের স্মৃতি নিয়েই চলছি অবিরত দিনের পর দিন। ধাবমান সময় ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে। শৈশব-কৈশোর, যৌবন থেকে বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যায় সবাই। প্রতিদিন গুচ্ছ গুচ্ছ স্মৃতি শুধু জমা হয় জীবনের খাতায়। ফেলে আসা স্মৃতি প্রতিটি মানুষকেই কোনো না কোনো সময় নিজের অজান্তেই কাদায় ভাবিয়ে তুলে। সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনা রাগ অভিমান চাওয়া পাওয়া সবকিছুই তো জীবন যাপনের নিত্যসঙ্গী হয়ে স্মৃতির ভান্ডারে জমতে থাকে।
বাংলাদেশ মানে আমার প্রিয় জন্মভূমি-মাতৃভূমি-পিতৃভূমি-প্রিয় স্বজন ঘেরা চিরচেনা জনপদে ফিরব মানেই প্রকৃতির কাছে ফিরব। প্রিয় চেনা নিসর্গের দুর্বার আকর্ষণ আমাদের টেনে নিয়ে যায় স্বদেশি প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতির কাছে ফেরা মানে আমাদের আদিতে ফেরা, শেকড়ের মমতায় ফেরা, মাটির কাছে ফেরা, অরণ্যের কাছে ফেরা, সবুজের কাছে ফেরা, মমতাময়ীর কাছে ফেরা স্বজনের কাছে ফেরা, মার আঁচলে বাঁধা স্নেহ মমতা আদরের কাছে ফেরা। স্বপ্ন-সত্য আর সুন্দরের কাছে ফেরা।
অনেক দিন পর স্বদেশে ফিরব, বাড়ি দেখব, স্বজনের সঙ্গে কটি সপ্তাহ কাটিয়ে আসব সুখ দুঃখের অংশীদার হয়ে, কানাডায় জন্ম নেওয়া এবং এ দেশের মাটি আবহাওয়া ও সংস্কৃতি তে বড় হয়ে ওঠা সন্তানরা দেখবে পিতৃপুরুষের মাটি, সে কী আনন্দ। যদি এই ২৫ বছরে অনেককেই হারিয়েছি। অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলেছি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতির ভান্ডারটাও দিনে দিনে ক্ষীণ হয়ে আসছে তবুও ফেলে আসা শৈশব আর কৈশোরের সোনামাখা স্মৃতিগুলো আমাকে এই প্রবাসে বারবার তাড়িত করে নিয়ে যায় সেই দিনগুলোর মাঝে অতীত বিন্যাসে। (চলবে)
(সদেরা সুজন: প্রধান নির্বাহী, কানাডা–বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (সিবিএনএ), কানাডা)