তুরস্কের আন্টালিয়ায় স্বর্ণালি বালুকাময় সৈকতে

আন্টালিয়ার একটি অবকাশযাপন কেন্দ্রের সুইমিংপুল

অবকাশযাপন কিংবা ভ্রমণের জন্য ইউরোপিয়ান পর্যটকদের বড় একটি অংশের প্রথম পছন্দ তুরস্কের (নতুন নাম তুর্কিয়ে) অন্যতম প্রধান পর্যটন নগরী ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী আন্টালিয়া। সেদিকে লক্ষ রেখেই এখানে গড়ে উঠেছে আকর্ষণীয় পর্যটন অবকাঠামো। সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধার সমন্বয়ে আরামদায়ক আবাসন আর মনকাড়া সুইমিংপুল। সঙ্গে আছে অনেক রকমের ওয়াটার রাইড।

আন্টালিয়ার হোটেল-মোটেল আর রিসোর্টগুলো এখন স্থানীয় এবং বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনায় মুখরিত। গ্রীষ্মের শুরুতেই জমজমাট হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন পালাক্রমে বেড়ে চলেছে নতুন পর্যটকদের আগমন। এটা টের পাওয়া যায় এয়ারপোর্টে নেমেই।    

তুরস্কের পর্যটন স্থাপনাগুলোতে অবশ্য বিদেশি বিনিয়োগ বেশ বড় রকমের। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে তুর্কি সরকার সম্ভাব্য সব রকমের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। করপোরেট হাউসগুলোর বাইরে ব্যক্তিপর্যায়েও তুরস্কে বাড়িঘর কেনা অনেক সহজ। আর ফ্ল্যাট কিংবা বাড়ি কিনলেই পাওয়া যায় টার্কিশ সিটিজেনশিপ লাভের উপযোগ্যতা। এ কারণে বিদেশি নাগরিকদের তুরস্কের প্রপার্টি ক্রয়ে ইস্তাম্বুলের পরই স্থান পেয়েছে আন্টালিয়া।

হলিডে রিসোর্টে শারীরিক কসরত দেখাচ্ছেন এক তরুণী সার্কাসকর্মী

এমনিতেই সারা বছর মধ্যপ্রাচ্য ও রুশ পর্যটকদের কাছে ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী শহরগুলো ভ্রমণের জন্য সেরা পছন্দ। এর বাইরে প্রচুরসংখ্যক ইউরোপিয়ান পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে যায় এ সময়ে। বিশেষ করে মে মাসের মধ্যভাগ থেকে সেপ্টেম্বরের শেষাবধি পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত থাকে।

আন্টালিয়া বিমানবন্দরে নেমে ইমিগ্রেশনের জন্য খুব একটা বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। অতীতে ইউরোপিয়ান পাসপোর্টধারীদের জন্য অনঅ্যারাইভাল ভিসা এবং ই-ভিসার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বেশি পরিমাণ পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য সম্প্রতি অনেকগুলো রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য ভিসা ফ্রি ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়েছে। ব্রিটিশ পাসপোর্টে ভ্রমণের কারণে ইমিগ্রেশন অফিসার একটি ওয়েবক্যামে আমাদের ছবি তুলে পাসপোর্টে সিল মেরে দুই মিনিটের মধ্যে তুরস্কে প্রবেশের অনুমতি দিলেন।

আন্টালিয়া মোটামুটি বড় এলাকা। আমাদের রিসোর্ট ছিল আলানিয়া নামক স্থানের কাছে। আগে থেকেই আমাদের এয়ারপোর্ট ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করা ছিল। আমরা জেট২ এয়ারলাইনসের একটি হলিডে প্যাকেজে রওনা হয়েছিলাম। সব জায়গায় তাদের এয়ারলাইনসের পোশাকে এজেন্টরা তৎপর। তাই কোনো ধরনের ঝক্কিঝামেলা নিয়ে আমাদের চিন্তা ছিল না।

মিউজিকের সঙ্গে অনবদ্য নৃত্য প্রদর্শনরতা দুই তরুণী

আমাদের রিসোর্টে যখন পৌঁছালাম, তখন স্থানীয় সময় প্রায় তিনটা বাজে। ফ্লাইটে বিলম্ব ছিল এক ঘণ্টার মতো। এর মধ্যে তারা ঘোষণা করল ফ্লাইটে খাবার দিতে পারবে না সরবরাহকারীর ব্যর্থতার জন্য। তাই সঙ্গে রাখা হালকা স্ন্যাক্সই ছিল ভরসা। তবে দীর্ঘ ভ্রমণজনিত ক্লান্তিতে ক্ষুধা বৃদ্ধি পেলেও এত রাতে খাবার পাওয়া নিয়ে কিছুটা সংশয় ছিল।

কিন্তু আমাদের রিসোর্ট তাদের সার্ভিস এমনভাবে সাজিয়েছে, যেখানে দিনের ২৪ ঘণ্টা কোনো না কোনো খাবারের ব্যবস্থা রেখেছে। আমরাও তাই মধ্যরাতে পেলাম সালাদ, চিকেন নাগেটস, ফ্রাইস ও বান। সঙ্গে চা কফি কিংবা সোডা ড্রিংকস।

আমাদের রিসোর্টে সাঁতারের জন্য ছিল চারটি পুল। এর মধ্যে তিনটি ছিল বিভিন্ন রকম ওয়াটার রাইডের সঙ্গে সংযুক্ত। শিশু-কিশোর কিংবা ছেলে-বুড়ো সবার কথা চিন্তা করেই বিভিন্ন গভীরতায় তৈরি করা হয়েছে সুইমিংপুলগুলো। আকারেও অনেক বড়। তাই পর্যটকদের সংখ্যা বেশি হলেও সমস্যা নেই। শুধু সানবেড পাওয়াটা একটু কঠিন। সে জন্য প্রাতে এসে তোয়ালে রেখে সানবেডের দখল নিতে হয়।

আন্টালিয়ায় ভূমধ্যসাগরের স্বর্ণালি সৈকতে লেখক

রিসোর্ট থেকে বের হলেই পাওয়া যায় অসংখ্য তৈরি পোশাক, লাগেজ এবং মেয়েদের ব্যাগের দোকান। সব জিনিসই পশ্চিমা নামীদামি ব্র্যান্ডের। কিন্তু এগুলো নকল। দামটাও নাগালের মধ্যে। পশ্চিমা মার্কেটের আসল দামের প্রায় এক–চতুর্থাংশের চেয়েও কমে মেলে বিশ্বের সেরা ব্র্যান্ডের পণ্য। তাই এসব দোকানের ব্যবসা-বাণিজ্যও মোটামুটি জমজমাট।

এসব দোকানের সামনে দিয়ে গেলেই হ্যালো আবি, হাউ আর ইউ আবি, কাম ইনসাইড আবি—এসব কথা শোনা যায়। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম আবি মানে ভাই। মেয়েদের বলা হয় আবলা (আপা)। ইঞ্জিনের কাছ থেকে আমরা ভালো সার্ভিস পাচ্ছিলাম। স্থানীয়ভাবে ক্রুজ এবং কিছু ওয়াটার রাইডের একটি প্যাকেজ প্রোগ্রাম নিতে চেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু ইঞ্জিনের সার্ভার বিগড়ে যাওয়ায় তিনি সেই প্যাকেজ আর বিক্রি করতে পারলেন না।

বুঝতেই পারছেন ইঞ্জিন আসলে একজন ব্যক্তির নাম! তিনি আমাদের হলিডে কোম্পানির একজন কাস্টমার সার্ভিস এজেন্ট। শেষ পর্যন্ত ইঞ্জিন আমাদের জন্য একটি শপিং ট্যুরের ব্যবস্থা করলেন মানাঘাট নামক স্থানে ফ্রি ট্যাক্সি সরবরাহ করে।
মানাঘাটে তৈরি পোশাকের একটি রিটেইল আউটলেটে দেখা হলো যুক্তরাজ্যের ডান্ডি শহরের ডেরেক নামের এক ব্যক্তির। ষাটের কাছাকাছি বয়স। স্ত্রীকে নিয়ে দুই সপ্তাহের অবকাশ কাটাতে এসেছেন আন্টালিয়ায়।

কিছু স্পোর্টস ব্র্যান্ডের টি-শার্ট কিনেছেন ডেরেক। বললেন, এখান থেকে কিনে নেওয়াই ভালো। বিলেতের দোকানে এগুলোর যে দাম, সে তুলনায় এখানে কিছুই না। ডেরেকের স্ত্রী ইতিমধ্যেই স্থানীয় বাসে চড়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। বেশ উৎফুল্লভাবে বললেন, ট্যাক্সির চেয়ে অনেক কম দামে এখানে বাসে ঘুরে বেড়ানো যায়। সময় তেমন একটা বেশি লাগে না। মাত্র ১৫ লিরা ভাড়া।

সমুদ্রসৈকতে যাওয়ার জন্য আমাদের রিসোর্ট থেকে রাখা হয়েছিল ফ্রি কোচ সার্ভিস। প্রতি ২০ মিনিট পরপর ছেড়ে যায় এই শাটল সার্ভিস। অবশ্য হেঁটে গেলেও ১০ মিনিটের বেশি লাগে না।

আন্টালিয়ার সমুদ্রতীরের সোনালি বালুকণায় খালি পায়ে হাঁটার অনুভূতি সত্যিই অভাবনীয়। শান্ত ভূমধ্যসাগরের ছোট ছোট ঢেউ তীরে এসে আছড়ে পড়ছে। রৌদ্রকিরণে ঈষৎ উত্তপ্ত বালুকণায় সমুদ্রের বয়ে যাওয়া বাতাস শরীর–মনে এক অদ্ভুত ভালো লাগার সঞ্চার করে। আমাদের নিয়ে যায় প্রকৃতির অতি কাছাকাছি।
প্রচুরসংখ্যক ইউরোপিয়ান পর্যটক সারা দিন সানবেডে শুয়ে থাকেন সমুদ্রতীরে। পশ্চিমা দেশগুলোতে এমনিতেই সৌরালোকের অনুপস্থিতি থাকে বছরের বেশির ভাগ সময়।

তাই গ্রীষ্মে তারা সানবাথ করে যতটুকু সম্ভব এই ঘাটতি পুষিয়ে নেন। কারণ, সূর্যের পর্যাপ্ত আলোর অভাবে শরীরে ভিটামিন ডির অভাব দেখা দেয়। হাড় ম্যাজমেজে হয়ে যায়। বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের যত কাছাকাছি যাওয়া যায়, ততই নতুন অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ ঘটে। কিন্তু ভাষাগত কারণে স্থানীয়দের সঙ্গে বেশি একটা ভাব জমানো যায় না। পর্যটন এলাকা হলেও স্থানীয় লোকজন এখনো ইংরেজিতে তেমন একটা পারদর্শী নন।

অবশ্য যেহেতু সেখানে প্রতিবেশী রাশিয়ান ও অ্যারবিয়ান পর্যটকদের সমাগম বেশি, সেহেতু তাঁরা সেসব ভাষা অনেকটা রপ্ত করে ফেলেছেন। সন্ধ্যার পর এখানকার প্রায় প্রতিটি রিসোর্টে বসে লাইভ বিনোদন মেলা। সংগীত ও সার্কাসের কারুকার্য আর নানা রকম পানীয়ের আয়োজনে চলে ব্যস্ত জীবন থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে আনন্দ উদ্‌যাপনের মাধ্যমে মানসিক অবসাদ থেকে মুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা।

ভ্রমণ এবং হলিডে বা অবকাশযাপন পশ্চিমা দুনিয়ার জীবনযাপনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার স্বীয় কর্মক্ষেত্রে ফিরলে পূর্ণ উদ্যমে কাজে মনোনিবেশ করা যায়। একঘেয়ে জীবনের ক্লান্তি দূর করতে এর চেয়ে বড় দাওয়াই অবশ্য দুনিয়ার কোনো জায়গাতেই বেশি কিছু নেই।

লেখক: বদরুল হোসেন বাবু, যুক্তরাজ্যে বসবাসরত পরিব্রাজক