তাচ্ছিল্য

প্রচণ্ড বেগে আপেলটি কানের কয়েক ইঞ্চি ব্যবধানে শপাং করে ছুটে গেল। যেন ক্রিকেট খেলার ফাস্ট বল থ্রোয়িং। দৈব ক্রমে অথবা পঞ্চ ইন্দ্রিয় সক্রিয় থাকায় এ যাত্রা বেঁচে যাওয়া। ছোটবেলার ক্রিকেট প্র্যাকটিসই সম্ভবত স্বয়ংক্রিয়ভাবে মাথা সরিয়ে নিতে কিছুটা ভূমিকা রেখেছিল। কখনো ভালো ক্রিকেটার ছিল না। শুধু পাড়ার মাঠে বন্ধুদের নিয়ে খেলেছে, এই যা।
আচমকা রায়হানের ওপর এই আক্রমণের হেতু কি? সেকেন্ডের ব্যবধান হলেই তাকে হাসপাতালে নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প থাকত না। চোখের পলকে কঠিন এক পরিণতি বরণ করতে যাচ্ছিল সে। ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়।
প্রায়ই টেলিভিশনের খবরে দেখা যায়, এলোপাতাড়ি গুলিতে নিউইয়র্ক নগরীর কেউ আহত হচ্ছে, কেউ মারা যাচ্ছে। ধরে নেওয়া হয় যে, ভুক্তভোগীরা বেচারা দর্শক, যারা ভুল সময়ে ভুল স্থানে ছিলেন। দুর্ভাগ্যই তাদের সেখানে নিয়ে গেছে। রায়হানের পরিণতিও কি তা-ই হতে যাচ্ছিল?
ছেলেমেয়েরা কত ছোট। হাইস্কুলের গণ্ডি এখনো পেরোয়নি। বিদেশ বিভুঁইয়ে তার অনুপস্থিতিতে ওরা জীবনযুদ্ধে হেরে যাবে। যদিও অনেকেই বলে, মা-বাবা না থাকলেও এখানে ছেলেমেয়েরা দিব্যি বেড়ে ওঠে। স্টেটস তাদের নিয়ে যায়। কিন্তু রায়হান এই ফস্টার কেয়ার ছেলেমেয়েদের পরিণতি সম্পর্কে ভালোই জানে। এনপিআর রেডিও স্টেশন শুনতে শুনতে সে অনেক ব্যাপারে পণ্ডিত হয়ে গেছে বলা যায়। অবশ্য কেউ সেটা বিশ্বাস করে না। বিশেষ করে জরিনা বেগম। বেশি বুদ্ধি বলেই নাকি আজ রায়হানের এই করুণ অবস্থা। সেটাই জরিনা বেগমের হান্ড্রেড পার্সেন্ট ধারণা।
রায়হান সংসার নামক যুদ্ধে প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে কিছু হয়ে যেতে পারে। বলতে গেলে প্রতিদিন দুঃস্বপ্নের মধ্যেই তার বসবাস। তার স্ত্রী জরিনা বেগম, প্রতি রাতে ঘরে ফেরার আগে তার একটা কল আসবেই। আজও এল। আর সেটিই বিপদ নিয়ে এল। ‘পেঁয়াজ নেই। পারলে সবজিও নিয়ে এসো।’
অতএব একটু আগেই ঘরে ফেরার ইচ্ছা হলো রায়হানের। মাত্র রাত একটা বাজে। জ্যাকসন হাইটসে বাংলাদেশি দোকানে না গিয়ে বাসার কাছে গ্রিক সবজির দোকানে যাবে মনস্থির করল। টাটকা শাক-সবজির জন্য এই দোকান তার পছন্দ। দাম অন্য দোকানের চেয়ে ঢের বেশি। টোয়েন্টিফোর আওয়ার্স খোলা থাকে—এ-ই সুবিধা।
সবজির দোকানে ঢুকেই নজরে পড়ল কোট-টাই পরা কৃষ্ণাঙ্গ এক ভদ্রলোক মধ্যখানে ঠায় দাঁড়িয়ে। প্রথমে মনে হয়েছিল দোকানের ম্যানেজার হবে হয়তো। সবজি কিনতে কিনতে কৃষ্ণাঙ্গ লোকটিকে পাশ কাটাতেই তার শরীর থেকে বিদঘুটে একটা গন্ধ নাকে এল। মাথা ঘুরে গেল। আর একটু সময় কাছে থাকলেই বমি করে দিত অথবা জ্ঞান হারিয়ে ফেলত। গন্ধেই টের পেল অনেক কাছে চলে গেছে। গ্রোসারিতে এমন কাছাকাছি হয়ে যাওয়াটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। রায়হান শুধু তার দিকে এক পলক তাকিয়ে ছিল। ইচ্ছাকৃত কোনো তাচ্ছিল্য ছিল না। মুহূর্তে ওর কাছে থেকে সে দূরে সরে যায়। ভুলেও লোকটার দিকে আর তাকায়নি। তীক্ষ্ণ গন্ধটা এত ঝাঁজাল যে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছিল না।
কনকনে শীতের রাত কিন্তু আকাশ একেবারে ধবধবে সাদা। না, এটাকে নীল আকাশ বলাই সমীচীন হবে। খেয়াল করেছে বরফ পড়ার সময় অথবা পরে আকাশ রাতে এভাবে দিনের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। বাইরে জমে থাকা বরফ শীতের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পরনে ওভারকোট, মাথায় শীতের টুপি, গলায় মাফলার, হাতে গ্লাভস, তবুও কাঁপছে সে। বাইরে সাজানো সবজিগুলো মূল দোকানের সঙ্গে কাচের মতো মুভেবল প্লাস্টিকের ডোর দিয়ে ঘেরা। সহজেই ক্রেতা ভেতরে আসা-যাওয়া করতে পারে। ঠান্ডা বাতাস থেকে সুরক্ষার জন্যই এ পদ্ধতি। সেখান থেকে সে বেছে বেছে পেঁয়াজ ভরছিল একটা পলিথিন ব্যাগে।
হঠাৎ দোকানের প্রবেশপথে চোখ পড়তেই দেখল, কালো লোকটি এতক্ষণে দরজার কাছে চলে এসেছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে জানে, অনেক সময় ম্যানেজার বাইরে এসে পর্যবেক্ষণ করেন। অনেক দিন আগে আমেরিকায় যখন প্রথম এসেছিল, ম্যানহাটনের ফিফথ অ্যাভিনিউতে একটা বড় স্টোরে কাজ খুঁজতে গেলে তাকে এরকম একটা সিকিউরিটির কাজ দিয়েছিল। প্রচণ্ড শীতের মাঝে ডোরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, যাতে কেউ কিছু নিয়ে পালিয়ে না যায়।
‘লিজ এক্সপায়ার এভরিথিং মাস্ট গো’ এই সাইন ঝোলানো আছে উইন্ডোতে। কিছু জিনিস বাইরে ডিসপ্লে করা। রায়হানের কাজ ছিল সেগুলো গার্ড দেওয়া। পাঁচ ডলার ঘণ্টাপ্রতি। মন্দ না। তার কোনো কাগজপত্র নেই। ম্যানেজারও কোনো ডকুমেন্ট চায়নি। একনজর তাকিয়েই বিশ্বাস জন্মে গিয়েছে। আসলে ওই সময় যারা দেশ থেকে এসেছিল, তাদের সবাই প্রায় ডেসপারেট ছিল। যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার অসাধারণ মনোবল রাখত ও ফিটফাট থাকত। রায়হানকে দেখেই ম্যানেজারের পছন্দ হয়ে যায়। তাৎক্ষণিক সেও কাজে লেগে যায়। আট ঘণ্টা কাজ করার পর নগদ চল্লিশ ডলার নিয়ে পরদিন আর কাজে ফিরে যায়নি। সেদিন ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার হাত-পা প্রায় অবশ হয়ে গিয়েছিল। এ রকম যখন ভাবছে, তখনই দেখল কালো লোকটি একটা আপেল হাতে নিয়ে প্রচণ্ড জোরে তার মাথা বরাবর ছুড়ে দিয়ে দোকান থেকে সাং করে বের হয়ে গেল। অর্থাৎ তার ওপর একটা ক্ষোভ ডিসচার্জ করল। ভাগ্যক্রমে রায়হান সরে যেতে পেরেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব সে। কেন লোকটি এমন করল কিছুই বুঝতে পারল না।
ভেতরে গিয়ে ম্যানেজারকে বিস্তারিত বলল। ম্যানেজার বাইরে এসে খুঁজল। ততক্ষণে কালো লোকটি হাওয়া হয়ে যায়। মিনিটের ব্যবধানে পুলিশ চলে আসে। সব বলা হলো তাদের। পুলিশ বাইরে গিয়ে সার্চ করল। কৃষ্ণাঙ্গ লোকটিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।
রায়হানের গাড়িটা পার্ক করা ছিল সিগন্যাল লাইটের ওপাশে। ভয় হচ্ছিল লোকটি যদি আশপাশে কোথাও ওত পেতে থাকে। দেখতে অনেক শক্তিশালী, পেটা গড়ন। রায়হান স্বাভাবিক হতে পারছিল না। ফের যদি আক্রমণ করে বসে অথবা তার ওপর আবার অন্য শক্ত কিছু নিক্ষেপ করে। রাস্তাঘাট একেবারে নিরিবিলি। লোকজনের আনাগোনা তেমন নেই। তাকে ফলোও করতে পারে বাসা পর্যন্ত। এমন তো হরহামেশাই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ততম এই নগরীতে। বন্দুকও থাকতে পারে সাথে।
কত কিছু মনে আসছে! গাড়ির কাছে কিভাবে যাবে তাও ভাবছে সে। বাসায় কল করে বলবে নাকি? জরিনা বেগম তো আরও ভয় পেয়ে যাবে! সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাজার নিয়ে গাড়ির কাছে গেল। না, তেমন কিছু ঘটল না। ঘরে ঢুকেই জরিনা বেগমকে সবকিছু খুলে বলল।
‘তুমি এই বমটার (হোমলেস) কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালে কেন? আসলেই তোমার বুদ্ধি-শুদ্ধি একেবারেই নেই, তুমি লোকটিকে ঘৃণা করেছ!’ জরিনা বেগম চিৎকার করে ভর্ৎসনা করতে লাগলেন রায়হানকে। কয়েক দিন হলো তাদের বাসায় ঢাকা থেকে ভাবি এসেছেন সরাসরি গ্রিনকার্ড হাতে নিয়ে। বলা যায় আমেরিকার বিশেষ অতিথি। রায়হানের এত বছরেও গ্রিনকার্ড ভাগ্যে জোটেনি। মেজ ভাইয়ের বাসায় এক মাস তো ছোট ভাইয়ের বাসায় দু মাস। রায়হানের বাসায় মাত্র এসেছেন। একমাত্র মেয়েকে যদি বুয়েট থেকে সরাসরি আর্কিটেকচার মেজর নিয়ে এখানে কোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রান্সফার করা যায়, সেই চেষ্টা। তারপর সোজা ঢাকার বাসায় চলে যাবেন। ভাই তো রিটায়ার্ড ব্যাংক কর্মকর্তা। এখন যে কদিন লাগে। তাঁরা আমেরিকায় থাকবেন না। কারণ আমেরিকার এই জীবনযাত্রা মোটেই পছন্দ নয় তাঁদের। কেউ সকাল ৪টায় কাজে যায়, আবার কেউ রাত ৩টায় বাসায় ফেরে। বাসায় এসেই ভাই-ভাবি রায়হানের কাজের স্কেজুয়েল দেখে অবাক হয়ে বলছিলেন, ‘আপনি সকাল সাতটা-পাঁচটা কাজ করেন না কেন?’
এবার তো পেয়ে বসবেন। রায়হান ভাবছিল তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েছেন; কিন্তু না দিব্যি জেগে আছেন। তাদের বায়োলজিক্যাল ক্লকটি এখনো বদলায়নি। বাংলাদেশের টাইমই ধরে রেখেছেন। বিষয়টি ভাবির কানে গেল। ‘আপনারা কিভাবে আমেরিকায় এভাবে বেঁচে আছেন! এটা একটা জীবন হলো? আমাদের বাংলাদেশ শতগুণে ভালো, আজকে ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেলেন’, ভাবি বলে চলছিলেন। রায়হান এই সবকিছুই যেন শুনছে না, এ যাত্রা ‘রং টাইম, রং প্লেস’ তার জন্য প্রযোজ্য হয়নি; এটাই মাথায় খেলছে। আজকের দিনের জন্য তার ভাগ্যদেবী যে সুপ্রসন্ন ছিলেন, সে ব্যাপারে সে পুরোপুরি নিশ্চিত। জরিনা বেগমের তো এ ব্যাপারে কোনো আইডিয়াই নেই। ভাবির তো বোঝার প্রশ্নই ওঠে না। কী ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে থেকে সে আজ নিজের জান নিয়ে ফিরে এসেছে।