তাসের ঘর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সুখ-শান্তি যখন শুধুই ব্যক্তিগত বা পারিবারিক, তখন সেটা হয় খুবই সাময়িক। কারণ, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতায় যদি একই সঙ্গে সমানভাবে সুখ-শান্তি বজায় না থাকে, তাহলে সেই সুখ স্থায়ী হয় না। আমরা দিন দিন এত আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি যে আশপাশে কী ঘটছে, সে বিষয়ে পর্যন্ত সামান্যতম খোঁজ রাখি না। আমাদের পারস্পরিক বন্ধন, সহমর্মিতার অনুভূতিগুলো দিন দিন লোপ পাচ্ছে। নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ভার্চ্যুয়াল বাকযুদ্ধে নেমে যাচ্ছি। রাজনীতিবিদদের মতো আমরাও ধরে নিচ্ছি, জনগণও একইভাবে আমাদের মতোই ভাবছে এবং আমাদের সঙ্গে আছে। অন্যপক্ষও কিন্তু ঠিক একই রকম ভাবনা ভেবে প্রতি–আক্রমণ করে যাচ্ছে। আসলেও কী জনগণের সামান্যতম ভাবনাতে আপনাদের স্থান আছে কি না, সেটা ভেবে দেখার স্থান নেই। শিক্ষা আমাদের সাধারণ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে, সেই সঙ্গে তাদের ভাবনা থেকেও। আমরা দিন দিন যত শিক্ষিত হচ্ছি, ততই বিভক্ত হয়ে যাচ্ছি। আস্তিক-নাস্তিক, বাম-ডান, গোড়া-প্রগতিশীল—এমনই আরও কত শত দলে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছি এবং সুযোগ পেলেই এক পক্ষের গোষ্ঠী উদ্ধারে ব্যস্ত হচ্ছি। জানি না, এর শেষ কোথায়।

যুগে যুগে দেশে দেশে শিক্ষা মনন বিকশিত করে সত্যিকার মানুষ হিসেবে যেখানে গড়ে তুলেছে, সেখানে আমাদের দেশে শিক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে ধনী-গরিব, শিক্ষিত-চাষা, জ্ঞানী-মূর্খের মানদণ্ড। যারা লেখাপড়া জানে, তারা যারা লেখাপড়া জানে না, তাদের চরম অবজ্ঞার দৃষ্টিতেই দেখে থাকে এবং তাদের জন্য বিশেষণের কিছু শব্দও নির্দিষ্ট করে রেখেছে। এতে অবশ্য লেখাপড়া না জানা ব্যক্তিদের তেমন কিছুই আসে–যায় না। শিক্ষিত মানুষ এই শিক্ষাকে পুঁজি করে সমাজের সব ক্ষেত্রে নিজেদের কর্তৃত্ব নিয়ে নিয়েছে এবং তাদের নিজেদের মতবাদকে সিংহভাগ অশিক্ষিত মানুষের মতবাদ হিসেবে প্রচার করছে। যেমন একদল বলছে, দেশের মানুষ নাস্তিকদের বিপক্ষে, আবার একদল বলছে না দেশের মানুষ আস্তিকদের বিপক্ষে। একদল বলছে, দেশের মানুষ একমুখী শিক্ষার পক্ষে। অন্য দল বলছে, না, দেশের মানুষ বর্তমানে বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে। একদল বলছে, দেশের মানুষ সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে। অন্য দল বলছে, না, দেশের মানুষ অসম্প্রদায়িকতার পক্ষে। এই নিয়ে চলেছে অবিরাম কাদা ছোড়াছুড়ি। কিন্তু কেউ দেশের মানুষের মনের কথাটা আর জানতে চায় না।

দেশের সমাজে শ্রেণি ব্যবধানটা এখন এমন একপর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে সেটা ভেদ করে অন্য শ্রেণির মানুষের জীবনাচারণ জানার বা দেখার সুযোগ নেই বললেই চলে। যারা বেশ কয়েক পুরুষ ধরে শিক্ষিত, তাদের বংশধরেরা কখনোই জানতে পারবে না যে দেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠী এখনো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। তাদের চিন্তাভাবনা একেবারেই আলাদা। এমনকি যারা মাত্র এক পুরুষ বা দুই পুরুষ ধরে শিক্ষিত, তাদের অবস্থা আরও সঙিন। তাদের চেষ্টাই থাকে যেন ভদ্রসমাজ কোনোভাবেই বুঝতে না পারে, তারা এইমাত্র চাষা থেকে শিক্ষিত শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে। তাই তাদের শিক্ষিত জীবনাচারণ কিছুটা দৃষ্টিকটু দেখায়। যা–ই হোক, এই শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যখন বুঝতে পারে যে দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় অংশ এখনো চিন্তাভাবনায় অনেক পিছিয়ে, তখন তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে না, বরং তারা খুশিই হয়। তারা মনে মনে ভাবে, আমি আগেই বলেছিলাম না, চাষাদের কাছ থেকে কখনোই ভালো কিছু আসা করা যায় না। এরপর শুরু হয় তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা এবং চলতে থাকে নতুন কোনো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের বিষয় না তৈরি হওয়া পর্যন্ত। এই যে শিক্ষিত সমাজ অশিক্ষিত বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে তুচ্ছ–তাচ্ছিল্য করে, এটাতে কিন্তু চাষাদের তেমন কিছুই যায়–আসে না। কারণ, তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের জীবনে এটা নিয়ে ভাবার মতো সময় থাকে না। তাদের সারা দিন দিনমজুরি করে কোনোরকমে তিনবেলার খাবারের সংস্থান করতেই নাভিশ্বাস ওঠে। এরপর যেখানে কাইত, সেখানে রাইত। আর তারা সেই ভদ্রসমাজের ভাবনা জানবেই–বা কীভাবে? পেপার-পত্রিকা পড়ার মতো শিক্ষা বা আর্থিক সংস্থান থাকলে তো। ছেলেমেয়েরা কোনোমতে এক দুই ক্লাস পড়ে নিজের নামটা স্বাক্ষর করতে পারে, সেটাই অনেক। আর তারা জীবনের কষ্টকে নিয়তি বলেই মেনে নিয়েছে, তাই তারা কখনোই শিক্ষিত লোকদের জিজ্ঞেস করতে আসবে না যে বিদেশ থেকে তাদের গরিবিকে পুঁজি করে যে কোটি কোটি ডলার ঋণ আসে, সেটা যায় কাদের কাছে। এত ঋণের পরও তাদের কেন দারিদ্র্য ঘোচে না। তারা হয়তো জানেও না, যে শিশুটা আজ অপুষ্টি নিয়ে জন্ম নিল, সেও জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মাথার ওপর এক বিশাল ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে নিয়েছে।

শিক্ষিত মানুষের জীবনাচরণে কত ধরনের সমস্যা। তাদের কোনো কিছুই ভালো লাগে না। তাদের ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো খাচ্ছে না, পড়ছে না। তারা কেন ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না। এরপর কেন ভালো চাকুরি পাচ্ছে না। আরও উন্নতির জন্য কেন দেশের বাইরে যেতে পারছে না। সংগীত, কলা সব শিখতে হবে, তা না হলে ছেলেমেয়েতো চাষাই থেকে যাবে, পরবর্তিতে গর্ব করবে কী নিয়ে। নিজেদের শরীর দিন দিন ভারী হয়ে যাচ্ছে, সেটা ঠিক রাখার জন্য কসরতের ওত নেই। আর এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে তাদের মানসিক বিকার দেখা দিচ্ছে। এরপর তারা যাচ্ছে বিভিন্ন মানসিক চিকিৎসকের কাছে, ইয়োগার ক্লাসে। কিন্তু একজন চাষার জীবনে এসব সমস্যা তৈরি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তার শুধু একটাই চিন্তা পরের বেলার খাবার জোগাড় করতে হবে। না হলে আগের বেলার মতোই তাদের উপোস করে কাটাতে হবে। দিন দিন শিক্ষা এবং তার সরঞ্জামাদি এতই বেশি দামি হয়ে যাচ্ছে যে আগের প্রজন্মের মতো আর ছেলেমেয়েকে শিক্ষিত করার দুঃসাহস তারা দেখাতেই ভয় পাচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতে রাষ্ট্র নিজে দায়িত্বে ধনী–গরিবের জীবনমানের একটা সাম্যাবস্থা বজায় রাখছে, তাই তাদের তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো পরিসংখ্যানের দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে গেলেও এর বাস্তব চিত্র কিন্তু ভয়াবহ।

তবে সেই দিন হয়তো আর বেশি দূরে নয়, যখন পৃথিবীর খেটে খাওয়া মানুষগুলো তাদের এক বেলা অন্নের জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, ভেঙে ফেলবে শিক্ষিত সমাজের নিজেদের অহমিকায় তৈরি তাসের ঘর। পথে পথে থাকবে খেটে খাওয়া মানুষের পিঁপড়ার সারি, তাদের মধ্যে শিক্ষিত মানুষের মতো কোনো নেতা থাকবে না। তাদের কোনো নেতার দরকারও হবে না। কারণ, তারা সংখ্যায় অনেক অনেক বেশি হবে। সবাই নিজ নিজ তাগাদায় পেটের ভাতের তাগিদে এগিয়ে যাবে সামনের দিকে।

*মো. ইয়াকুব আলী, মিন্টো, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া