দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ পেতে কী দরকার

দুর্নীতি
প্রতীকী ছবি

আমরা সবাই জানি আমাদের সমস্যা কী? এখন দরকার সমাধানের। সচেতন জাতি অজুহাত নয় খোঁজে সমাধান। আমরা জাতি হিসেবে যদি সচেতন হই, তবে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সমস্যা থাকার কথা নয়। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। কোথায়, কখন, কেন এবং কীভাবে ভালোবাসি? এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব খুঁজে বের করে সেই মোতাবেক কাজ করতে পারলে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ পাওয়া সম্ভব।

বয়স আমার তখন হবে ৮ থেকে ১০ বছর। এত অল্প বয়সে সবকিছু করার যোগ্যতা কম তখন। তবে আকাঙ্ক্ষা ছিল বিশাল এবং এটা থাকা খুবই স্বাভাবিক। আমি বয়সে তখন ছোট, তবে ঘটনাটি যে খুব বড়, সেটা বুঝতে সমস্যা হয়নি। সে যেমন-তেমন ঘটনা নয়, দেশ স্বাধীন করতে হবে, কারণ পূর্ব বাংলা থেকে যাবতীয় সম্পদ অবাধে পাচার হতে শুরু হতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানে। আইয়ুব খান করাচি থেকে রাজধানী সরিয়ে ইসলামাবাদে স্থানান্তরিত করলেন, তার সিংহভাগ খরচ বহন করল পূর্ব পাকিস্তান।
পূর্ব বাংলা থেকে ব্যাপকহারে হিন্দু বিতাড়ন করা হলো, সঙ্গে সঙ্গে মৌলবাদের শিকড় দৃঢ় করে দিলেন আইয়ুব খান। ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন গঠন করে এমন একটি কৌশল করা হলো যে উচ্চশিক্ষার নাগাল সবার জন্য রইল না আর শিক্ষার ব্যয়ভার খুব বাড়িয়ে দেওয়া হলো। তাতে দেশে অনগ্রসর শ্রেণি শিক্ষাবঞ্চিত থাকবে এবং শিক্ষার হার ক্রমে ক্রমে নিচে নেমে গিয়ে অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হবে, তারা জীবনের অধিকার সম্বন্ধে কখনো আর সচেতন হতে পারবে না। উঁচুতলার মানুষ তাদের থেকে সহজে ফায়দা আদায় করে নিতে পারবে। এমনি করে এ জাতি অন্ধ ও বিবেকহীন হয়ে পড়বে। কিন্তু বাংলাদেশের বিপ্লবী ছাত্রসমাজ দেশের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হলো এবং রুখে দাঁড়াল।

প্রথমবারের মতো আইয়ুব খানের স্বেচ্ছাচারিতা ধাক্কা খেল। কঠোর হাতে ছাত্রদের ওপর ডান্ডা ঘুরিয়ে দমন করতে গেলেন। ভাষাশহীদদের স্মৃতি রক্ষা ও একুশে ফেব্রুয়ারির সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে দিলেন আইয়ুব খান। পুনরায় রবীন্দ্রসংগীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। কিন্তু এটা করতে গিয়ে আইয়ুব খান বাঙালির কলিজার বোঁটা ধরে টান দিলেন। মরার আগে শেষ কামড় দিয়ে বাঙালি সে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিল; আইয়ুবের শিক্ষামন্ত্রী মঞ্জুর কাদির ঢাকা এলে তাঁকে ছাত্ররা প্রচুর লাঞ্ছনা করে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রবেশ করতে পারলেন না। ছাত্রদের শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে আইয়ুবের পতনের সূচনা ঘটল। তারপর আস্তে আস্তে বাঙালি জাতি শুরু করল আগাছা পরিষ্কার করতে। এটাই ছিল ঘটনা।

দুর্নীতি
প্রতীকী ছবি

সেই ঘটনাপ্রবাহ ঘটে চলেছে হৃদয়ে আজও। তবে স্বাধীন হয়েছি, নিজ দেশের পাসপোর্টে বিদেশে শিক্ষা গ্রহণ এবং জীবিকা অর্জন করার পাশাপাশি দেশের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির জন্য যা করণীয়, সেটা করে চলছি। স্বাধীন বাংলাদেশ পেতে, ছোটবেলায় ছিল অনুপ্রেরণা, উদ্দীপনা আর চেতনা।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পর হৃদয়ে বইছে এখন কীভাবে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ পেতে পারি তার জোয়ার। ছোটবেলার স্লোগান ছিল মুক্তির স্লোগান এবং স্বাধীনতাসংগ্রামের স্লোগান। এখনকার স্লোগান দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামের স্লোগান।

তখন যারা মুক্তিসংগ্রামে যোগ দেয়নি বরং বাধা হিসেবে কাজ করেছে, তাদের বলতাম রাজাকার। এখন যারা দুর্নীতিমুক্ত করতে বাধা হবে, তাদের বলব বেইমান, নেমকহারাম এবং ছিনতাইকারী। এদের চিরতরে ধ্বংস করতে হবে এবং যাঁরা এ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, প্রকৃতপক্ষে তাঁরাই হবেন সোনার বাংলার নাগরিক। তাঁরাই হবেন সোনার বাংলা গড়ার কারিগর।

তবে হুট করে কিছু করা ঠিক হবে না। মনে কি পড়ে, আইয়ুব খানের বুলি ছিল দুর্নীতিমুক্ত পাকিস্তান বানাতে হবে। দেখা গেল শুরু থেকে দুর্নীতিই হলো পাকিস্তানের নীতি, যার কোনো জবাবদিহি ছিল না। আর তার দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এক উদ্ভট ব্যবস্থার উদ্ভাবন করা হলো, সেটি হলো মৌলিক গণতন্ত্র, যে মৌলিক গণতন্ত্রীদের কাজই ছিল দুর্নীতির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকা।

দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ উপলক্ষে জিলা স্কুলের সামনের সড়কে বগুড়া জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। কর্মসূচিতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা করার শপথ নেয়।
ছবি: সোয়েল রানা, বগুড়া

কারণ গাছের ওপর যখন পরগাছা জন্মায়, তখন বেশ সতর্কতার সঙ্গে আগাছাকে পরিষ্কার করতে হয়, নইলে মূল গাছটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, এমনকি মারাও যেতে পারে। ঠিক তেমনিভাবে আমাদের নিজেদের মধ্যে যেসব দুর্নীতিবাজ বিরাজ করছে, তাদের সরাতে গিয়ে দেশপ্রেমিক ও আত্মত্যাগী ভালো মানুষ যেন বিলীন হয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

পাকিস্তানিরা উড়ে এসে পরগাছার মতো জুড়ে বসেছিল। তারপরও তাদের উচ্ছেদ করতে প্রায় দুই যুগ সময় লেগেছে। বিনিময়ে ৩০ লাখ মানুষের জীবনসহ মা-বোনের ইজ্জত হরণ এবং মানসিক ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

অতীতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে, একই সঙ্গে সবকিছুর মোকাবিলা করতে হবে খুব সতর্কতার সঙ্গে। বাংলাদেশের দুর্নীতির ধরন অনেকটা ব্লাড ক্যানসারের মতো। শরীরের ব্লাড ক্যানসার হলে তাকে নির্মূল করা খুব কঠিন কাজ। ঠিক বাংলার দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষদের চিরতরে ধ্বংস করা কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ জাতির জন্য। প্রথমে কিছু হোমওয়ার্ক করতে হবে। প্রয়োজন একটি টু ডু লিস্ট তৈরি করা। তার আগে আমরা যে বাঙালি জাতি, তার পরিচয় এবং মিশন, ভিশন ও পলিসি সম্পর্কে অবগতি হতে হবে। যেমন কী, কেন, কখন, কীভাবে, কার জন্য ইত্যাদি প্রশ্নের যথাযথ উত্তর জানতে হবে। জানতে হবে নতুন করে কী উদ্দেশ্যে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম, যেটা চেয়েছিলাম সেটা পেয়েছি কি? উত্তর যদি ‘না’ হয়, তাহলে কেন সেটা পাইনি, তা জানতে হবে।

দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ পেতে বিসর্জন দিতে হবে অনেক কিছু, যেমন নিজ এবং পরিবারের মধ্যেই যে দুর্নীতি বিরাজ করছে, সেটাকে ধ্বংস করতে হবে আগে। তারপর দেশের পরিকাঠামোর ওপর কড়া নজর দিতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিবেশী ও বহির্বিশ্বের প্রভাব যেন না পড়ে অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধানে, সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে।
এসব কাজকে সঠিকভাবে মনিটরিং করতে দরকার একটি বিশেষ organization এবং সেটা হতে হবে cross functional team based oriented এবং তার মনিটরিংয়ের জন্য দরকার একটি সিস্টেম, যা হবে সহজ এবং নির্ভরযোগ্য। সর্বোপরি এই বিশেষ organization-এর মুখ্য দায়িত্বে একজন process owner নিয়োগ করতে হবে।
এই process owner-এর একটি সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা থাকবে, যেমনটি ছিল দেশ স্বাধীনের সময় বঙ্গবন্ধুর প্রতি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যেমন সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, ঠিক তেমন একটি রেভল্যুশন লিডারের দরকার। এখন প্রশ্ন, কে সেই সুন্দর, কে?

*লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন