দিঘল মেঘের দেশে-এগারো

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আজ জাহিদের কাজ ছিল না। শনিবার বলে নয়। থিনিংয়ের কাজ কমে গেছে বলে উইকএন্ডের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর কিছুদিন পরেই পিকিংয়ের কাজ শুরু হবে।

কিন্তু গতরাতে সাইদ আহমেদ অনুরোধ করে ফোন দিয়েছিলেন। শনিবার হলেও আজ জাহিদসহ সবাইকে কাজে যেতে হবে। সোম-মঙ্গলবারের মধ্যে ডিক জনসন অরচার্ডের থিনিংয়ের কাজ শেষ করতে হবে।

ডিক জনসন অরচার্ডে যত দিন কাজ হবে তত দিন আজমল হোসেনের কাজ নেই। জাহিদ কাজে যেতে যেতে প্রতিদিনই তার জন্য মন খারাপ করে।

পাঁচটায় কাজ শেষ হওয়ার পর জাহিদ সোয়া পাঁচটার মধ্যেই বাসায় চলে এল। রিভারটনের ডিক জনসন অরচার্ডটা তার বাসা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। গাড়িতে আট-দশ মিনিটের পথ। যানজট থাকলে হয়তো দু-চার মিনিট বেশি লাগে।

গাড়ি থেকে নামতে নামতে জাহিদ ভাবল, আপাতত বাসায় ঢুকে সে গোসলটা সারবে। তারপর আজমল স্যারকে নিয়ে হেস্টিংস মায়ার্সে যাবে। ওখান থেকে লিডিয়ার জন্য একটা দামি হ্যান্ড ব্যাগ ও পিটারের জন্য একটা শার্ট বা ঘড়ি কিনবে। লিডিয়াকে তো সে কাগজের বিয়ে করেছে। তাকে নিউজিল্যান্ডের পারমানেন্ট রেসিডেন্স দেওয়াটা লিডিয়ার একটা দায়িত্বের মধ্যে ছিল। কিন্তু পিটার?

জাহিদ কখনো পিটারকে ভুলবে না। পিটার আড়ালে থেকে তার যে উপকার করেছে! সে না থাকলে তার হয়তো এত সহজে নিউজিল্যান্ডের পারমানেন্ট রেসিডেন্সি হতো না। লিডিয়া টাকাপয়সা নিয়ে মাঝেমধ্যে যেভাবে বেঁকে বসত!

মায়ার্স থেকে বের হয়ে জাহিদ সরাসরি নেপিয়ার সি-ফুড রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেতে চলে যাবে। আজ রাতে সে লিডিয়া ও পিটারকে রেস্টুরেন্টে খাওয়াবে। এ দেশিরা আটটার মধ্যেই রাতের খাবার খেয়ে ফেলে। ডে-লাইট সেভিংসে ফকফকে দিন থাকলেও কোনো সমস্যা নেই। ওরা সময়ের হেরফের করে না।

আগামী সপ্তাহেই লিডিয়ার সঙ্গে জাহিদের কাগজের বিয়ের সমাপ্তি ঘটবে। কাগজপত্রে আলাদা দেখাবে। পুরো দুই বছর জাহিদকে এমনটা করতে হবে। দুই বছর পর সে আবার নতুন করে বিয়ে করতে পারবে। এটাই নিউজিল্যান্ডের আইন। এ দেশের আইন অনুযায়ী কেউ সরাসরি ডিভোর্স দিতে পারে না। দুই বছর আলাদা থাকার পর ডিভোর্সে যেতে পারে।

বাসায় ঢুকতে ঢুকতে জাহিদ ভাবছিল, আজমল হোসেন নিশ্চয়ই সোফায় হেলান দিয়ে বসে টিভি দেখছেন। নয়তো ঝুঁকে বসে কমিউনিটি পত্রিকাগুলো পড়ছেন। যদিও কমিউনিটি পত্রিকাগুলোতে খবরের চেয়ে বিজ্ঞাপনের আধিক্যই বেশি। তারপরও তিনি বেশ মনোযোগ দিয়ে ওসব পত্রিকা পড়েন। এ ছাড়া আর কীই-বা করবেন তিনি? ডিক জনসন অরচার্ডে তার কাজ নেই। ডিক জনসন অরচার্ডের পর ক্লাইভের কাছে সিকা অরচার্ডে কাজ শুরু হবে। সেখানেও যে তিনি কাজ পাবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আপেল পিকিংয়ের কাজ শুরু না হওয়া পর্যন্ত তিনি হয়তো ঘরেই বসা থাকবেন।

কিন্তু বাসায় ঢুকে জাহিদ দেখল, আজও আজমল হোসেন বাসায় নেই। এমনকি তিনি তার মোবাইলটা টি টেবিলের ওপর ফেলে গেছেন।

জাহিদ চাবির গোছাটা টি টেবিলের এক পাশে রেখে আজমল হোসেনের মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে বেশ বিরক্ত হলো। ভাবল, আজমল স্যার অন্তত মোবাইলটা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেতন। তাকে সে এখন কোথায় খুঁজবে? জাহিদ সকালেও আজমল হোসেনকে বলে গেছে, তিনি যেন বিকেলে তৈরি হয়ে থাকেন। সে তাঁকে রাতে লিডিয়া ও পিটারের সঙ্গে ডিনারে নিয়ে যাবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা।

আজ বেশ গরম পড়েছে। যদিও নিউজিল্যান্ডের আবহাওয়ায় আর্দ্রতা খুব কম বলে এখানে শরীর সচরাচর ঘামে না। তবুও জাহিদের মনে হচ্ছে একটা চিকন ঘাম তার পিঠ বেয়ে শিরশির করে গড়িয়ে পড়ছে। আজ অরচার্ডেও সে বেশ ঘেমেছে। হয়তো রাতে বৃষ্টি হবে। হকস বে অঞ্চলে অনেক দিন ধরে বৃষ্টি হয় না। এখন বৃষ্টি হলে আপেলের জন্য বেশ ভালোই হবে। আপেলগুলো তাড়াতাড়ি বাড়-বাড়ন্ত হয়ে উঠবে। আপেল পিকিংও সময়ের একটু আগে শুরু হবে। আপেল পিকিং শুরু হওয়া মানে আজমল হোসেনের আর ঘরে বসে থাকতে হবে না। আজমল হোসেনকে বাসায় রেখে জাহিদের কাজে যেতে মোটেও ভালো লাগে না।

জাহিদ কাজের কাপড়চোপড় ছেড়ে বাথরুমে ঢুকল। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে গোসল করল। বাথরুম থেকে বের হয়ে সে একটা জিনসের প্যান্টের সঙ্গে শার্ট না পরে একটা পোলো গেঞ্জি পরল। তারপর সে সোফায় গা ছেড়ে বসে টিভি ছাড়ল। টিভি টুতে তেমন বিশেষ কিছু নেই। বাচ্চাদের কার্টুন চলছে। সে টিভির চ্যানেল পরিবর্তন করল। চ্যানেল থ্রিতেও বাচ্চাদের কার্টুন চলছে। প্রাইম চ্যানেলে চলছে শরীর ঠিক রাখার জন্য ব্যায়ামের কসরত-জুম্বা। প্রায় সব চ্যানেলেই খবর শুরু হবে ছয়টায়। সে অবশ্য ততক্ষণ বাসায় থাকবে না।

জাহিদ টিভির চ্যানেল আর পরিবর্তন না করে টিভি বন্ধ করে দিল। তার একটা সিগারেট টানতে ইচ্ছে করছে। আজমল হোসেন বাসায় থাকলে সে অবশ্য কখনো তার সামনে সিগারেট টানে না। কিন্তু এখন তো তিনি নেই। ইচ্ছে করলেই সে একটা সিগারেট টানতে পারে।

জাহিদ সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিল। কিন্তু সে প্যাকেটটা হাতে নিয়েও রেখে দিল। জাহিদ আপাতত উঠতে চায়। আজমল হোসেনের জন্য অপেক্ষা করে তার লাভ নেই। প্রয়োজনে সে তাকে রাস্তায় খানিকটা খুঁজে বেড়াবে। তিনি তো আশপাশেই হাঁটাহাঁটি করেন।

জাহিদ উঠে দাঁড়াল। মোবাইল, সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটারটা হাতে নিয়ে সে বাসা থেকে বের হলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ড্রাইভওয়ে থেকে বের হতেই তার ফোনটা বেজে উঠল। জাহিদ সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে দেখল সাইদ আহমেদের ফোন।

জাহিদ হ্যালো বলতেই সাইদ আহমেদ ব্যস্ত গলায় বললেন, জাহিদ, আমি একটা সমস্যায় পড়ে গেছি।

জাহিদ জিজ্ঞেস করল, কী সমস্যা?

: আমার কিছু টাকা লাগবে। হাজার খানিক হলেই হবে। হঠাৎ দরকার পড়ল। তুমি কি দিতে পারবে?

: হ্যাঁ, কখন লাগবে?

: এই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে।

: আচ্ছা, আমি এখনই নেট ব্যাংকে ট্রান্সফার করে দিচ্ছি।

: আমার অ্যাকাউন্ট নম্বর তোমার জানা আছে তো?

: জি, সাইদ ভাই।

: থ্যাংক ইউ। আমি তোমার নেক্সট বেতনের সঙ্গে দিয়ে দিব।

: অসুবিধা নেই সাইদ ভাই। নেক্সট বেতনের সঙ্গে দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। পরে দিলেও হবে।

: এখন বাসায় কী করছ?

: কেন সাইদ ভাই?

: আমার বাসায় চলে আস। তোমার ভাবি গরুর মাংস আর খিচুড়ি রান্না করছে।

: আজ আসতে পারব না।

: আরে চলে আস।

: সরি সাইদ ভাই।

: কেন, কোথাও যাচ্ছ নাকি?

: জি, নেপিয়ার যাব। তবে আপাতত আমি আজমল স্যারকে খুঁজতে বেরিয়েছি। দেখি আশপাশের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করছেন কিনা।

: আজমল স্যারের আবার কী হলো?

: তিনি বাসায় নেই।

: এ আর নতুন কী?

: তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু স্যারকে আমার খুঁজে বের করতে হবে।

: আজমল স্যারের মোবাইলে ফোন দাও?

: তিনি তার মোবাইলটা বাসায় ফেলে গেছেন।

: আজমল স্যার না...আর কী বলব? তা হঠাৎ তুমি তাকে খুঁজতে বের হওয়ার কারণ কি? তিনি ঘোরাঘুরি শেষ করে একসময় না একসময় বাসায় আসবেনই?

: আজ রাতে নেপিয়ারে সি-ফুড রেস্টুরেন্টে লিডিয়া আর পিটারকে ডিনার করাব। আজমল স্যারকেও নিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম। তাকে সকালে বলেও গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখেন, কী ভোলা মনের মানুষ। যাওয়ার সময় মোবাইলটাও নিয়ে যাননি।

: এখন আজমল স্যারের আশা ছেড়ে দাও। আজমল স্যারকে নিয়ে ডিনার করতে গেলে আজ লিডিয়া ও পিটারকে তোমার আর ডিনার করানো হবে না। এ দেশিরা সবকিছু অন টাইমে করে।

: তাই দেখছি। নেপিয়ার যাওয়ার আগে আমাকে আবার মায়ার্সে যেতে হবে। লিডিয়ার জন্য একটা ব্যাগ, পিটারের জন্য একটা শার্ট বা ঘড়ি নিয়ে যাব।

: তোমার ঝামেলা তো শেষ। কাগজ হয়ে গেছে। হঠাৎ তাদের এত কিছু দিচ্ছ?

: এখনো ঝামেলা শেষ হয়নি সাইদ ভাই। আগামী সপ্তাহে সেপারেশনে গেলে ঝামেলা শেষ হবে। এর আগে অবশ্য আপনার সঙ্গে একটু বসতে হবে। আপনার পরামর্শ নিতে হবে। আর ওদেরকে আজ ডিনার করতে বলাটা একধরনের কার্টিসিও মেনটেইন করা। মূলত পিটারের উদ্দেশ্যেই এই ডিনার।

: হ্যাঁ, পিটার তোমার অনেক উপকার করেছে।

: জি সাইদ ভাই, পিটার ছিল বলেই আমার নিউজিল্যান্ডের পারমানেন্ট রেসিডেন্সিটা এত সহজে হয়েছে। লিডিয়া মাঝেমধ্যে যেভাবে বেঁকে বসত আর এমন অদ্ভূত আচরণ করত! আমি তো কখনো কখনো আশাই ছেড়ে দিতাম। তখন পিটারের কাছে ছুটে যেতাম।

সাইদ আহমেদ ফোনের ওপাশ থেকে বললেন, হুম, তা অবশ্য ঠিক। তবে লিডিয়া অদ্ভূত আচরণ করলেও তোমার বেশ উপকার করেছে। ইমিগ্রেশনে ইন্টারভিউটা বেশ চমৎকার দিয়েছে। ইমিগ্রেশনের ইন্টারভিউটাই আসল। নয়তো এত সহজে কারও পারমানেন্ট রেসিডেন্সি হয় নাকি? মাত্র দেড় বছরে তুমি পারমানেন্ট রেসিডেন্সি নিয়ে বের হয়ে এসেছ। তাও আবার কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করে। আজকাল অনেকে জেনুইন বিয়ে করেও নিউজিল্যান্ডের পারমানেন্ট রেসিডেন্সি পায় না। বাচ্চাকাচ্চার জন্ম দিয়েও বছরের পর বছর বসে আছে। তুমি সেদিক দিয়ে লাকি। আসলেই লাকি।

জাহিদ বলল, জি, সাইদ ভাই। আমি আসলেই লাকি। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>