
এমেন্ডার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাকিব গাড়িতে এসে বেশ কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল। অনেক দিন পর আজ সে বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিচ্ছে। প্রশান্তির নিশ্বাস। বিদায় নেওয়ার আগে এমেন্ডা বেশ কিছুক্ষণই তার হাত ধরে বসেছিল।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রাকিব ভাবল, এ এক বিচিত্র জীবন! ভালোবাসা, বিয়ে ও সংসার যাপন। এ এক বিচিত্র বৃত্ত। আজব কিছু সীমা ও পরিসীমা এই বৃত্তে একটা সীমাবদ্ধতার সৃষ্টি করে।
রাকিব বুঝতে পারল, কাছাকাছি থাকার চেয়ে বিচ্ছিন্নতাতেই ভালোবাসা অনেক গভীরে জিইয়ে থাকে। আজ ¾ তার দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, দীর্ঘদিনের কষ্ট ও যন্ত্রণা এক লহমায় যেন উবে গেল। এমেন্ডা চলে যাচ্ছে। অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। হয়তো আর কোনো দিন তার সঙ্গে দেখা হবে না। অনেক স্মৃতিই ক্রমান্বয়ে মুছে যাবে। কিন্তু তারপরও তো এই এমেন্ডাই ছিল তার প্রথম স্ত্রী। তার প্রথম জীবনের সঙ্গিনী। পাঁচটা বছর পাশাপাশি থাকা, কম তো নয়!
গাড়ি চালাতে চালাতে রাকিব আরেকটা বিষয় ভাবতে বসল, সেই অনির্ধারিত বিচ্ছিন্নতা যে এসেছিল, তাতে কী তার কোনো দোষ ছিল? সত্যিকারের ভালোবাসা নাকি অনেক কঠিন পথকে সহজ করে দেয়। অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে। কিন্তু সে কী কোনো অসম্ভবকে সম্ভব করেছিল, কিংবা কোনো কঠিন পথকে সহজ? সংসার জীবনে কোনো বিচ্ছিন্নতা এলে প্রত্যেকটা মানুষই নিজের দোষ খোঁজার চেষ্টা করে না। অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজের সাফাই গায়। তার নিজের ভেতর কী এমন কোনো মনোবৃত্তি ছিল? হয়তো সিরাজ একটা বাহানা হয়ে এমেন্ডা ও তার মাঝখানে ঢুকে গিয়েছিল?
এতসব ভাবনার মধ্যে রাকিব হঠাৎ গির্জার ঘণ্টার শব্দ শুনল। হয়তো কাছে কোথাও একটা গির্জা আছে। নিউজিল্যান্ডের ছোট বড় অনেক শহরে এখনো গির্জায় ঘণ্টা বাজানো হয়। এই সেই পুরোনো সংস্কৃতি ধরে রাখা। রাকিব পর পর বারোটা ঘণ্টার শব্দ শুনল। মানে বারোটা বাজে! ¾
ঠিক সাড়ে এগারোটার সময়ই এমেন্ডা রাকিবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তার অফিসে চলে গেছে। রাকিব ভাবল, এমেন্ডা আর কিছুক্ষণ বসে গেলে তো পারত? অফিসে তো সে বাদে কেউ নেই। সে নিজের মতো নিজে কাজ করছে। আর কিছুটা সময় না হয় অনুভূতির আদানপ্রদান হতো?
এমেন্ডা সময়ের ব্যাপারে আজ এতটা সচেতন হয়ে উঠেছে কেন? এই সময়ের ব্যাপারে সচেতন আরেকজন। সে হলো নদী। হঠাৎ নদীর কথা মনে পড়তেই রাকিব নড়েচড়ে বসল। রাকিব দিঘল টিমাতা রোড ধরে গাড়ি চালাচ্ছে। হেভলুক শহরটা অসংখ্য গাছে ঢাকা। প্রায় প্রত্যেকটা রাস্তার ওপর গাছগুলো এমনভাবে ঝুঁকে রয়েছে যে, মধ্য দুপুরের রাস্তাগুলোকে মনে হয় যেন চিত্রল হরিণের শরীর। এই রোদ, এই ছায়া। হলুদ চকরাবকরা।
রাকিব নদীকে নিয়ে আপাতত ভাবতে চায় না। এমেন্ডাকে নিয়েই ভাবনার সুতো ধরে রাকিব গাড়ি চালাচ্ছে। এখন সবে বারোটা বাজে। তার কোথাও গিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। সেই ব্লাফ হিল বা মেরিন প্যারেড। রাস্তাঘাট ফাঁকা। কাছেই তো স্থান দুটো। মাত্র পনেরো-বিশ মিনিটের ড্রাইভ।
রাকিব টিমাতা পিকে যাওয়ার কথা ভাবল। কাছেই তো। হেভলুক শহরের পাশ ঘেঁষে রঙ্গাকাকুর সেই টিমাতা পিক। কিন্তু পরক্ষণই মনে পড়ল, আহা, সে তার মেয়ের কবরটাতে তো এখনো যায়নি? গত এক সপ্তাহ ধরেই সে ভেবে এসেছে, হেস্টিংসে এসে এমেন্ডাকে নিয়ে মেয়ের কবরস্থানে যাবে। কিন্তু এমেন্ডাকে তো এ কথা বলাই হয়নি?
রাকিব নিজে নিজেই অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেল। এক মুহূর্ত কী ভেবে সে নেপিয়ারে দিকে না গিয়ে হেস্টিংসের দিকে রওনা হলো। হেস্টিংসের কারামু রোডের কবরস্থানে তার মেয়ে সাদিয়াকে কবর দেওয়া হয়েছে।
হেস্টিংস শহরে ঢুকে রাকিব একটা ফুলের দোকান খুঁজতে শুরু করল। ঘুরতে ঘুরতে সাউথল্যান্ডে স্ট্রিটে হাসপাতালের পাশে সে একটা ফুলের দোকান পেয়ে গেল। সেই দোকান থেকে সে একগুচ্ছ ফুল কিনে নেলসন স্ট্রিট ও ফ্রেডরিক স্ট্রিট ধরে সোজা কারামু রোডে চলে এল।
কারামু রোডের বামে একটা আঙুর বাগানের পাশে হেস্টিংস কবরস্থান। বড় বড় পাইন গাছে ঘেরা বিস্তৃত জায়গা নিয়ে কবরস্থানটা দাঁড়িয়ে আছে। কবরস্থানের সামনে সারি সারি কার পার্ক।
কার পার্ক প্রায় ফাঁকা। সাধারণত খুব সকালে মানুষজন কবরে ফুল দিতে আসেন। এখন মধ্য দুপুর।
রাকিব সেই কার পার্কে তার গাড়িটা পার্ক করে কবরস্থানে ঢুকল। কবরস্থানে ঢুকে মেয়ের কবরটা খুঁজে পেতে তার একটুও কষ্ট হলো না। কবরের মাথায় একটা ছোট্ট স্টোনের কাজ। তার মেয়ের নাম খোদাই করে লেখা—সাদিয়া আলম!
কতক্ষণ আগেই হেভলুক নর্থে এমেন্ডার কাছ থেকে নেওয়া প্যাকেটাতে রাকিব সাদিয়ার ছবিগুলো দেখেছিল। সেই হাসি হাসি চেহারা ও সেই হাসি হাসি মুখ! গায়ের রংটা তার পেলেও নাক, মুখ ও চোখ সব ছিল এমেন্ডার। মাত্র আড়াই বছরের বাচ্চা মেয়ে। ক্যানসার, লাস্ট স্টেজ...!
রাকিব ঝুঁকে সাদিয়ার নাম খোদাই করা পাথরটার সামনে ফুলের গুচ্ছটা দিতে দিতে সমস্ত কবরটাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। ভেতরে খুব কঠিন সে। কান্না অতি সহজে তার আসে না।
রাকিব স্থির হয়ে কবরের দিকে মুখ করে এবার চোখ বুজল। সে চোখ বুজল বেশ কিছুক্ষণের জন্য। তার সামনে সাদিয়ার সম্পূর্ণ অবয়বটা ভেসে উঠল। এক বছর সাড়ে চার মাস সে সাদিয়াকে সম্পূর্ণভাবে কাছে পেয়েছিল। তারপর একদিন সে দেখে, সাদিয়া সিরাজের কাঁধে চড়ে ঘুরছে। তাকে দেখলে তারস্বরে চিৎকার দেয়...!
তারপর মেয়ের স্বত্বাধিকার নিয়ে রাকিবকে বেশি দূর যেতে হয়নি। এমেন্ডা ল ফার্মে চাকরি করে। ভালো বেতন। নিজের স্থায়ী ঠিকানা আছে। ভাড়া হলেও নিজের বাস্তুভিটা। আর অন্যদিকে রাকিব চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভবঘুরে। আজ এ বাসায় থাকে তো কাল ও বাসায়। কোর্টকাচারি পর্যন্ত আর যেতে হয়নি। সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টই সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয়, সাদিয়া তার মা এমেন্ডার সঙ্গেই থাকবে। রাকিব হয়তো চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কোর্টে যেতে পারত। কিন্তু গিয়ে কী লাভ হতো? কোর্টকাচারি করে জজের হাতুড়ি পেটানোর শব্দ শুনত-অর্ডার, অর্ডার, অর্ডার! মেয়ের স্বত্বাধিকার বিনা বাক্যেই এমেন্ডার হাতে চলে যেত।
এর ঠিক এক বছর দুই মাস পরই সাদিয়ার ক্যানসারে মৃত্যু!
কবরস্থান থেকে বের হয়ে কার পার্কে রাকিব তার গাড়ির কাছে আসতেই তার চোখ পড়ল, কাছেই এক ভদ্রলোক গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক কিছু একটা খুঁজছেন। ভদ্রলোককে বেশ চেনা চেনা মনে হচ্ছে। রাকিব খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ভালো করে লক্ষ্য করতেই ভদ্রলোককে চিনতে পারল। আসাদুল করিম। অরচার্ড কন্ট্রাক্টর। দীর্ঘ দিন ধরে হেস্টিংসে বসবাস করছেন। তিনি একসময় হাছানুজ্জামান হাসানের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন।
রাকিব খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আস্তে করে ডাকল, আসাদ ভাই!
আসাদুল করিম মনোযোগ দিয়ে কারামু রোডের দীর্ঘ পথটা দেখছিলেন। রাকিবের ডাকে তিনি কিছুটা চমকে উঠলেন। কিন্তু পরক্ষণ তাকানো মাত্র তিনি রাকিবকে চিনতে পারলেন। তিনি উৎফুল্ল হয়ে বললেন, আরে, রাকিব যে! হেস্টিংস কবে এসেছ?
: জি, গতকাল।
: কোথায় উঠেছ?
: রিনেই ভাবির বাসায়।
: আমার বাসায় আসতে?
: আপনার ফোন নম্বর আমার কাছে ছিল না।
: রিনেই ভাবির কাছে তো মনে হয় আমার ফোন নম্বর আছে।
: হয়তো। কিন্তু আমার সে কথা মনে আসেনি।
: আজ আছ তো? আমি সন্ধ্যার পর ফ্রি আছি। বাসায়ই থাকব। সন্ধ্যায় একবার আস। আমাদের বাসায় আজ রাতে ডিনার কর?
: না, আসাদ ভাই। আমি আজ বিকেলেই চলে যাব। কাল সকালে আমার অফিস।
: ও, তা এত অল্প সময় নিয়ে এলে?
: একটা কাজ ছিল।
: অফিসের কাজ?
: না, ব্যক্তিগত কাজ। এ ছাড়া অনেক দিন হেস্টিংস আসি না। তাই একটু ঘুরতেও আসলাম।
: তুমি তো এখন হ্যামিল্টনে, তাই না?
: জি, আসাদ ভাই।
: আমি কয়েক মাস আগে হ্যামিল্টন হয়ে অকল্যান্ড গিয়েছিলাম। হ্যামিল্টন শহরের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে তোমার কথা মনে পড়েছিল। তোমার ফোন নম্বর থাকলে যোগাযোগ করতে পারতাম।
: আহা, একবার রিনেই ভাবিকে ফোন দিয়ে গেলেও তো পারতেন। তার কাছে আমার ফোন নম্বর সব সময়ই থাকে।
: আসলে হ্যামিল্টন যাওয়ার আগে তোমার কথা মনে পড়েনি। হ্যামিল্টন যাওয়ার পর মনে পড়েছে।
রাকিব মৃদু হেসে বলল, ও।
আসাদুল করিম জিজ্ঞেস করলেন, এখানে এই সিমেট্রিতে কি মেয়ের কবরটা দেখতে এসেছিলে?
রাকিব বলল, জি।
আসাদুল করিম আস্তে করে বললেন, ও!
রাকিব জিজ্ঞেস করল, আপনি এখানে?
আসাদুজ্জামান আসাদ একটু উষ্মা প্রকাশ করে বললেন, আর বলো না, কিছু চাইনিজ ওয়ার্কার নিয়ে বড্ড মুশকিলে পড়ে গেছি। ওরা না পারে ইংরেজি বলতে, না চেনে রাস্তা-ঘাট। অথচ ওদের কাছে জিপিএস আছে। আজ ক্লাইভ অরচার্ডে আমার কিছু কাজ বাকি ছিল। ওদের বলেছিলাম লাঞ্চের পর কাজটা গিয়ে করে দিতে। কিন্তু ওরা নাকি অরচার্ড খুঁজে পাচ্ছে না। পথ হারিয়ে ফেলেছে। কারামু রোড তো মেইন রোড। আর সিমেট্রিক কার পার্কটাও মিস করার কথা না। ওদের বলেছি এখানে আসতে। তাই ওদের জন্য এখানে অপেক্ষা করছি।
রাকিব মৃদু হাসল। কিছু বলল না।
এ সময় রাকিব দেখল কবরস্থানের কার পার্কের দিকে একটা মাইক্রো ঢুকছে। আসাদুল করিম তা দেখে বললেন, ওই দেখ, নবাবরা এসেছে! এক ঘণ্টা নষ্ট করে এতক্ষণে কারামু রোডের সিমেট্রি খুঁজে পেয়েছে। বলেই তিনি সেদিকে যেতে গিয়ে আবার কী মনে করে রাকিবের কাছে ফিরে এলেন। বললেন, ও হ্যাঁ, তোমার ফোন নম্বরটা দাও। নেক্সটে হ্যামিল্টন হয়ে গেলে যাতে তোমার সঙ্গে দেখা করে যেতে পারি। অকল্যান্ড যাওয়ার সময় এত লং জার্নিতে মাঝখানে কোথাও রেস্ট নিয়ে গেলে ভালো হয়। তোমাদের হ্যামিল্টন রাস্তার মাঝখানে পড়ে।
রাকিব বলল, শিওর আসাদ ভাই। আপনি আমার বাসায় এলে খুব খুশি হব।
: হ্যাঁ, অবশ্যই যাব। তবে অকল্যান্ডের দিকে খুব একটা যাওয়া হয় না। অকেশনালি যাওয়া হয়।
: যখনই যান, আমাকে ফোন দেবেন।
আসাদুল করিম মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ। ফোন নম্বরটা দাও তাহলে।
রাকিব মুখস্থের মতোই তার মোবাইল নম্বর বলল। পাশাপাশি বাসার নম্বরটাও বলল।
আসাদুল করিম রাকিবের নম্বর দুটো মোবাইলে সেভ করে বললেন, এবার আমার নম্বরটাও নাও তাহলে।
রাকিব বলল, জি, আসাদ ভাই।
আসাদুল করিম বললেন, না, তার চেয়ে বরং আমি ফোন দেই। তুমি নম্বরটা সেভ করে নাও।
রাকিব বলল, সেটাই ভালো হবে।
আসাদুল করিম তার ফোন দিয়ে রাকিবের মোবাইলে ফোন দিলেন।
রাকিব তখনি নম্বরটা সেভ করে নিল।
আসাদুল করিম বললেন, এবার আসি তাহলে। নবাবদের অরচার্ডের পথটা চিনিয়ে নিয়ে যাই। বলেই তিনি মাইক্রোটার দিকে এগিয়ে গেলেন। মাইক্রো থেকে এরই মধ্যে তিন-চার জন অরচার্ড শ্রমিক নেমে এসেছে। আসাদুল করিম তাদের কাছে গিয়ে আঙুল উঁচিয়ে কী কী যেন দেখাতে শুরু করলেন।
রাকিব নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু গাড়ির দরজা খুলতে গিয়ে কী মনে করে আবার ঘুরে দাঁড়াল। আসাদুল করিমের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, সরি আসাদ ভাই, আমি আপনাকে আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করতাম?
আসাদুল করিম জিজ্ঞেস করলেন, কী কথা?
: আপনার কাছে কি আজমল হোসেন স্যারের ফোন নম্বর আছে? কিংবা বাসার ঠিকানা?
: হ্যাঁ, আছে তো। দাঁড়াও আমি তোমাকে আজমল স্যারের ফোন নম্বরটা বের করে দিচ্ছি। তুমি স্যারের অ্যাড্রেসটাও লিখে নাও।
রাকিব মোবাইলে আজমল হোসেনের মোবাইল নম্বর ও বাসার ঠিকানা লিখে নিল।
আসাদ ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাকিব একবার ভেবেছিল, নেপিয়ারের কাছে ক্লিফটন হয়ে কেইপ-কিডন্যাপারে যাবে। কেইপ-কিডন্যাপারে হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় গানেট কলোনি। সাদা পালক, কালো মাথা ও সোনালি ঠোঁটের এই গানেট পাখি উড়তে শিখেই তিন হাজার কিলোমিটার দূরের অস্ট্রেলিয়াতে উড়ে চলে যায়। ওখানে ওরা দুই বছরের মতো বসবাস করে। ডিম পাড়া ও বাচ্চা ফোটানোর সময় ওরা আবার নেপিয়ারের কেইপ কিডন্যাপারে চলে আসে। তারপর ওরা বাকি জীবনটা সেখানেই বসবাস করে।
এই কেইপ কিডন্যাপারে যাওয়া ও গানেট কলোনি দেখার পথটা রাকিবের খুব ভালো লাগে। ক্লিফটন থেকে টিকিট কেটে গ্রুপে গ্রুপে ট্রাক্টরে উঠতে হয়। ট্রাক্টরচালক পর্যটকদের বিচের পাড় ধরে ড্রাইভ করে গানেট কলোনির কাছে নিয়ে যায়। ওখান থেকে গাইড ফোর হুইল ড্রাইভে করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গানেট কলোনি দেখায়।
এই গানেট কলোনিতে রাকিব প্রথম গিয়েছিল মতি ভাই ও মিনু ভাবির সঙ্গে। তারা অকল্যান্ড থেকে হকস বে অঞ্চলে ঘুরতে এসেছিলেন। রাকিব তখন নিউজিল্যান্ডে একেবারে নতুন। তখন যেখানে যা দেখত তা-ই তার ভালো লাগত। পরে এমেন্ডাকে নিয়ে দুই বার গানেট কলোনিতে এসেছিল।
রাকিব জানে, কেইপ কিডন্যাপারেরে মতো স্থানগুলোতে বারবার যেতে ইচ্ছে করে। এসব স্থান থেকে প্রতিবারই নতুন নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে আসা যায়। কিন্তু রাকিবের আজ কেইপ কিডন্যাপার বা আর কোথাও যেতে ইচ্ছে হলো না। সে সরাসরি হেস্টিংস সিটি সেন্টারের কাছে চলে এল। আপাতত রাকিব একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকবে। তার আজ ফার্স্টফুড শপ ম্যাকডোনাল্ডস বা কেএফসিতে যেতে মন চাইল না।
রাকিব হেস্টিংসের ডাউন টাউনে এসে একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঢুকল। তাজ রেস্টুরেন্ট।
রেস্টুরেন্টের ভেতর একেবারে ফাঁকা। সে বাদে আর একজন কাস্টমারও নেই। ম্যানেজার কাউন্টারের কাছে দাঁড়িয়ে ওয়াইন গ্লাসগুলোতে পাতলা ন্যাপকিন ঢুকিয়ে ভেতরটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মুছছে। এসব রেস্টুরেন্টে উইকএন্ডে রাতে বা রাতের খাবারের সময় ব্যস্ত হয়। দুপুরের খাবারের সময় প্রায় ফাঁকাই থাকে। এতে দেখা যায়, একই মেনুতে দুপুরের খাবারের সময় যা দাম থাকে, রাতের খাবারের সময় তা দ্বিগুণ হয়ে যায়।
ওয়েটার এগিয়ে আসতেই রাকিব সচরাচর যা পছন্দ করে, হাফ তন্দুরি চিকেন, দুটো নান রুটি ও রাইতা, সে এ সবের অর্ডার দিল। সঙ্গে এক গ্লাস কোল্ড স্প্রাইট। তন্দুরি চিকেন ও নান রুটি নদীরও পছন্দ। গত কয়েক মাস ধরে নদী ও সে হ্যামিল্টন ইস্টের কারি পট সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে অনেকবার গিয়েছে। বারবারই তারা তন্দুরি চিকেন, নানা রুটি ও রাইতার অর্ডার দিয়েছে।
নদীর কথা ভাবতেই রাকিব উদাস হয়ে রেস্টুরেন্টের জানালা গলে বাইরে তাকাল। সিটি সেন্টার বলে রেস্টুরেন্টের সামনের রাস্তা ঘরে অনেক গাড়ি আসা-যাওয়া করছে। অনেক মানুষ ফুটপাত ধরে হাঁটছে। বিলিস বারের সাইন বোর্ডের অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে। বিলিস বারের সামনে ওয়াইন ফেস্টিভ্যালের কিছু কাপড়ের ব্যানার ঝুলছে।
রেস্টুরেন্টের ভেতর গান বাজছে খুব মৃদু লয়ে। পুরোনো দিনের হিন্দি গান। লতার গান—তুমহি মেরি মন্দির, তুমহি মেরি পূজা, তুমহি দেবতা হো...।
রাকিব হঠাৎ কী মনে করে আসাদুল করিমের কাছ থেকে পাওয়া আজমল হোসেনের মোবাইলে ফোন দিল। ওপাশে ফোন বাজছে তো বাজছেই। কিন্তু কেউ ফোন ধরছে না। ফোন বাজতে বাজতে মেসেজে চলে গেল।
রাকিব মেসেজ না রেখেই লাইন কেটে দিল।
ওয়েটার খাবার নিয়ে এল। প্রথমে বরফের কুঁচি দেওয়া স্প্রাইটের গ্লাস। এরপর তন্দুরি চিকেন, নান রুটি ও রাইতা। ওয়েটার একটা নরম হাসি দিয়ে বলে গেল, এনজয় ইয়োর মিল।
রাকিবও মৃদু হেসে বলল, থ্যাংক ইউ।
তন্দুরি চিকেনে কামড় বসাতে বসাতে রাকিব খানিকটা উদাস হয়ে গেল। এমেন্ডাকে ছাপিয়ে এখন নদীকেই বেশি মনে পড়ছে। সে ভেবে পেল না, নদীর সমস্যাটা কোথায়। নদী কী তাকে ভালোবাসে? কেন ভালোবাসে?
নদী একজন মেধাবী ছাত্রী। অসম্ভব সুন্দর তার ভবিষ্যৎ। সিঁড়ির পর সিঁড়ি সে পেরোচ্ছে। আর অন্যদিকে রাকিব নিজে একজন ছন্নছাড়া মানুষ।
রাকিব ভাবল, নদী হয়তো তাকে একজন বন্ধু হিসেবে পেতে চায়। কিংবা বিদেশবিভুঁইয়ে একজন বিশ্বস্ত চলার মানুষ। তবে নদীর সরলতা তাকে মুগ্ধ করে। তার রসিকতাও। রাকিব তার নাম দিয়েছে সরল মতি নদী!
নদীর কথা ভাবতে ভাবতেই রাকিব বাম হাতে মোবাইলটা হাতে নিল। নদীকে একটা ফোন দেবে কিনা ভাবল। কিন্তু সে ফোন না দিয়ে মোবাইলটা টেবিলের একপাশে রেখে দিল।
হেস্টিংসের এই তাজ রেস্টুরেন্টের তন্দুরি চিকেন ও নান রুটি রাকিবের মোটেও ভালো লাগছে না। তন্দুরি চিকেনে মসলা ঢোকেনি। নান রুটিগুলো শক্ত। তারপরও সে ক্ষুধা মিটানোর জন্য খানিকটা খেল।
হাত ধুয়ে কাউন্টারে বিল দিয়ে রাকিব রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতে হতে আজমল হোসেনকে আরেকবার ফোন দেওয়ার কথা ভাবল। কিন্তু পরক্ষণ ভাবল, কাছেই তো পার্ক স্ট্রিট। হেস্টিংস সিটি সেন্টার থেকে বের হয়ে খানিকটা গিয়ে কাউন্ট ডাউন পেরিয়ে রাসেল স্ট্রিট থেকে ডানে পার্ক স্ট্রিটে মোড় নিলেই আজমল স্যারের বাসা। রাকিব পার্ক স্ট্রিটটা ভালো করেই চেনে। দীর্ঘ পাঁচটা বছর হেস্টিংস শহরে থেকে গেছে।
কাউন্ট ডাউনের পাশ দিয়ে যেতে যেতে রাকিব এমেন্ডার কথা ভাবতে গিয়ে ভাবল না। সে আজমল হোসেনকে নিয়ে ভাবতে বসল।
আজমল হোসেন রাকিবের কলেজের শিক্ষক। তিনি কেমিস্ট্রি পড়াতেন। যদিও রাকিব সরাসরি তার ছাত্র নয়। তবুও তো একই কলেজের শিক্ষক। যে কলেজে ছোট চাচি ও সে লেখাপড়া করেছে।
সাড়ে পাঁচ বছর আগের কথা। তখন এমেন্ডার সঙ্গে রাকিবের সেপারেশন চলছিল। রাকিব হেস্টিংস শহর ছেড়ে তখন কিছুদিনের জন্য তাওরাঙ্গা শহরের কাছাকাছি মাউন্ট মাঙ্গানুই শহরে আলী হায়দার ভাইয়ের বাসায় অস্থায়ীভাবে থাকত। কাজ করত মন্টোগোমেরি নামে কিউই ফলের একটা প্যাকিং হাউসে। আলী হায়দার ভাই-ই সেই অস্থায়ী কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। একদিন কাজ করতে গিয়ে সে আজমল হোসেনকে আবিষ্কার করে।
আজমল হোসেন সেদিন সেই প্যাকিং হাউসে কাজ খুঁজতে এসেছিলেন। রাকিব যেচেই তাকে নিজের পরিচয় দেয়। (ক্রমশ)
মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>