দয়া করে ঠকাবেন না

অধ্যাপক ব্যাকভাল (Backvall) ষাটোর্ধ্ব। স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। অর্গানিক কেমেস্ট্রি বিভাগের গবেষণা-প্রধান (Research Head)। রসায়নের সেরা জার্নালগুলোতে তাঁর প্রকাশনা প্রায় ৪০০ । তিনি নোবেল কমিটির দায়িত্বসহ রসায়নভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠনের বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। রসায়নের জন্য ইউরোপিয়ান সেরা জার্নালের (Chemistry-A European Jouranl) সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি তিনি। তাঁর ব্যস্ততা সহজেই বোধগম্য। কিন্তু এই মানুষটি যখন সকাল নয়টায় লেকচার দেওয়ার জন্য চলে আসেন, আমি খুব অবাক হয়ে যেতাম! একটি কোর্সে, তার যতগুলো লেকচার, সবগুলোই সময়মতো নিয়ে নিতেন। স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তে আসি, এই বিষয়গুলো আমাকে খুব বিস্মিত করে! যখন দেশে ছিলাম, তখন দেখেছি, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা হরহামেশাই ক্লাস মিস করতেন। সময়মতো ক্লাস নিতেন না। বিভিন্ন অজুহাতে অনেক জুনিয়র ও সিনিয়র শিক্ষকই কাজটি করতেন (অবশ্য ব্যতিক্রমও ছিল)।
এই কাজটি শিক্ষকেরা কেন করেন, তার কারণ সুস্পষ্ট জানা নেই। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কেন দলীয় রাজনীতিতে নিজেদের ব্যস্ত রাখেন, সে উত্তর আমি কখনো পাইনি। ইউরোপ-আমেরিকায় এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এমন দেখা যায় না। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে সময়মতো ক্লাস ও পরীক্ষা না নেওয়াটাই দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়ম হয়ে গেছে। রাজনীতি করে একজন শিক্ষক যে সুবিধাগুলো অর্জন করেন, তাতে শিক্ষার্থীদের সামান্য পরিমাণ স্বার্থ সিদ্ধ হয় না। বিপরীতে, উদ্ভট ব্যস্ততার কারণে তাঁরা গবেষণা থেকে দূরে থাকেন ৷ সময়মতো ক্লাস নেন না৷ পরীক্ষার খাতা দেখেন না। একজন শিক্ষক ব্যক্তিগত জীবনে কী মতাদর্শে বিশ্বাসী হবেন, সেটা অবশ্যই তাঁর নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তার যে দায়বদ্ধতা (Commitment), সেটা পুরোপুরি পূরণ না করে, তিনি যত ব্যস্তই থাকুক না কেন, তাতে শিক্ষার্থীদের উপকার হয় না।

রাষ্ট্রের নানাবিধ সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা খুবই দুর্বল। যার কারণে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, জ্ঞানচর্চার মানের দিক দিয়ে পৃথিবীর সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে আছে। এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি একটি আত্মঘাতী চর্চায় জড়িয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক। তাঁদের পদোন্নতির জন্য দরকার হয় গবেষণাপত্র। ফলে তাঁরা মরিয়া হয়ে ওঠেন গবেষণা নিবন্ধের (Research Article) জন্য। অনেক সময়ই তারা খুব দুর্বল মানের গবেষণা করে বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশ করছেন। পৃথিবীতে জার্নালের সংখ্যা কম নয়। ইন্টারনেটের যুগে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জার্নাল আত্মপ্রকাশ করছে। অনেক জার্নাল আছে, যেগুলোতে আছে ওপেন অ্যাক্সেস। ঠিক যেন অনলাইন পত্রিকার মতো। সেসব জার্নালে প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ (article) আদতে কেউ পড়ে না এবং অনুসরণও করে না। কখনো কখনো সেসব জার্নালে অর্থ প্রদানের মাধ্যমেও আর্টিকেল প্রকাশ করা যায়। এই আর্টিকেলগুলো প্রকাশের আগে রিভিউ (Peer Review) হয় না। ফলে গবেষণার মান যা-ই হোক না কেন, তা প্রকাশ করা হয়। গবেষণার প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনেক জার্নাল আছে। প্রতিটি জার্নালে গবেষণার ফল প্রকাশের জন্য একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড থাকে। এই মানদণ্ড থাকা খুবই চিরন্তন। ভালো জার্নালে কখনো কখনো যে নিম্নমানের গবেষণা প্রকাশ হয় না, তা নয়। তবে সেটি কম। বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ সাময়িকী সায়েন্স (Science) -এ সম্প্রতি এ-বিষয়ক একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। আগ্রহী পাঠক বিস্তারিত পড়ার জন্য এই লিংকটি অনুসরণ করতে পারেন। sciencemag. org/content/ 342 / 6154 / 60. full জ্ঞানের জগতে পৃথিবীজুড়ে ঠিকই সেরা মানের গবেষণা হচ্ছে এবং সেগুলো প্রকাশ করা হচ্ছে সেরা জার্নালগুলোতে। ফলে এমন হীন চর্চা সমাজে টেকসই জ্ঞান (Sustainable Knowledge) চর্চার জন্য খুব ক্ষতিকর ও অন্তরায়। গবেষণা একটি ধারাবাহিক চর্চা। সেখানে প্রয়োজন হয় প্রচুর শ্রম ও সাধনা। গবেষণায় সহজেই ফল প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা, কুম্ভিলতা (Plagiarism) কিংবা অপচর্চা, তরুণ শিক্ষার্থীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যেসব শিক্ষার্থী এমন সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়, তারা জীবনের পরবর্তী ধাপে প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীর সম্মুখে টিকে থাকতে পারে না। শিক্ষকদের অবশ্যই এমন হীনচর্চা থেকে সরে আসতে হবে। আমাদের যতটুকু সম্পদ, সুযোগ ও মেধা আছে, তা দিয়ে আমাদের অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে আর্থিক সাহায্য নিয়ে। শিক্ষার্থীদের অন্তত বিশুদ্ধ জ্ঞানটুকু দেওয়ার সৎ উদ্দেশ্যটা যেন আমাদের শিক্ষকদের থাকে। আমাদের সীমাবদ্ধতা অনেক, সেটা অনস্বীকার্য। সেই সীমাবদ্ধতা নিশ্চয় শিক্ষার্থীরাও অনুধাবন করতে পারে।
আমাদের দেশের শিক্ষকেরা নিশ্চয় জানেন, পৃথিবীর খুব কম দেশেই শিক্ষার্থীরা এত ভালোবাসে শিক্ষকদের। এই শিক্ষার্থীগুলোর প্রাপ্যটুকু সঠিকভাবে বুঝিয়ে দিন। তাদের বঞ্চিত করবেন না। আমাদের শত সীমাবদ্ধতার মাঝেও, আপনারা যদি শুধু শিক্ষার্থীদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, সত্যি সত্যি এ দেশের শিক্ষা-ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন চলে আসবে। সারা পৃথিবীতে তা-ই তো দেখছি।
(রউফুল আলম, ডক্টরাল গবেষক, স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডেন। মেইল: redoxrouf@yahoo. com)