তিন প্রজন্ম
বড় ঘরের ছেলের কাছে আমাকে বিয়ে দিতে পেরে মনে হলো বাপজান বহুদিন পর শান্তিতে ঘুমাতে পারছিলেন। বিয়ের আগ পর্যন্ত বাপজান ভয়ে ছিলেন কাশেম ভাইকে নিয়ে, যদি বিয়েতে কোনো বাগড়া দিয়ে বসেন! কাশেম ভাই আমার বড় ফুফুর ছেলে। বিএ পাস করে গ্রামের যুবকদের নিয়ে সংগঠন করেন। ভবঘুরে মানুষ বলেই সবাই তাঁকে জানে। আমাকে বলেছিলেন, তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হলে তিনি কিছু একটা করবেন। বড় ফুফু যেবার কাশেম ভাইয়ের জন্য আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন, বাপজান বড় ফুফুকে খুব অপমান করেছিলেন সেদিন। সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, বেকারের কাছে মেয়ে বিয়ে দেবেন না, মেয়েরে বড় ঘরেই বিয়ে দেবেন। ফুফু বহু বোঝালেন, তিনি আমারে মাথায় করে রাখবেন, আর তিন মাসের মধ্যে যদি কাশেম ভাই কিছু একটা না করেন তবে বাপজান যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। বাপজানের এক কথা তিন মাসের মধ্যে ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসলে তিনি এদিকে ফিরিয়ে দেন, আর ওই দিকে কাশেম ভাই কিছুই করতে পারলেন না। এই তিন মাসের মধ্যে বাপজান তিনজন ঘটক লাগালেন আমার বিয়ের জন্য। যত দ্রুত আমাকে বিদায় করা যায় ততই মঙ্গল। বিয়েতে বড় ফুফুদের দাওয়াতও করা হয়নি।
কাশেম ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রেমের কোনো সম্পর্ক ছিল না, তারপরও কেমন যেন একটা টান ছিল। তাঁকে দেখলেই মনের ভেতরে এক ধরনের চঞ্চলতা জেগে উঠত। কাশেম ভাই আমাদের বাড়িতে আসলে মা চাইতেন না, আমি তাঁর সামনে বেশি বের হই। আর আমি চাইতাম কোনো ছুতোয় যেন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। দূর থেকে তাঁর শরীরের আলাদা এক গন্ধ পেতাম।
শুনেছি কাশেম ভাইয়ের রমরমা ব্যবসা এখন। গ্রামের যুবকদের নিয়ে কী সব সংগঠন করে তাঁর অনেক উন্নতি হয়েছে। গ্রামের বেকার যুবকদেরও কর্মসংস্থান হয়েছে। আমার ছোট আরও দুই বোন আছে। আমার গায়ের রং ফরসা হলেও মেজো বোনটার গায়ের রং শ্যামলা। ঘটককে বহু টাকা দিয়েও বাপজান তার মেজো মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজে পাচ্ছেন না।
ছোট ফুফু সেদিন আমাদের পাশের গ্রামে তাঁর শ্বশুর বাড়ির এক আত্মীয়কে দেখতে এসেছিলেন। যাওয়ার পথে আমাকেও দেখতে এসে জানিয়ে গেলেন, বাপজান মাফ চাইতে গিয়েছিলেন বড় ফুফুর বাড়িতে। আর প্রস্তাব দিয়ে আসছেন, চাইলে বড় ফুফু তাঁর মেজো মেয়েকে কাশেম ভাইয়ের বউ করে আনতে পারেন। শুনেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠেছিল সেদিন। এই মোচড় দিয়ে ওঠাটা কাশেম ভাইয়ের প্রতি টানে নয়, বরং যার সঙ্গে এত দিন ধরে সংসার করি তার প্রতি টান না হওয়ার জন্য।
বিয়ের এত বছরে এক দিনের জন্যও নিজেকে সুখী মনে হয়নি। আমার আড়তদার ব্যবসায়ী বর বয়সে আমার তিনগুণ। বয়সে তিনগুণ বড় বলে তার সঙ্গে আমার দূরত্ব হয়নি; দূরত্ব গড়ে উঠেছিল প্রেমের অভাবে। তার শখ প্রতিদিন ছয়-সাত পদের তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়া। লোকটা কোনো দিন আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি। সম্পর্ক যা অন্ধকার ঘরে শরীরে শরীর খুঁজে নিয়েছে, মনের খবর জানে না কেউ কারও। তার সঙ্গে এমনিতেই মনের মিল হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। মিল ছিল একটা জায়গাতেই, সে যেমন আমার সবকিছুতে ভুল খুঁজে পেত, আমিও তেমনি তার কোনো আচরণ মেনে নিতে পারতাম না। আমরা দুজনেই দুজনের সমান প্রতিপক্ষ ছিলাম। তফাৎ ছিল এই, তিনি আমার ছোট-বড় যেকোনো ভুলে যেমন হাউকাউ করতেন, সেখানে আমার রাগ হলে আরও চুপচাপ হয়ে যেতাম। এটা ইচ্ছা করেই করতাম। এই চুপচাপ হয়ে যাওয়া ভয়ের বা পরাজয়ের কারণে নয়, বরং তাকে যে আমি পাত্তা দিই না সেটাই বুঝিয়ে দেওয়া। আমাকে রাগাতে বাপ-মা তুলে গালিও দিতেন। আমি নীরব থেকেই তার উত্তর দিতাম। যদি রেগে গিয়ে পাল্লা দিয়ে দুই কথা তাকেও শুনিয়ে দিতাম, তাহলে হয়তো এত রাগ তার মধ্যে কাজ করত না। কিন্তু আমি চাইতাম সে রেগে থাকুক, সে আরও উত্তেজিত হোক, পারলে উত্তেজিত হতে হতে আমার শ্বশুরের মতো মরে যাক। যাকে ভালোবাসি না, যে আমাকে ভালোবাসে না তার আচরণ নিয়ে সুখ-দুঃখ পাওয়ার কোনো মানে হয় না। আমাদের সম্পর্কটা প্রতিযোগিতার সম্পর্ক ছিল, আমাদের সম্পর্ক ছিল সারাক্ষণ একজন আরেকজনরে রাগীয়ে দেওয়ার সম্পর্ক।
তবে আমার শাশুড়ির ধারণা, এত দোষের মধ্যে তার ছেলের ভালো গুণ হলো, শ্বশুর মশাই যেভাবে তার গায়ে যখন-তখন হাত তুলতেন, তার ছেলে সে রকম না। সে যা বলার মুখ দিয়েই বলে। পুরুষ মানুষের রাগ তো একটু থাকবেই, গায়ে না মাখলেই হয়। শাশুড়ির এই কথায় আমার রাগ হওয়ার কথা, কিন্তু মায়া হয়। আমার জন্যও তার অনেক মায়া আছে টের পাই। তিনি আজ পর্যন্ত আমার কোনো ভুল ধরেননি। কত সংসারে শুনি, বউ-শাশুড়ির যুদ্ধ হয়। তারপর ছেলেরা বউ নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। আমার মন চায়, শাশুড়িকে নিয়ে কোথাও আলাদা হয়ে যাই। আমার ছেলেকে বলা যায় শাশুড়িই বড় করছেন। ছেলের জন্মের পর প্রথম দিকে কিছুই বুঝতাম না—কীভাবে যত্ন নিতে হয়, খাওয়াতে হয়। শাশুড়ি সব সামলে নিয়েছেন। শাশুড়ির ভালোবাসা পেয়েই বুঝেছি, ভালোবাসার মানুষের ভুল আমাদের চোখে পড়ে না, বরং যাকে ভালোবাসি তার ভুলগুলো ভালোবাসা দিয়ে শুধরে দিই। তাকেও বুঝতে দিই না, তার ভুল ছিল। কারণ ভুলগুলো নিয়েই তো সে ভালোবাসার মানুষ।
আমার শাশুড়ি নিজের ছেলেকে খুব ভয় পান। কথা বলার সময় ছেলে তাকে ছেড়ে কথা বলে না। শাশুড়ি সব সময় বলেন, মেজাজ পাইছে ছেলে বাপের মতো, বাপের মেজাজ দেখে দেখে শিখছে কীভাবে মায়ের ওপর মেজাজ দেখাতে হয়। হয়তো এ জন্যই শাশুড়ির সঙ্গে আমার সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
সেদিন বেড়াতে এসে খালা শাশুড়ি যখন আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তখন শাশুড়িকে বলতে শুনলাম, আমার ছেলের সামনে ভুলেও বউয়ের প্রশংসা করবি না, বুঝসইতো ওর বয়স হয়েছে আর বউটা এখনো কচি, দেখতেও সুন্দরী। কেউ যখন বউয়ের রূপ গুণের প্রশংসা করে, ছেলে তখন নিজেরে মনে মনে দুর্বল ভাবে, নিজের সঙ্গে বউয়ের তুলনা করে খামাখা নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়। তার রাগ হয়, আর শেষে সব রাগ গিয়ে পড়ে বউয়ের ওপর। অযথা বউয়ের দোষ খুঁজে ঝগড়া লাগায়ে দেয় আর অশান্তিতে মরে নিজে।
বউয়েরও কিছু করার নেই। যেই রকম আছিলাম আমি। ছেলের বাপের যন্ত্রণায় মন চাইতো ঘর থেকে কোথাও উধাও হইয়া যাই, শুধু ছেলের জন্য পারতাম না। লোকটা মরার পর বহুদিন শান্তিতে ছিলাম, কিন্তু এই ছেলে বড় হওয়ার পর একেবারে বাপের লাহান হইছে। কিসের জন্য যে এত রাগ বুঝি না। শুধু বুঝি, এই রাগ তারেও শান্তিতে থাকতে দেয় না।
আমার খালা শাশুড়িকে বলতে শুনলাম, কিন্তু পোলাটারে দেখলে তো তেমন মনে হয় না বুবু। শাশুড়ি বললেন, আমারে দেখে কী বাপের বাড়ির লোকজন কোনো দিন বুঝতে পারছিল কতটা কষ্টে ছিলাম।
তুমি এত কষ্টে ছিলা, কও নাই কেন বুবু? কইলে কী হইতো! বিয়ের সময় বাজান তো বলেই দিছিলেন, বিয়ের পর স্বামীর ঘরই আসল ঘর। আমার তো যাওয়ার মতো কোনো জায়গা আর ছিল না ওখানে। যাওয়ার জায়গা থাকলেই না কষ্টের কথা বলা যায়। শাশুড়ির কথাগুলো শুনতে শুনতে কবে যে নিজের চোখ ভিজে আসছিল টের পাইনি।
সময় পাল্টে গেছে, দুনিয়া পাল্টে গেছে। কিন্তু মেয়েদের জীবনের গল্পগুলো একেবারেই পাল্টায়নি। সে হোক ষাট বছর আগের আমার শাশুড়ির, আমার অথবা আজকে আমার বউমার জীবন। মানুষ যেমন আধুনিক হয়েছে, যন্ত্রণাগুলো আধুনিক হয়েছে পাল্লা দিয়ে। অন্যের সঙ্গে তুলনা করে নিজের কষ্টের ওজন কমানো যায় না। ছেলে পড়াশোনা করে শিক্ষিত হয়েছে। শহরে বড় চাকরি করে, শিক্ষিত চাকরিজীবী মেয়ে বিয়ে করেছে। কিন্তু আচরণ সেই গ্রামের বাপ, দাদার মতো। বউমার গায়ে হাত তুলতেই বউমাও যখন ছেলের গালে কষে একটা চড় বসিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল হন হন করে, তখন মনে হলো দুনিয়াটা পাল্টানো শুরু হয়েছে মনে হয়। যেটা আমার বা শাশুড়ির পক্ষে সম্ভব ছিল না শুধু যাওয়ার জায়গা ছিল না বলে। মেয়েদের যত যোগ্যতা থাক, যাওয়ার জায়গা না থাকলে সব যোগ্যতাই অচল। বউমা ছাড়া ঘরটা কেমন খাঁ খাঁ করছে। খাঁ খাঁ করছে বুকের ভেতর…।