তোমার হাতের রাখী খানি

বন্ধু খোঁজ নেয় বান্ধবের। সমস্যা-সম্ভাবনায়-প্রতিকূলতায় আনন্দ প্রহরে বসে আসর। সেখানে আলোচনার মধ্য দিয়ে ঝালাই করে নেয় নিজের বিশ্বাস আর ধারণাকে। তথ্য ভান্ডারকে করতে চায় আরও সমৃদ্ধ। শুধু নেওয়া নয়, দেওয়ার মধ্য দিয়ে মহান করতে চাল চলমান মুহূর্তকে। এটা একটি সাধারণ অনুমান। তবে সেদিন বিষয়টি বিশেষ একটি অর্থ নিয়ে হাজির হয়। কথাগুলো রবীন্দ্রনাথ থেকেই প্রাপ্ত। যেন রাষ্ট্রদূত বলছেন, তোমার হাতের রাখী খানি বাঁন্ধো আমার দখিন হাতে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান। সংলাপে, আচার আচরণে তাঁর বন্ধু বাৎসল্য প্রকাশ পায় শিশিরে সূর্য রেখার মতো। তিনি কয়েক দিন আগে আবুধাবিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতপ্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক-লেখকদের আহ্বান করেছিলেন দূতাবাসের দরবার হলে। তারা প্রীতিভোজ গ্রহণ করেন রাখীবন্ধনে। তবে তার আগে বাংলাদেশ থেকে মানব পাচার নিয়ে এক মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রদূত কথার ফুল ছেটান। সাংবাদিক-লেখকেরাও যার যার জায়গা থেকে নিজের বক্তব্যটি তুলে ধরেন।
মানব পাচারের খবর বিভিন্নভাবে শোনা গেছে। তবে তার তীব্রতা যে এতটা বেড়েছে সে ধারণা করা যায়নি। তারা সাগরে ভেসেছে, মুক্তিপণ দিয়েছে। আবার জীবনও গেছে তাদের। বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা মুসলমান অভিবাসীদের প্রথম গণকবর আবিষ্কৃত হয় থাইল্যান্ডের এক গহিন জঙ্গলে। এ নিয়ে হইচই শুরু হয়ে যায় সারা বিশ্বে। এর মধ্যে খ্যাতনামা সব সংবাদমাধ্যম থেকে বেরিয়ে আসছে আরও আরও লোমহর্ষক খবর।
থাইল্যান্ডের একটি জেলাকে পাচারকারীরা অভিবাসন প্রত্যাশীদের স্থানান্তরের ক্ষেত্র হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে আসছিল। অর্থের বিনিময়ে তারা ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছে সেখানকার মানুষকে। গ্রামবাসীরা বন্দী শিবিরের ওপর নজরদারি ও তাদের খাবার সরবরাহ করত। চলমান মানুষদের মধ্যে বাঙালি অভিবাসনপ্রার্থীরাই যে সিংহভাগ সে কথা সহজেই অনুমান করা যায়।
এরই মধ্যে ৭২৭ বাঙালিকে আন্দামান সাগর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ৭১০ অভিবাসীর একটি তালিকা পাঠানো হয়েছে কুয়ালালামপুর হাইকমিশন থেকে। সে ফিরিস্তি এখন স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। তাদের জাতীয়তা নিশ্চিত হলে দেশে পাঠানো হবে। আরও খবর, ৬৫ জন অভিবাসন প্রার্থীকে বহনকারী একটি নৌযান ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব উপকূলে উদ্ধার হয়েছে। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারের মানুষ এরা।
পত্রিকার পৃষ্ঠায় বড় বড় শিরোনাম এখন। এসবই বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে বিনষ্ট করছে। একদিনে হয়ে ওঠেনি এ আয়োজন। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সংঘবদ্ধ এক বা বহু চক্র এত বড় সর্বনাশ করছিল। তবে এ সংবাদ কেউ টের পাবে না এমনটিও কাম্য নয়।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের অবস্থাটি জানার জন্যই রাষ্ট্রদূতের এ আয়োজন। প্রয়োজনে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদও এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কিছু নয়। শোনা যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে মানুষ ওমান, সৌদি আরব, কাতার যাচ্ছে এখান থেকেও। নৌযান কিংবা অন্য উপায়ে পাড়ি জমাচ্ছে তারা। এও শোনা যায় দুবাই বিমানবন্দর হয়ে তারা ইউরোপ কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় ছুটবে। রাষ্ট্রদূত বললেন এমন কথা। সাংবাদিক-লেখকরাও তাঁর কথায় সহমত পোষণ করেন। এ কথা ঠিক, কোনো অস্থিরতা দৃশ্যমান নয়। নেই কোনো উচ্চবাচ্য। সে কারণে মানব পাচারের বিষয়টি আরও আরও বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
সাংবাদিক–লেখকেরা গৃহকর্মীদের ব্যাপারে মতামত দেন। কেউ এ দেশে এলে দূতাবাস তাকে গ্রহণ করবে। সেখান থেকে হস্তান্তরিত হবে গৃহকর্তার হাতে। লেবার উইংয়ের একটি টিম নিয়মিত খোঁজ নেবে তাদের।
স্পর্শকাতর বিষয় মানব পাচার। রাষ্ট্রদূত সে কথাটি উল্লেখ করেন। তাই তিনি সাংবাদিক-লেখকদের ডেকেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন সংবাদ কর্মীদের থাকে বিভিন্ন যোগাযোগ। তাদের পক্ষে সর্বশেষ খবরটি জানা সম্ভব তা যেকোনো বিষয়ে যেকোনো প্রান্ত থেকে। এ ব্যাপারে কোনো তথ্য পেলে অগ্রিম ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে তাঁর পক্ষে। রাষ্ট্রদূত এ ব্যাপারে তরুণদের ইগল দৃষ্টির আহ্বান জানান।
একা নয় সমগ্রের গুরুত্ব আনে। রাষ্ট্রদূত সেই আলোকে দেখেন বিষয়টি। সে জন্যই তাঁর এই আয়োজন। সংবাদকর্মী ও লেখকেরা তাঁকে সহায়তা করতে পারেন। তাঁর ধারণা ভুল নয়। সেদিনের এই উদ্যোগটিও এ ক্ষেত্রে বাস্তবানুগ।
রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শুরু করেছিলাম। কথাগুলো তাঁর গানের পূজা পর্ব থেকে নেওয়া। সূর্য তার আলোক প্রভা পৃথিবীর হাতে রেখে রাখীবন্ধন করে। তেমনি বন্ধুতে বন্ধুতে রাখীবন্ধন রাখবার অনুরোধ তাঁর। রাষ্ট্রদূত বন্ধুত্বের খোলা মন নিয়েই সেদিন এই আয়োজন করেছিলেন। দূতাবাসের রাজনৈতিক কাউন্সিলর শাহাদত হোসেন ও শ্রম কাউন্সিলর আরমান উল্লাহ চৌধুরী এ সময় ছিলেন তাঁর সঙ্গে।
বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেট্রনিক মিডিয়ার প্রতিনিধিরাসহ লেখকেরা তাদের এ ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে রাষ্ট্রদূতকে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। বোধ করি সে জন্য তাদের মুখাবয়ব থেকেও আলো ঝরছিল। বলাই যায়, তোমার রাখী বাঁধো আঁটি, সকল বাঁধন যাবে কাটি। কর্ম তখন বীণার মতন বাজবে মধুর মূর্ছনাতে।