তাঁর মতো আরেকজনকে আমরা পাব না
আনিসুজ্জামানের চলে যাওয়াটা আমাদের জাতির জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা যারা তাঁকে জানতাম এবং তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলাম, তাঁদের পক্ষে এটা একটা মর্মান্তিক দুঃখ। আনিসুজ্জামান অসুস্থ ছিলেন জানতাম, আশা করেছিলাম তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটা ঘটল না। যে সময়ে তিনি চলে গেলেন, সেটা আমাদের সবার জন্যই একটা কঠিন দুঃসময়। এখন মিলিতভাবে শোক প্রকাশেরও কোনো সুযোগ নেই। ফলে যন্ত্রণাটা আরও বেশি।
আনিসুজ্জামান অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর গভীর অনুশীলন। গবেষক হিসেবে তিনি অতুলনীয়। বাংলা সাহিত্যে মুসলিম লেখকদের অবদানের ক্ষেত্রে সাহিত্যের ইতিহাস-লেখকদের একধরনের ঔদাসীন্য ছিল। এ ক্ষেত্রে আহমদ শরীফ মধ্যযুগের মুসলিম লেখকদের অবদানকে আমাদের সামনে নিয়ে এসেছিলেন।
আনিসুজ্জামান আধুনিক কালের মুসলিম লেখকদের সাহিত্যচর্চার ওপরে যে গবেষণা করেছেন, সেটা আমাদের সাহিত্যের ইতিহাস রচনার যে দুর্বলতা ছিল, তা পূরণে সাহায্য করেছে। কিন্তু এটা তাঁর প্রাথমিক গবেষণা। এর পরে তিনি কোম্পানি আমলের বাংলা গদ্যের নমুনা লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিসের সংগ্রহশালা থেকে সংগ্রহ করে সেগুলো গবেষণার মাধ্যমে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, সেটা তাঁর গবেষণামনস্কতা ও অঙ্গীকারের প্রতিফলন।
আনিসুজ্জামান গবেষণার ক্ষেত্রে যেমন অসাধারণ, শিক্ষকতার ক্ষেত্রেও তেমনি অতুলনীয় ছিলেন। তাঁর ছাত্ররা যে কতভাবে তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন, এর পরিমাপ করা কঠিন। যাঁরা ভালো গবেষক ও সফল শিক্ষক, তাঁরা অনেকেই নিজেদের একটা গণ্ডি তৈরি করে নিয়ে তার মধ্যেই বিচরণ করতে পছন্দ করেন। আনিসুজ্জামান এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে তাঁর যে আগ্রহ ও দায়বদ্ধতা, সেটাও বলা যায় বিরল পর্যায়ের। জাতির যেকোনো সংকটের মুহূর্তে তাঁকে আমরা সামনে দেখেছি। অনেক ক্ষেত্রে তিনি নেতৃত্বও দিয়েছেন। কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং সেই সব প্রতিষ্ঠানই তাঁর কাছে গভীরভাবে ঋণী। তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। সবগুলো স্বীকৃতিই তাঁর প্রাপ্য ছিল।
দৃষ্টিভঙ্গিতে আনিসুজ্জামান ছিলেন উদারনৈতিক। আমার কাছে মনে হতো যে তিনি উদারনীতির একজন অতি উজ্জ্বল প্রতিনিধি। উদারনীতির যে গুণ—পরমতসহিষ্ণুতা, প্রসন্নতা ও সামাজিক অগ্রগতিতে বিশ্বাস—এই গুণগুলো তাঁর লেখা, কাজ ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে সব সময় উপস্থিত থাকত। তাঁর লেখার একটা নিজস্ব রীতি ছিল। সেই রীতিতে আমরা পেতাম বৈদগ্ধ, হৃদয়ানুভূতি ও সংযম। এই তিন গুণ সাধারণত একসঙ্গে থাকে না। কিন্তু আনিসুজ্জামানের ক্ষেত্রে তা ছিল। সে জন্য তাঁর লেখা ছিল সব সময় আকর্ষণীয়। সেখানে গবেষণা থাকত, থাকত চিন্তা, কিন্তু কখনোই ভারাক্রান্ত হতো না। তাঁর কোনো লেখাতেই কোনো অপচয় দেখিনি। তাঁর আত্মজীবনী আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস রচনার জন্য একটি মূল্যবান আকরগ্রন্থ।
সব প্রতিভাবান মানুষই অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র। আনিসুজ্জামানও স্বতন্ত্র ছিলেন। তাঁর মতো দ্বিতীয় আরেকজনকে আমরা আর পাব না।