থমকে যাওয়া জীবন, মৃত্যুর আলিঙ্গনে ২

আড্ডায় লেখকের সঙ্গে অন্যরা। ছবি: সংগৃহীত
আড্ডায় লেখকের সঙ্গে অন্যরা। ছবি: সংগৃহীত

মার্চের মাঝামাঝি। আকাশে ঝকঝকে রোদ, কিন্তু তখনো বরফ গলেনি কোথাও। শহরের গাছগুলো শুকিয়ে কাঠের মতো চেহারা নিয়ে ভীষণ বিব্রত যেন। ভীষণ এক বিষণ্নতা তাদের ছুঁয়ে আছে। বসন্ত আসতে এখনো অনেক দেরি। অপেক্ষার পালা যেন শেষ হয় না। তারপরও কোনো কিছুই থেমে নেই।

সেদিন বন্ধু নাসিমার বাসায় দাওয়াত ছিল। অনেক দিন পর আবার বাঙালি আড্ডা। মাঝেমধ্যেই এ রকম আড্ডা হয় আমাদের প্রবাসীদের বাসায়। প্রবাসী বাঙালি সারা সপ্তাহ কাজ করে ছুটির দিনগুলোতে মেতে থাকে দাওয়াত খাওয়া, আড্ডা, আর হইচই নিয়ে। কেউ কেউ এতই ব্যস্ত থাকে যে দু–এক মাস আগে থেকে তাদের দাওয়াত না দিলে তাদের সিডিওল পাওয়া যায় না। অনেক পদের রান্না থাকে, চা খাওয়া হয় অনেকবার, সবাই বাঙালি সাজে সেজেগুজে আসে।

সবে সন্ধ্যা নেমেছে। শীতের রাত খুব তাড়াতাড়িই অন্ধকার হয় রাস্তাঘাট। রাস্তায় গাড়ি চলাচলও কমে যায়। এই সময় রাস্তায় মানুষের দেখা মেলা অসম্ভব। এইট স্ট্রিটের কোনায় বড় একটা গাছের নিচে গাড়ি রেখে আমরা তার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকলাম। আজ আর তেমন কেউ সেজেগুজে আসেনি। সবাইকে একটু চিন্তিতই মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছে করোনা নামের ভাইরাসের আতঙ্কে সবাই বেশ ভীত।

অতিথিরা এসেই দুই ভাগ হয়ে গেল। নারীরা এক রুমে, পুরুষেরা আরেক রুমে। এখানেও সব সময় পক্ষপাতিত্ব হয়। পুরুষেরা সাজানো–গোছান লিভিং রুমে বসে আর নারীরা বসে শোয়ার ঘরে। কখনো গাদাগাদি করে বসতে হয়। তবে তবে আজ এই নারী-পুরুষ বৈষম্যের কারণে আমার সুবিধাই হলো। আমি জ্যাকেট খুলে দুটি বালিশ মাথার নিচে দিয়ে বিছানার কোনায় শুয়ে পড়লাম। বেড়াতে এসে বিছানা দখল করা ভদ্রতা না হলেও আমার এ ছাড়া উপায় ছিল না। গাড়িতে বসেই টের পাচ্ছিলাম, শরীরে একদম শক্তি পাচ্ছি না। গলাব্যথা আর ভীষণ জ্বর জ্বর ও লাগছে। আমার বেশ চিন্তাই হচ্ছিল। কারণ আমাকে আজ যে চায়নিজ বাচ্চার সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে, তার প্রচণ্ড কাশি, হাঁচি ছিল। গায়ে একটু জ্বরও ছিল। বাচ্চাটা বেশ কয়েকবারই আমার গায়ে গা ঘেঁষে বসেছে। দু–তিনবার হাঁচিও দিয়েছে আমার গায়ে। আমার কিন্তু আজ একদমই ভালো লাগছিল না। ভীষণ ভয় লাগছিল, ভাবছিলাম, বাচ্চাটা আমাকে কোভিড–১৯ দিল না তো? আমি গলাব্যথা আর জ্বর জ্বর ভাব নিয়ে ভীষণ অস্বস্তির মধ্যে চুপচাপ বসে রইলাম। বুঝতে পারছি না আমাকে কোনো ভাইরাস আক্রমণ করল কি না। দ্বিধায় ভুগতে থাকলাম, বাসায় চলে যাব কি না। গলায় ওড়নাটা পেঁচিয়ে রাখলাম ভালো করে। অতিথিরা সবাই বেশ দূরেই আমাকে পেছন দিয়ে চেয়ার আর টুলে বসে গল্প করছিল।

বাঙালি আড্ডাপ্রিয়। এ রকম আড্ডায় অযথাই হাসাহাসি হয়, গল্প হয়। সত্যি বলতে কি, প্রবাসে ছোটখাটো ঘরোয়া পার্টিতে মনখুলে হেসে, আলাপ চারিতায় অনেকটাই মনের চাপ দূর হয়। পরের সপ্তাহের জন্য আবার নূতন করে প্রাণশক্তি পাওয়া যায়।

সবাই বেশ হইচই করে গল্প করছে। আজকের গল্পের বিষয় কোভিড-১৯ এবং কানাডা। কানাডিয়ানরা নাকি সবাই ভীষণ অস্থির হয়ে আছে। লোকজন ভালোই হাসাহাসি করল এসব নিয়ে। বিশেষ করে সাদাদের টয়লেট পেপার কেনার হিড়িকে একটু যেন মজাই পাচ্ছিল সবাই। একজন বলল, ওদের একটু বদনা ট্রেনিং দিলে কেমন হয়?

আমাকে বলা হলো, কলি ভাবি, আপনি বদনা ট্রেনিং নিয়ে একটা ব্লগ বানান।
বললাম, ওকে, আপনি মডেল হোন।
না আমি কেন হব, যার ব্লগ সেই হোক।

সবাই হো হো করে হাসতে লাগল। পেছনের দিকে বিছানায় শুয়ে আমিও তখন হাসছি। মনে হচ্ছিল, আসলেই তো তেমন আর কী বিপদ। করোনার ভয় হলে লোকজন এমন হাসাহাসি করতে পারে? তবে বাঙালিরা হয়তো পারে।

শীলা বলল, এত হাসবেন না। সমূহ বিপদ। কসকোতে এক মাইল লম্বা লাইন ছিল আজ। সব খাবারদাবার শেষ।

আমরা তবুও হাসছি। বললাম, ওরা তো একটা তেলাপোকা দেখলেও ভয় পায়। শীলা, কিছুই হবে না।
দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় আনিসুল হক জোক লিখেছেন, করোনাভাইরাস চায়নিজ ভাইরাস।

সবাই খুব মজা পেল। মোটামুটি একমত হলো লেখকের সঙ্গে, করোনা হচ্ছে চায়নিজের তৈরি এবং এটি তেমন শক্ত আর জুতসই হবে না। ডলার স্টোরের জিনিসপত্র যেমন কেনা মাত্রই কিংবা দুদিন পরে ভেঙে যায়, এটাও ভেঙে যাবে।

একজন বললেন, শীলা, ভয় পেয়ো না। আসলে শীলাটা সত্যিই ভয় পেয়েছে মনে হচ্ছে। মুখ গোমড়া করে বসে আছে একটা টুলে। এ কথা শুনে আবারও সবাই হাসতে লাগল। শীলা এখানে সবার ছোট। আমার ছোট বোন হিসেবে সবাই একটু বিশেষ স্নেহ করে ওকে।

বলা যায় না, শীলা বলল। বাজারে কিন্তু জিনিসপত্র সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। চাল, ডাল যা পারেন কিনে রাখেন।

কানাডায় ছুটির দিনে আড্ডায় বসেন বাঙালিরা। চলে গালগল্প আর খাওয়াদাওয়া। ছবি: সংগৃহীত
কানাডায় ছুটির দিনে আড্ডায় বসেন বাঙালিরা। চলে গালগল্প আর খাওয়াদাওয়া। ছবি: সংগৃহীত

আজ তেহারি রান্না হয়েছে এ বাসায়। নাসিমা ভাবি এক প্লেট তেহারি এনে আমার হাতে দিলেন। তেহারি আমার পছন্দের খাবার, কিন্তু আজ খেতে একটুও ভালো লাগছিল না। কোন স্বাদই নেই যেন। ব্যাগের ভেতর ফোনটা বাজছে। হাত মুছে তাড়াতাড়ি ফোন বের করলাম। এত রাতে কে ফোন করল?

আমার মেয়ে রোদেলার ফোন, কণ্ঠে বেশ উৎকণ্ঠা, আম্মু অন্টারিওতে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি সব বন্ধ করে দিয়েছে। অন্টারিওতে অনেক কোভিড পাওয়া গেছে। ভ্যানকুবারেও নাকি পাওয়া গেছে। আসলে আলবার্টাও পাওয়া গেছে মা। সব প্রভিন্সেই কিছু না কিছু পাওয়া যাচ্ছে।

তাই নাকি? কী বলো? আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম।
হ্যাঁ, অনন্টারিওতে পাওয়া গেছে বেশ কয়েকজন। আমি আসতে পারছি না, কারণ আমার চাকরি থেকে কিছু তো বলেনি এখনো।
কী বলো বাবা? তুমি ওদের জিজ্ঞেস করো, বলো আমার মা-বাবা সাসকাচুয়ান থাকে। আমাকে অত দূর যেতে হবে।
অপেক্ষা করতে হবে আম্মু। ওরাই বলবে।
আমার মেয়ে রোদেলা অটোয়ায় থাকে। সে ওখানে কার্লটন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ওই ইউনিভার্সিটিতে চাকরি পেয়েছে, শিক্ষকের সাহায্যকারী হিসেবে। শিক্ষককে সাহায্য করতে হয়, সেমিনার ওয়ার্কশপ আয়োজন করতে হয়। শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা করার জন্যই মূলত এসব চাকরি দেওয়া হয়। তার এই চাকরির মেয়াদ শেষ হবে এপ্রিলে।
আমি একটু অস্থির হলাম। চাকরি কি এত জরুরি। তুমি বলো তোমাকে বাসায় ফিরতে হবে।
না, মা আমি এসব বলতে পারব না। ওরাই বলবে, অপেক্ষা করো।
সে ফোন কেটে দিল। আমি গুমম হয়ে বসে রইলাম। এসব দেশে বড় হওয়া বাচ্চারা বেশির ভাগই হয়, সৎ আর দায়িত্ববান। আর কিছুটা নিজের মতামতে অনড়। শিশুকাল থেকেই তাদের স্কুলে মূল্যবোধ তৈরি করার চেষ্টা করা হয়। বাচ্চার স্কুলে এমনই শিখে, কোনো দায়িত্ব পেলে সেটা যেকোনো মূল্যেই শেষ করতে হবে। আমি ওকে ওর সিদ্ধান্ত থেকে নড়াতে পারব না। তার বেতন যা–ই হোক আর মেয়াদ দেড় মাসই থাকুক। ওর কাছে ওর পার্টটাইম চাকরিটা অনেক বড়। হয়তো এদিকে দেখা যাবে একদিন, দুদিনের ব্যবধানে টিকিটের দাম তার চাকরির বেতনের তিন গুণ হয়ে গেছে।
মেয়ের চিন্তায় পার্টি পানসে হয়ে গেল। চিন্তার কারণও আছে। যখন সন্তান একমাত্র হয় সেটি হয় কাচের পুতুলের মতো। মা-বাবা তাকে কোথায় রাখবে, কী করবে, সে চিন্তায় থাকেন অস্থির। সব সময় ভাবে, ইশ্‌, বাচ্চাটাকে কাচের শোকেসে সাজিয়ে রেখে দুচোখ ভরে শুধু তাকিয়ে থাকা যেত।
সবচেয়ে বড় কথা, এসব সদ্য তরুণ জেনারেশনকে বিশ্বাস করা যায় না। দেখা যাবে অপ্রয়োজনে বাইরে ঘোরাঘুরি করছে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। অটোয়া হচ্ছে রাজধানী। পৃথিবীর কত দেশের লোকজন আসে। ওখানে সবার আগে করোনা ছোবল দেবে। মেয়েটাকে ঠিকমতো বুঝিয়ে বলব সে সুযোগ দিল না। ফোনটা কেটে দিল। এসব ভাবতে গিয়ে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা শুরু হোল আমার।

আমার শরীরটা এত খারাপ লাগছিল যে কোনো কিছুই যেন স্পর্শ করছে না। রোদেলার বাবার কাছে উঠে গিয়ে ম্যাসেজটা দেব, সেই শক্তিটুকু যেন নেই। ওপাশের রুম থেকে রোদেলার বাবার জোরে জোরে গল্প করার আওয়াজ ভেসে আসছিল। আমার সবকিছুই ভীষণ বিরক্ত লাগছিল।

ছেলেরা যখন গল্প করে, হয়তোবা কোন বর্তমান ইস্যু নিয়ে, কিন্তু শেষ হয় গিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি দিয়ে। এদিকে এ বাসার মালিক কিংবা আমন্ত্রক বাবু ভাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশাল ভক্ত। শোনা গেল এজাজসহ সবাই তাকে জেঁকে ধরেছে। বাংলাদেশে করোনা হলে কীভাবে শেখ হাসিনা এর মোকাবিলা করবেন, বাংলাদেশ ভয়াবহ মহামারিতে মারা যাবে প্রচুর লোক, ইত্যাদি। সবার গলার স্বর ভীষণ উত্তেজিত। সবাই এত জোরে কথা বলছিল, যেন ঢাকার পল্টন ময়দান। এই হচ্ছে বাঙালি, যুগের পর যুগ থাকে কানাডায়, কিন্তু বাঙালি চরিত্র থেকে, সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। ধ্যানে, মনে, প্রাণে বাঙালিই রয়ে যায়। কানাডায় কী হচ্ছে, বিশ্বে কী হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি আগ্রহ বাংলাদেশে কী হচ্ছে তা নিয়ে।
আমি দু–তিনবার ফোন করলাম এজাজকে থামানোর জন্য। ফোন ধরেই সে বিরক্তি নিয়ে বলল, কী হয়েছে?
বাসায় চলো। সে যেন একটু অবাক হলো। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকল, পরে বলল, ঠিক আছে চলো।
গাড়িতে উঠে এজাজ বলল, কী হলো তোমার শরীর খারাপ হলো নাকি?
আমি একটু কাশলাম।
আবার দেখি কাশো। দেখো ঠেকেঠুকে কাশো। যা শুরু হচ্ছে। আমি তো আবার বৃদ্ধ মানুষ নিয়ে কাজ করি। আমার অসুস্থ হলে চলবে না।
এমনিতেই মেয়ে মনটা খারাপ করে দিয়েছে। এর ওপর এজাজের এমন কথায় মনটা ভালোই খারাপ হলো। শরীর খারাপ দেখে সহানুভূতি দেখাবে তা তো নেই, নিজের চিন্তায় অস্থির। বেশ তিতা মিশিয়ে রাগত সুরেই বললাম, আমি স্কার্ফে কেশেছি। তোমার ভয় নেই।

ইদানীং কি আমার সহ্য ক্ষমতা কমে গেল? আমি কেন যেন জোর করে কাশি চেপে রাখলাম। গলায় স্কার্ফ জড়িয়ে চুপচাপ বসে রইলাম, গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে।
সে বলল, বোঝো না কেন। দেখো না, কী করোনাভাইরাস এল পৃথিবীতে, এখন কেউ কাশি দিলেই ভয় হয়।
এত ভয় পেলে চলে?
আমি বৃদ্ধদের নিয়ে কাজ করি। বৃদ্ধরাই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি নাজুক বা অস্থিতিশীল।
তার সঙ্গে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। মনকে প্রবোধ দিলাম, সামান্য গলাব্যথা আর কাশি। গরম পানি দিয়ে দুটো প্যারাসিটামল খেয়ে ঘুমিয়ে থাকলেই ভালো হয়ে যাব।
গাড়িতে বসে জানালা দিয়ে অন্ধকার দেখছিলাম। অন্ধকার আমার ভয় লাগে। রাস্তার বাতির অল্প আলো–আঁধারিতে তখন বাড়িগুলো ভীষণ রহস্যময় মনে হয়। টেইলর রোড ধরে এগিয়ে গেলেই রাস্তাটা ভীষণ নির্জন। আর মাঝরাতে সবকিছুই আরও বেশি রহস্যময়, আরও উদ্ভূত মনে হতে থাকল। তখনো জানতাম না তো আরও ভয়ংকর অন্ধকার এগিয়ে আসছে ধেয়ে, যার নাম করোনা। সেদিন রাতে আমার বেশ জ্বর এল, গা কাঁপিয়ে। চলবে...