দক্ষিণ কোরিয়ায় এক টুকরো বাংলাদেশ
বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ইন কোরিয়া (বিএসএকে) দেশটিতে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীসহ পেশাজীবীদের কাছে সুপরিচিত একটি নাম। সংগঠনটি ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বছরজুড়ে নানা রকম কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। বিদেশি ছাত্রসংগঠনের মধ্যেও বিএসএকে অন্যতম একটি নাম।
বিএসএকে বছরের পুরোটা জুড়ে ব্যস্ত থাকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজে। এ ছাড়া বিএসএকের অন্যতম প্রধান কাজ হলো শিক্ষার্থীদের নানাভাবে সহযোগিতা, বিদেশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সেতুবন্ধ তৈরি, দেশে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষাবিষয়ক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা এবং মিলনমেলার আয়োজন করা।
বিএসএকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন শহরে আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় স্থানে বছরে দুবার করে মিলনমেলার আয়োজন করে থাকে। এর মাধ্যমে এখানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীসহ পেশাজীবীরা পাহাড়সম কাজের চাপ ও ক্লান্তিময় জীবনের ফাঁকে নিজ দেশের মানুষের সঙ্গে কোনো এক সন্ধ্যায় এক ছাদের নিচে মিলিত হওয়ার সুযোগ পান। যেখানে বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীসহ কয়েক শ বাংলাদেশি নাগরিকের সবান্ধব উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
এরই ধারাবাহিকতায় গত শনি ও রোববার (২৭-২৮ জুলাই) অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের গ্রীষ্মকালীন মিলনমেলা। এবারের স্থান ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ গজে আইল্যান্ড, যা দক্ষিণ উপকূলে ব্লু সিটি গজে শহরের প্রধান দ্বীপ। বিএসএকের এবারের ১৭তম মিলনমেলায় সবার সরব উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়।
দক্ষিণ কোরিয়ার অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা ছাড়াও পোস্ট ডক্টরাল ফেলো ও বিভিন্ন পেশাজীবীরা আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে মিলনমেলায় যোগ দেন। মিলনমেলায় অংশগ্রহণকারীরা সবাই গত শনিবার দ্বীপের মাঙ্গচি ট্রেইনিং সেন্টার ও হানা প্যানশনে রাতযাপন এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। রোববার সবাই মিলে দ্বীপের কিছু মনোরম ও দৃষ্টিনন্দন জায়গা ঘুরে দেখেন।
মিলনমেলার প্রথম দিন শনিবার বিএসএকে কর্তৃক আয়োজিত মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রিত অতিথিরা সবাই অংশ নেন। বিকেল ৫টা ৩০ মিনিটে কনকুক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য মাস্টার্স ডিগ্রিপ্রাপ্ত তানিয়া সুলতানা ও চোন্নাম বিশ্ববিদালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত মো. গোলাম রব্বানীর উপস্থাপনায় জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে শুরু হয় দুই দিনব্যাপী আয়োজনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। স্বাগত বক্তব্য দেন বিএসএকের ইটিআরটি সদস্য ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে পিএইচডি প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত শরিফ মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন। সংগঠনের কার্যক্রম সম্পর্কে সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন ইটি সদস্য ও খাংওন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত রাফিউল হক রাহাত।
এবারের মিলনমেলায় প্রধান অতিথি ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব ও দূতালয় প্রধান রুহুল আমিন। এ ছাড়া আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আরও ছিলেন দূতাবাসের কর্মকর্তা, বিএসএকের উপদেষ্টা ও বিসিকেসহ কোরিয়ার বিভিন্ন কমিউনিটির নেতারা। নবীন ও ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের হাতে ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট তুলে দেন মিলনমেলার প্রধান অতিথিসহ অন্য অতিথিরা। সর্বাধিকবার অংশগ্রহণ করার জন্য ড. হাসান তুরাবিকে সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। নবীনদের পক্ষে জিসান ইসলাম ও ডিগ্রিপ্রাপ্তদের পক্ষে বক্তব্য দেন ড. মো. সালাউদ্দিন। বিদায়ী ইটিআরটিদের পক্ষে স্মৃতিচারণা করেন বুসান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য মাস্টার্স ডিগ্রিপ্রাপ্ত মোহাম্মাদ তোফায়েল আহমেদ। বাংলাদেশি গবেষকদের পক্ষ থেকে বিএসএকে নিয়ে অভিমত প্রকাশ করেন ড. পি কে রয়।
প্রধান অতিথি তাঁর বক্তব্যে উচ্চশিক্ষাপ্রত্যাশী শিক্ষার্থী ও কোরিয়ায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা এবং বাংলাদেশের আর্থসামাজিক কাজে অংশগ্রহণের জন্য বিএসএকেকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানান। বিএসএকের নানা কার্যক্রমের প্রশংসা করার পাশাপাশি মেধাবী শিক্ষার্থীরা যাতে নিজ দেশমাতৃকার কল্যাণে কাজ করতে পারে সেদিকে আলোকপাত করেন। অনুষ্ঠানে বিএসএকের পক্ষে সমাপনী বক্তব্য দেন সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত ড. নূরুল হুদা ভুঁইয়া। সংগঠনকে যাঁরা নানাভাবে সাহায্য–সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনসহ আমন্ত্রিত অতিথি ও অন্য সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব বিএসএকে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা শুরু হয় চোসান বিশ্ববিদালয়ে মাস্টার্স লিডিং পিএইচডি প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত হাসানুল বান্না ও গুনসান বিশ্ববিদালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত তাহমিনা তাসনিম নাহারের উপস্থাপনায়। সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা সাজানো হয় কোরিয়ায় পড়াশোনা করতে আসা শিক্ষার্থীদের গান, নাচ, কবিতা, জাদু ও মেয়েদের বালিশ খেলা দিয়ে। এ খেলা চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধান করেন কোয়াংউন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত শরৎ চন্দ্র বর্মণ।
বিএসএকের মিলনমেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল বারবিকিউ। এবারের আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত হয় বিএসএকে ফুটবল নাইট, যা বিএসএকের রাতের আড্ডায় নতুন এক মাত্রা যোগ করে। যেখানে অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক ১০টি ফুটবল টিম। সমুদ্রের পাশে তরুলতায় ঘেরা ফুটবল মাঠটিতে ১১টার দিকে খেলা আরম্ভ হয়ে চলে রাত ২টা পর্যন্ত। চাঁদের আলোর সঙ্গে ছিল ফ্লাডলাইট আর সেই সঙ্গে ছিল সমুদ্রের তীরের আছড়ে পড়া ঢেউয়ের গর্জন, যা মিলনমেলাকে করে তোলে মনোমুগ্ধকর। এই আনন্দের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে রাতের ঘড়ি যেন এসে থেমে গেছে এখানে। নিজ গৃহে সময় ধরে চলা মানুষগুলো এদিন নিয়মের অবাধ্য হয়ে আড্ডা দিতে থাকে। কখন যে ভোর হয়ে যায় সেদিকে কারও খেয়ালই ছিল না।
মিলনমেলার দ্বিতীয় ও শেষ দিন প্রায় দুই শ শিক্ষার্থীসহ অতিথিরা বিএসএকের পাঁচটি বাসে করে গজে দ্বীপের বিখ্যাত সব আকর্ষণীয় ও মনোরম স্থানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে বেরিয়ে পড়েন। দিনব্যাপী চলে এই দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ। ছবি তোলার পাশাপাশি সবাই মন ভরে উপভোগ করেন এই ভ্রমণ। এরই মাঝে সবাই অংশগ্রহণ করেন বিএসএকের মধ্যাহ্নভোজে। এরপর ছুটে চলেন সমুদ্রের বুকে। চলতে থাকে সমুদ্রস্নান।
এক সময় পশ্চিম আকাশে সূর্য হেলে পড়ে। সমুদ্রের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া একঝাঁক পাখির নীড়ে ফেরা দেখে বুকের পাঁজরে কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। কারও বুঝতে বাকি থাকে না ফিরতে হবে নিজ নিজ ঘরে। আবার সেই চার দেয়ালের গবেষণাগারে। আপনজনকে রেখে দেশ থেকে হাজারো মাইল দূরে নিজ কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত মানুষগুলো কিছুক্ষণের জন্য ভুলে ছিল তার সব ব্যস্ততা। বুকের কোণে কিছুটা তৃপ্তি, কিছুটা কষ্ট এবং আবারও দেখা হবে বিএসএকের সামনের শীতকালীন মিলনমেলায়। এই আশা নিয়ে মিলনমেলার স্থল থেকে কেউ দল বেঁধে, কেউ বা আবার একাই রওনা দেন নিজ গন্তব্যের উদ্দেশে।
কৃতজ্ঞতা: জি এম রব্বানী।
মো. হাসানুল বান্না: পিএইচডি শিক্ষার্থী, ফটোনিক ন্যানো ম্যাটেরিয়ালস ল্যাবরেটরি, দক্ষিণ কোরিয়া।