নারী দিবসের ভাবনা–৩
আমার জীবনে নারী দিবসে আমি বলব কিছু সুপুরুষের কথা।
আমার দাদা আমায় সব সময় বুবু বলে ডাকতেন। কোনো দিনও তার চোখে আমি বৈষম্য দেখিনি। দাদিকে পাগলের মতো ভালোবাসতেন। আমার চিকিৎসক হওয়ার প্রেরণাও তিনি। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় উৎসাহ দিয়েছেন। তাঁর কাছেই পুঁথিপাঠ শোনা। ‘বিষাদসিন্ধু’ শুনে বড় হওয়া। ছোটবেলা থেকেই সম্মান পেতে শেখা আমার তাঁর কাছে!
মা–বাবা অবশ্যই বিশাল ভূমিকা রাখেন। আমাদের সংসারে আমি বাবার আদর আর ভালোবাসার কথাই বলব। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন মহিরুহ হয়ে।
ছেলেবেলায় পরীক্ষার আগে বই না–ছোঁয়া আমি, পরীক্ষায় পাস না ফেল তা নিয়ে মাথা না–ঘামানো আমি, একটু একটু করে কীভাবে যেন বাবার স্বপ্নকে নিজের করে নিয়েছিলাম!
ভাইয়েরা ছিলেন ছায়া হয়ে!
স্বামী! না বললেই নয়—এতটুকু মোমের পুতুল ঘরে তুলে নিয়ে তাকে ঘষেমেজে স্বাবলম্বী বানিয়েছে। মেয়ে বলে ছাড় পাব, সেটা শিখিনি ছোটবেলা থেকেই। বরং মেয়ে বলে এক্সট্রা লং পথ পাড়ি দিতে হয়েছে...। প্রতিটি ছেলেমেয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেকে গড়ে তুলতে হয়েছে। স্কুল–কলেজে বরং অনেক মিন গার্লস আর তাদের ক্যাট ফাইটের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। মেয়েরা মেয়েদের শত্রু—এ কথা আমি ১১০% বিশ্বাস করি। দোষ সেসব মেয়েদের কি না, জানি না। তবে জীবন নিশ্চয়ই তাদের প্রবঞ্চনা করেছে বলেই তারা অমন বলব আমি!
স্বামী কোনো দিন বলেনি, এটা রান্না কর, কি ওটা—সেদ্ধ না হলেও খেয়ে নিয়েছে বিনা বাক্য ব্যয়ে। এ ছাড়া বাচ্চাদের ডায়াপার চেঞ্জ থেকে ঘুম পাড়ানো। সময়মতো ড্রাইভিং শেখানো, দেরি হলেও কখনো নিজের রাস্তা থেকে সরে না আসা আর তাতে লেগে থাকা শেখানো, এই লোক না হলে হতোই না। প্রতিটি জার্নি কঠিন ছিল। তবে ছাদ হয়ে, ঢাল হয়ে আমায় অবিচল রেখেছে। প্রতিটি পদে পাশে থেকেছে সাপোর্ট হয়ে!
শ্বশুরের কথাও না বললেই নয়। বিয়ের পর যেন আমার আরেকটি বাবা। আমার সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য এবং পড়াশোনার প্রতি তাঁর যে আগ্রহ ছিল, সত্যিই আমি নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করি ওনার মেয়ে হতে পেরে।
ছেলের কথাও বলি। সে আমাকে না দেখলে ঘুমাতে পারত না। ঘুম ভেঙ্গে গেলে তার আমায় না দেখলে চলবে না, অথচ পড়ার সময় বিরক্ত করত না। কোলে বসে থাকত বা ওই পাশে বসে পড়ছি, সেটাতেই সে আশ্বস্ত হতো। আমার অসুস্থ হলে, সে সব ওষুধ, পানি, স্ন্যাকস নিয়ে চলে আসত সেবা করবে বলে। তার বাবা বাসায় না থাকলে আমার পাশছাড়া তো হতোই না, বরং সব দরজা, গ্যারেজ বন্ধ আছে কি না চেক করে, চুপটি করে পাশে ঘুমিয়ে থাকত। আমি আজ পূর্ণতা পেতাম না এসব ছেলেদের অসামান্য অবদান না থাকলে।
মা, মেয়ের অবদান খাটো করতে কখনোই পারব না। তবে যখনই ভাবি, আমার চোখের জল যাতে দেখতে না হয়, তার জন্য এসব ছেলেদের অবদান কোনোভাবেই খাটো করে দেখতে পারব না।
বন্ধুদের কথাও বাদ দিতে পারি না। পা ভেঙে ক্রাচ নিয়ে ক্লাস করতে দিয়ে আসত বান্ধবীরা পালা করে, আর তারপর টুলগুলো এগিয়ে দিত আমার বন্ধুরাই বসার জন্য। আমার কষ্টের মধ্যে মুখে হাসি ফোটাত তারাই, আগলেও রাখত মমতায়। চোখ বুজে আমি আমার বন্ধুদের বিশ্বাস করি। যেকোনো প্রয়োজনে আমার এই বন্ধুদের অবদান ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। হোক সে শর্ট নোটিশ, দুরূহ কাজ—আমায় দুবার ভাবতে হয়নি ওরা থাকায়!
একলা সময় বা বিপদের দিনে আমার ত্রাণকর্তা হিসেবেই পেয়েছি তাদের।
ভালোবাসি তোমাদের! Thanks for being there.
এমনকি কয়েকবারের সড়ক দুর্ঘটনায় রাস্তায় পড়ে থাকা থেকে যে বা যারা আমায় বারবার নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিয়েছেন, তারা সাধু পুরুষেরাই।
প্রতিটি মেয়ের সাফল্যে হাজারো লোকের সহায়তা লাগে। আমি গর্বিত ও ধন্য যে এসব লোকের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে! তারা আমার ভালোবাসার মানুষ, প্রিয়জন। রক্তের সম্পর্ক থেকে আত্মিক সম্পর্ক—কোনোটির মূল্যই কম নয়। আমার আমি হওয়ার জন্য আমি এদের সবার কাছে ঋণী। এদের সাধুবাদ না জানালে আমার পথচলা মিছে হয়ে যায়। প্রতিটি মেয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন, সংসার–সমাজে তাদের বেড়ে উঠতে দিন আপনাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলবার যোগ্যতায়।