
হাসান আবুধাবির একটি নির্মাণ কোম্পানির সুপারভাইজার। তার কোম্পানির বাঙালি এক ইঞ্জিনিয়ার তাকে বেশ পছন্দ করেন। স্নেহের টান আছে তার ওপর। সেই সূত্রে ওই ইঞ্জিনিয়ারের বাসায় তার একটু আসা-যাওয়া আছে। একদিন এই তরুণ ইঞ্জিনিয়ার তার সহধর্মিনীকে নিয়ে বসেন সংগীতা রেস্তোরাঁয়। সেখানে হাসানকেও ডাক দেওয়া হয়।
পরিবেশন কর্মী চায়ের ট্রেটা সামনে রাখতেই ঝন করে একটি শব্দ হয়। এই শব্দটি হাসানকে মনে করিয়ে দেয় আরেকটি চিত্র।
কেয়া মিষ্টির প্লেটটা হাসানের দিকে এগিয়ে দেয়। অন্যটি বড় কাকাকে। দুই কিশোরীকে নিয়ে জেরিন বসেছে বড় মামার সামনাসামনি। তারা বসামাত্র জমে ওঠে ঘরটি। কেয়া এদিকেও মিষ্টির প্লেটগুলো দেখে নিচ্ছে। ঠিকমতো সেসব অন্যরা পাচ্ছে কিনা তাও পরখ করছে। এরপর সে বসে হাসানের সামনে।
তাগো কী এতখানি দূরে থাকার কথা ছিল? হাসানের অনুচ্চ স্বর কেবল কেয়া পর্যন্তই পৌঁছায়। সে রাজভোগটি চামচে কেটে কেয়ার ঠোঁটের সামনে নেয়। দ্বিতীয়জন না করে না। এক ধরনের অনুভবে তার চোখ বুজে আসে।
আতিক মাস্টার এখানে কারও কাকা, কারও মামা। বরাবরই ছোটদের ওপর অপার টান তার। এখানেও এটা ব্যতিক্রম ঘটেনি। তিনি তাদের সঙ্গে গল্পে মেতে উঠেছেন। এখানকার একটি নাম লক্ষ্মীনারায়ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার। এদের রাজভোগ অনেক খ্যাতি কুড়িয়েছে। তাই কেউ মুকসুদপুরে এসে এই মিষ্টি না খেয়ে বাড়ি ফেরে না। আতিক মাস্টার চাননি তার ভাইজি ও ভাগ্নিরা এই স্বাদ থেকে বঞ্চিত হোক। টুলু আর একটু নে, জুলু খাসনি যে, এমনি আপ্যায়ন তার।
জেরিন মিষ্টি পছন্দ করে। তবে মামার আগ্রহে আজ সে মিষ্টিময় পরিবেশটা উপভোগ করছে। মিষ্টি পর্বে সে যতটা না খাচ্ছে তার চেয়ে বেশি আনন্দ পাচ্ছে মামার কাণ্ড দেখে।
ছোট ভাইয়ের মেয়ে কেয়াকে সঙ্গে নিয়ে আতিক মাস্টার ডাক্তার দেখাতে এসেছেন। এর আগে কিছুটা চুপচাপ থাকলেও এখন তিনি সজীব। হাসান তার ভাগনে। হাসানের সঙ্গে জেরিনের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের দিন উপস্থিত থাকা সম্ভব হয়নি। আজ এক জায়গায় হয়ে তিনি যেন ঈদ পুনর্মিলনী করছেন।
হেইড্যা তো তুমিই চাইল্যা না। কেয়ার কিছুটা আবেগ আর কিছুটা অভিযোগ ঝড়ে পরে যেন। চোখ দুটো তার ছলছল করে ওঠে।
আসলে...। হাসান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল।
তুমার জন্যিই না! হাসানকে কিছু না বলতে দিয়েই কেয়া জ্বলে ওঠে। সে আগুন দাউ দাউ করে ওঠে না। তুষের মতো নিজের মধ্যে জ্বলতে থাকে। এর যন্ত্রণা অনেক কষ্টে সে তার বুকের গভীরে ধারণ করে নেয়।
আতিক মাস্টারের সংসার অনেক বড়। তারা পাঁচ ভাই। একই উঠানের চারপাশে ঘরগুলো। উঠানটা অনেক বড়। বিশাল এই খোলা জায়গায় এসে যে কারও বুক কেঁপে ওঠে। এদের সহায়-সম্পত্তি, এসবের প্রভাব, এদের মধ্যেও দোলা দেয়। এটা যেন এই বংশের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরা ছেলেমেয়ে বাইরের গণ্ডিতে বিয়ে দেন না। এদের সম্পত্তি বাইরে যাতে না যায়, এই ব্যবস্থাটা হয়তো সেই চেষ্টারই অংশ।
তবে হাসান আর কেয়ার বিয়ের কথায় তমিজ মিয়ার রাজি না হওয়ায় ব্যাপারটি অনেকটাই প্রত্যাশার বাইরে ছিল। কমবেশি সবার মধ্যে এমন একটা ধারণা এসেছিল যে, ওদের বিয়ে হবে এবং তা হলে আত্মীয় অনাত্মীয় সবাই খুশি হবে।
তমিজ মিয়া কেয়ার বাবা। অন্য কথায় আতিক মাস্টারের ছোট ভাই। মেয়ের বিয়ে হবে তার বড় কাকার সিদ্ধান্তে। ঘরের টিন কেনা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই মাস্টারের কাছে আসে গ্রামবাসীরা। তারা পরামর্শ নেয়। দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে সবাই এমনটিই দেখে আসছে। মাস্টারি চাকরির শুরুর লগ্ন থেকে এ দায়িত্ব তার ওপরই এসে পড়ে। নিজের সংসারের বেলায়ও শতভাগ তারই পছন্দ-অপছন্দ বা বিবেচনা। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি গড়ায় ভিন্ন দিকে। সেটা মাস্টারের অসুস্থতার কারণে।
কথাটি কেয়ার মার কাছে পয়লা পাড়ে হাসানের কাকা। কেয়ার মা সে কথা আবার পৌঁছে দেয় কেয়ার বাবার কাছে। এদিকে কেউ একজন বলেছে, টাকা বাঁচানোর জন্য মিয়ার ব্যাটা মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে আপন ভাগনের সঙ্গে।
তমিজ মিয়া হাসানের কাকাকে চেনেন। জানেন তার এক শ গুণ। তিলকে তাল করে ঝামেলা পাকানোতে গাঁয়ে তার জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু এত কিছু বোঝা বা জানার পরও তিনি এবার বিন্দুমাত্র ভাবেন না। মাস্টার ভাই জান তার অসুস্থ, সে বিষয়টাও বিবেচনায় নেন না। যেন এখনই কেয়ার বিয়ে দিতে হবে। এ কথা চলে যায় হাসানের কাছে। কিন্তু হাসান বিয়ের জন্য এখন জোগাড় নয়। এ কথা তৎক্ষণাৎই জানিয়ে দেয় সে।
হাসানের মা এই বার্তা নিয়ে আসে। ভাইকে জানায়, যাক কিছুদিন। মূলত সহোদরকে একটু ধৈর্য ধরতে বলেন। মাস্টার ভাই জান তত দিনে সুস্থ হয়ে উঠবেন। তারপর আস্তে ধীরে সবকিছু করা যাবে।
এতে তমিজ মিয়ার রাগ কমে না। বরং বলা যায় ঘৃতে অগ্নি পড়ে। না সেটা হতে পারে না। কেন? বোন তার নিজের। ভাগনেও তাই। ছোটবেলায় মামারা তাকে লালন পালন করেছেন। লেখাপড়া যতটুকু যা শিখেছে তা এই বাড়ি থেকেই। সে কেন এমন ছাড়া ছাড়া কথা বলবে। অন্যদিকে এই বংশের কী আছে না আছে তা পাঁচ গাঁয়ের মানুষ জানে। তারা করে পয়সার ভয়! এটা তার গোষ্ঠীর অপমান। তমিজ মিয়া চিল্লাচিল্লি করে গোটা বাড়িটা মাথায় তোলেন।
ডাক দেওয়া হয় চাচাতো বোনকে। সে আগেই চেয়েছিল তার ঘরে তারই ভাইজিকে নিতে। তখন এ কথা পাত্তা পায়নি। হয়তো এর কারণ অর্থ। সে সময় ওরা পয়সাকড়িতে কিছুটা দুর্বল ছিল। এবার মেয়ের বাবাই জানায় তার ইচ্ছের কথা। বোনের পক্ষ থেকে আপত্তি না থাকলে তিনি এই চাঁদনি রাতেই বিয়েটা সেরে দিতে পারেন। বোনটা ততটা বুঝে উঠতে পারে না। ভাইই বুঝিয়ে দেন। বুলা হগগলরে! তিনি বাতলে দেন সব করণীয়।
বাজান ডাফাইয়্যা ডাফাইয়্যা কইল। তুমার কোনো কাজ খবর নাই। এইডা অয়? হাসানকে বলে কেয়া।
কেয়াকে পছন্দ করে তরুণ। তার ইচ্ছের কথাটি সবাই জানে।
তুমরা পুইষ্যা ছাওয়াল। তুমাগোই তো আওগ্যায় কতা কইতি অবি। কেয়া একটু দম নেয়।
কেয়ার মন্তব্যে হাসান তার হৃদয়ের ঠিক মধ্যিখানে এক ধরনের হাহাকার অনুভব করে। আজই যেন সে বুঝতে পারে, কেয়া নয়, তারই জন্য তাদের ঘরবাঁধা সম্ভব হয়নি। বড় মামার বড় একটা অস্ত্রোপচার হয়েছে। তার বিশ্রামের প্রয়োজন। ছোট মামা পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারেননি। তাহলে তার ভূমিকাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু হাসান ছিল সে সময় উদাসীন। এটা ঠিক হয়নি। এই বুঝ থেকে সে একটু টানাপোড়েন অনুভব করে নিজের মধ্যে।
আমার মাথার ওপরে বড় বোঝা তহন। হাসান বলে।
জাহান আমার টেন হুনে জিগাইছে, হাসান কি কইছে! আমি কই হ্যার নিশান নাই। কেয়ার ঠোঁট দুটো কাঁপতে থাকে। সে পানির গ্লাসটি মুছে নেয়।
জাহান ওদের দুজনের খালাতো বোন। সে মামা বাড়িতে থাকে। তার মাধ্যমে হাসান ও কেয়া একজন আরেকজনের কাছাকাছি আসে।
অন্য ঘরে বিয়ে অইলি নতুন এক ঘর কুটুম অবি। এই কথা আমারই। কেয়া তার তারুণ্য তুলে ধরে। ফিরে যায় তাদের আগের আনন্দময় সময়ে।
আমি জোগাড় ছিলাম না। হাসান বলে।
থাক ভালো অইছে। কেয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
তা কও কেমুন আছ! হাসানের গলাটা ধরে আসে।
কি জন্যি, কি কবা? কেয়ার মিষ্টি মুখের দাঁতগুলো চকচক করে ওঠে। এ যেন টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে বিদ্যুতের ঝলকানি। এদিকে বেলা থাকতেই বাড়ি ফিরতে হবে।
কেয়া! বড় কাকার কণ্ঠে বাড়ি ফেরবার তাড়া?
হাসান ভ্যান ঠিক করে। বড় মামা সামনে বসেন। টুলু সামনে, কেয়া পেছনে। মুখ তার হাসানের দিকে। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে হাসান, জেরিন আর জুলু।
বদলে যায় চরাচর। নিসর্গ ভারাক্রান্ত হয়। পাখিদের ডানা লেগে আসে। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। তরুণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তরুণীর দিকে। তখন প্রকৃতি থেকে হৈমন্তি শুক্লার কণ্ঠ ভেসে আসে।
আমার বলার কিছু ছিল না। নাগো...
চেয়ে চেয়ে দেখলাম, তুমি চলে গেলে।
হাসানের গাল বেয়ে জল আসে। অন্যদিকে কেয়াও আঁচল দিয়ে চোখ মোছে।
হাসান তুমি কাঁদছ? ইঞ্জিনিয়ারের সহানুভূতি প্রকাশ পায়।
কই না তো। কিছুটা থতমত খায় সে।
অতঃপর তাড়াতাড়িই সে অন্য প্রসঙ্গ তোলার চেষ্টা করে।
(লেখক সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিপ্রবাসী)