দানেশ আলীর কথা

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

১৯৯৭ সালে নেদারল্যান্ডস আসার কিছুদিন পর দানেশ আলীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। হেগ শহরে অল্প কিছু বাংলাদেশির বসবাস। প্রায় সবাই সবাইকে চেনেন সংখ্যা স্বল্পতার কারণে। তখন আমার রেসিডেন্স পারমিট হয়নি। হেগ শহরে মেন্ডেলা প্লেইনে একটা সোশ্যাল গ্যাদারিংয়ের জায়গা আছে। সেখানে বাংলাদেশিরা সপ্তাহে এক বা দুই দিন মিলিত হতেন। মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের ছেলেমেয়েরা যেন বাংলা ভাষার চর্চা করে। মাতৃভাষাটা যেন ভুলে না যায়। কিছুদিন আড্ডাটা চলেছিল ভালোই। এরপর তা ভেঙে যায়, একেকজনের একেক সময় কাজ, সময় করে ওখানে আসতে পারে না। আমিসহ যাদের রেসিডেন্স পারমিট ছিল না, এ রকম কয়েকজন নির্দিষ্ট সময়ের আগেই গিয়ে বসে থাকতাম। আমাদের কাজের পারমিশন ছিল না, একমাত্র ভরসা কোথাও অবৈধভাবে কাজ জোগাড় করা।
ওখানে যাঁরা স্ত্রী–সন্তানসহ থাকতেন, তাঁরা সবাই বেশ আগে থেকে ছিলেন। তাঁদের কাছে কাজ খোঁজার জন্যই আমি সেখানে যেতাম। একেবারে নতুন বলতে আমিই ছিলাম। থাকার বৈধতা ছিল না কিন্তু অনেক দিন ধরে নেদারল্যান্ডসে থাকেন এ রকম লোকই বেশি ছিল তখন হেগ শহরে। মাঝে মাঝেই নতুন কারও না কারও সঙ্গে পরিচিত হই। একটা কাজ যেন জোগাড় করা যায়, সেই আশায়। কিন্তু ইউরোপের সব দেশেই যাঁদের থাকার বৈধতা বা কাজের অনুমতি নেই, তাঁদের অবস্থা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন! যিনি সরেজমিনে না দেখেছেন সংগ্রামটা, তাঁকে কোনোভাবেই বোঝানো যাবে না। নিজের দেশে আপনি গরিব থাকতে পারবেন। যদি ঘরে খাবার না–ও থাকে, সবার কম–বেশি আত্মীয়স্বজন আছে, যেখানে আপনি দুবেলা খেতে পারবেন।
বিদেশে, বিশেষ করে ইউরোপে গরিব বা সামর্থ্যহীন আপনি এক দিনও থাকতে পারবেন না। আপনার কাগজ ও কাজ নেই, আপনি পুরোপুরি অবৈধ! একজন বৈধ বাংলাদেশি আপনাকে তাঁর বাসায় দুই–চার দিনের বেশি রাখবেন না। যদি কেউ রাখেন, তবে তাঁকে মহৎ হৃদয়ের মানুষ বলেই ধরে নিতে হবে। এখানে কেউ একটি টাকাও অবৈধ উপায়ে উপার্জন করতে পারে না, সবার সব টাকাই মোটামুটি হিসাবের মধ্যেই। একজন বাড়তি মানুষের ভরণপোষণ করা কঠিন! বাংলাদেশের কজন মানুষ বলতে পারবেন যে টয়লেট ফ্ল্যাশ করলে কত লিটার পানি যায়? আমিও জানতাম না, এখানে এসে জানতে হয়েছে! সেই জানা আনন্দের ছিল না। বাবা–মায়ের বড় ছেলে, ধনী না হলেও আমরা অভাবী মানুষ বলতে যা বোঝায়, তা ছিলাম না। বাবা-মা দুজনেই চাকরি করতেন বলে আমাদের সংসার সচ্ছলই ছিল।
ছোটবেলায় দেখেছি আমার মামা–খালারা (ইউরোপে থাকতেন) দেশে এলে দুহাতে খরচ করতেন। তাঁদের চেহারাও চকচক করত! তাঁদের দেখে বিদেশে থাকতে ইচ্ছে করত। তবে সুনীলের একটা বইতে পড়েছিলাম, সম্ভবত একা এবং কয়েকজন নাম বইটির। রঞ্জু নামের ছেলেটির স্বপ্ন থাকে জার্মানি যাওয়ার। সে প্রায় দিন কলকাতার জাহাজ ঘাটে এসে একা একা বসে থাকত আর আবিষ্কার করার চেষ্টা করত কোন জাহাজটা জার্মানি যাচ্ছে? স্বপ্নের এ রকম চমৎকার বর্ণনা পড়ে, আমার মধ্যে স্বপ্নটা ঢুকে গেল! যেন আমিই সেই ছেলে! তুষারঢাকা রাস্তায়, কোনো রেললাইনের পাশ দিয়ে, ওভারকোট গায়ে দিয়ে গল্পের যে ছেলেটি হেঁটে যাচ্ছে, সে যেন আমি!! ছোটবেলায় লেখাপড়ায় আমি ভালোই ছিলাম। ইন্টারমিডিয়েটের পর বখে গেলাম। কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে কেন বখে গেলাম? উত্তর কিছু দেবার নেই! কোনো না কোনো অভাব বোধ থেকে মানুষ বখে যায়। আমার সে রকম কিছু ছিল না, ক্লাসের অনেক বন্ধু গাড়িতে করে স্কুল কলেজে আসত দেখে হিংসে হতো, তা ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের চেয়ে তুলনামূলক কম সচ্ছল পরিবারের ছেলেপেলেরাও আসত। হয়তো বা তেমন কোনো সমস্যা ছিল না, সেটাই ছিল বড় সমস্যা! শখের দুঃখ-কষ্ট, আহা, আবার যদি জীবনটা আগের অবস্থায় নেওয়া যেত!
মামা-খালাদের আমাকে ইউরোপে নিয়ে যেতে বললে, বিশেষ করে মামা বলতেন, ‘কেন বিদেশে যাবে? পড়াশোনা করতে যাও। বিদেশে থাকতে হবে কেন? কী করবে ওখানে গিয়ে?’ তখন ভাবতাম, তিনি হয়তো চাচ্ছেন না আমি যাই! নিজে একা একা ভালো থাকতে চাইছেন! এখন মনে হলে হাসি পায়। এখন যখন দেশের কোনো আত্মীয় বা পরিচিতজন ইউরোপে আসতে চায়, আমিও তাদের বলি, কী করবে ওখানে গিয়ে? মামা হয়তো বর্ণনা করতেন না এখানকার জীবনযাপন, আমি আবার তা করি। দেশের যোগ্যতা আর এখানকার যোগ্যতায় ফারাক বিস্তর! শুধু তা–ই নয়, মনমানসিকতাই সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের এদের। কোনোভাবেই ক্লিক জিনিসটা এদের সঙ্গে আমাদের হয় না!
মানুষ হিসেবে আমাদের অবস্থান এদের চেয়ে অনেক নিচে। বাঙালি লেখকেরা যত সুন্দর করেই লিখুন না কেন যে আমরা উত্তম! ছোট একটা উদাহরণ দিই। এই ইউরোপে আপনি হাজার হাজার মানুষ পাবেন যিনি তার গোটা ৭০ বা ৮০ বছরের জীবনে একবারও মিথ্যা কথা বলেননি! আবার লিখছি, একজন–দুজন নয়, এ রকম পাবেন হাজার হাজার। মিথ্যা বলার তাঁদের প্রয়োজনই হয়নি! আর আমরা? প্রথম যখন স্কুলে ভর্তি হই, ভর্তি পরীক্ষায় জিজ্ঞাসা করেছিল কী খেতে আমি পছন্দ করি? আমি উত্তর দিয়েছিলাম মাছ আর শাকসবজি! বলাবাহুল্য উত্তরটা শিখিয়ে দেওয়া। যদিও পাচ-ছয় বছরের একজন বালকের শাকসবজি, মাছ পছন্দের খাবার হওয়ার কথা না। জীবনের শুরু মিথ্যা দিয়ে! অন্য অনেকেই হয়তো আমার মতো বলেননি। তারা অন্য কিছু নিয়ে মিথ্যা চর্চা করেছেন। আমাদের সঙ্গে এদের ক্লিকটা হবে কী করে?
যা–ই হোক, চলে এলাম ইউরোপ। মুশকিল হলো, আমরা যারা ইউরোপে থাকি তারা দেশে গিয়ে সঠিক কথাটি বলি না। এক–দেড় বছর কঠোর পরিশ্রম করে দেশে বেড়াতে যাই। বাবুয়ানা ভাব নিয়ে চলি। এই করি, সেই করি! কাউকে বুঝতে দিই না এটি করার জন্য কী পরিমাণ পরিশ্রম করে টাকা একত্র করতে হয়েছে! দেশের মানুষও জানতে চায় না। অনেকে বলতে গেলে বোঝে না! ভাবে, আমরা বুঝি হা করে থাকি, মেশিন আমাদের খাইয়ে দেয়! জীবন কত কঠিন, তা জানতে হলে আপনাকে ইউরোপ-আমেরিকায় থাকতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে থাকলেও হবে না। প্রসঙ্গের বাইরে বেশি বলা হয়ে গেল!
দানেশ ভাইয়ের সঙ্গে যখন পরিচয়, তখন আমি বুঝতে পারিনি তাঁর এখানে থাকার বৈধতা নেই! বিদেশে সবাই ভাই। তাই তাকে ভাই ডাকা। বয়স আমার বাবার মতোই। দেখা হলেই হম্বিতম্বি করতেন। এই ছেলে দুপুরে খেয়ে যাবে কিন্তু, আজ এই রান্না, সেই রান্না! কিন্তু তার ওখানে যাওয়া হয় কম। বয়সের পার্থক্যের জন্য তাঁর সঙ্গে গল্প করায় উৎসাহ পাই না। আমার তখন ২৮–২৯ বছর বয়স। মেয়েদের দেখলেই ভালো লাগে, আর উনি মেয়ে বিয়ে দেবেন, এ রকম।
একদিন তাঁর বাসায় গিয়ে দেখি টেবিল–ভর্তি ওষুধ। শুনলাম উনি ডুপ্লিকেট হার্ট নিয়ে বেঁচে আছেন! জীবিকার তাড়নায় দেশ ছেড়েছেন ১৭–১৮ বছর আগে। লিবিয়াতে চাকরি নিয়ে এসেছিলেন। পরে সুযোগমতো ইউরোপে চলে আসেন।
কিছু মানুষ আছেন শুধু শুধু নিজেকে বাড়িয়ে উপস্থাপন করতে পছন্দ করেন। তিনি ছিলেন সে রকম। সবাই বুঝত, কিছু বলত না। তাঁর বাড়ি এ রকম, ও রকম। ছেলেমেয়ে অত্যন্ত ভালো ছাত্রছাত্রী। মেয়ে গাড়ি করে স্কুলে যায় বলে ছেলেরও আলাদা গাড়ি চাই। দু–একজন তাঁকে এই নিয়ে লজ্জাও দিত। তিনি দমে যেতেন না। বিএনপি মনোভাবাপন্ন লোকদের কাছে গিয়ে বলতেন, ‘তোমাদের ভাবির তো ম্যাডামের সাথে ডাইরেক্ট লাইন!’ আবার আওয়ামী লীগ মনোভাবাপন্নদের বলত, ‘আমি যখন শেখ সাহেবের বাড়ি যেতাম, তখন হাসিনা ছোট! কত দেখেছি কাছ থেকে, পেয়ারা পেরে খাচ্ছে!’ এই হলো দানেশ ভাই। সব দলের মিটিংয়ে তিনি থাকতেন। কিন্তু আসলে তিনি টাকা না পাঠালে তাঁর স্ত্রী ছেলেমেয়েদের সংসার চলত না। মাঝেমাঝেই তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে থাকতেন। কেউ খুব একটা দেখতে যেত না। কারণ, প্রায়ই তিনি হাসপাতালে থাকতেন।
তিন বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর আমার থাকার বৈধতা হলো। ২০০১ সাল তখন। ওই সময় আমি জানলাম দানেশ ভাইয়ের বৈধতা নেই! বৈধতা পাওয়ার পর আমি মূল হেগ শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে বাসা নিই। তাঁর সঙ্গে দেখা হয় কম, ফোনে আলাদা কথা বলার মতো ঘনিষ্ঠতা তাঁর সঙ্গে আমার ছিল না। কোনো সোশ্যাল গ্যাদারিং বা মিটিংয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হতো। এভাবেই একদিন দেখা। সেদিন হঠাৎ আমাকে বললেন, ‘সোহেল, আমার মেয়েটার একটা বিয়ে দিয়ে দাও। এই দেখো আমার মেয়ের ছবি।’ দেখলাম রূপবতী কিশোরী, বিয়ের বয়স মেয়েটির হয়নি। ১৮ বছর বয়স তখনো মেয়েটির হয়নি। আরও বললেন, এই মেয়ের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। আমি অবাক! তিনি যখন লিবিয়ার উদ্দেশে দেশ ছাড়েন তখন মেয়েটি তার মায়ের গর্ভে। ১৭ বছর দেশে যেতে পারেননি, বৈধতা পাননি বলে! মেয়ের সঙ্গে তার কথা হয়, খুনসুটিও হয় কিন্তু বাবা–মেয়ের সামনাসামনি দেখা হয়নি! দুঃখ হলেও করার কিছু ছিল না।
এর বেশ কিছুদিন পর শুনি দানেশ আলী থাকার বৈধতা পেয়েছেন। কি যে খুশি তিনি। পাগলের মতো এটা কেনেন, সেটা কেনেন, দেশে যাবেন বলে। একদিন দেখা হতেই জোর করে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। বড় বড় চিংড়ি রান্না করলেন। আমাকে কি যে আদর! এর ফাঁকে ফাঁকে ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর নানা স্বপ্নের বর্ণনা। আমাকে কী মনে করে মুকেশের একটা গানের ডিভিডি গিফট করলেন। তখনো আমি মুকেশের গানের সঙ্গে পরিচিত না। পুরানো হিন্দি গান ভালো লাগে বলেই নিলাম। এরও কিছুদিন পরে শুনি দানেশ ভাই হাসপাতালে। দুদিন পরই শুনি তিনি মারা গেছেন। সবাই চাঁদা তুলছেন, তার মরদেহ দেশে পাঠাবেন বলে। জীবনকে এত করুণ বানিয়ে সৃষ্টিকর্তার কী এমন লাভ, আমি বুঝি না! কখনোই আমার সঙ্গে তাঁর পরিবারের কথা হয়নি। আর মৃত্যুর পর কী করে তার ছেলেমেয়ে, স্ত্রীকে বলব যে, কাঁদবেন না প্লিজ। পৃথিবী থেমে নেই। জীবন চলছে জীবনের নিয়মে! দানেশ ভাই মারা গেছেন ২০০৬ সালে। আমি এখনো মাঝে মাঝে তার দেওয়া মুকেশের ডিভিডি বাজাই। অদ্ভুত একটা গান আছে এই এতে: ‘দুনিয়া বানানে ওয়ালেকিয়া তেরি মান মেয় সামায়ী, কাহেকো দুনিয়া বানায়ই...।’ আহা! অন্য দুনিয়াতে দানেশ ভাইয়ের যেন তার মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়।
সোহেল পারভেজ
অ্যন্টারপেন, বেলজিয়াম