তপন রায়চৌধুরীর সঙ্গে কিছুক্ষণ
(২০১১ সালে তপন রায়চৌধুরী মুক্তধারা আয়োজিত নিউইয়র্ক বইমেলায় আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এসেছিলেন। তখনই মুখোমুখি হয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে। উল্লেখ্য, এই নভেম্বরের ২৬ তারিখ ২০১৪ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। লেখাটি তপন রায়চৌধুরীকে স্মরণ করে।)
‘ক্ষেতে বর্ষা নেমেছে, হাঁটু অবধি জল, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে দুই চাষী ধানের চারার রক্ষণাবেক্ষণ করছে। প্রথমের প্রশ্ন, ক দেহি, মহারাণি ভিক্টোরিয়া এহন কি করতে আছে? উত্তর, হে কি আর আমাগো মতো? পানি নাবতেই পান্থাভাত খাইয়া কাঁথামুড়ি দিয়া উব্বুত।’ অংশটুকু লেখক তপন বাবুর রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা থেকে নেওয়া। তপন রায়চৌধুরীকে পড়ে শোনাতেই তাঁর ঘন কাঁচা-পাকা ভ্রু যেন আনন্দে নেচে উঠল। আর সেই সঙ্গে চোখের তারায় আলোর নাচন। মনে হলো চোখের পলকেই বুঝি তিনি বরিশালের কোনো গ্রামে চলে গেলেন। ভদ্রলোক যে খুব রসিক মানুষ, সে কি আর নতুন কোনো কথা? বরিশালের ভাষায় একটা কথা বলেন আর সারা শরীর কাঁপিয়ে সেকি হাসি! নিউইয়র্কের বিকেলে সূর্য অনেক আগেই বিদায় নিলেও কেমন জানি একটা গরমের খাই খাই ভাবটা রয়ে গেছে। এর মধ্যে মুক্তধারার বইমেলার আয়োজন উপলক্ষে জোয়ান বুড়ো সব কিসিমের মানুষের জোয়ারের ঢল।
সাধারণত যা হয়, চা কফি শিঙাড়ার পাশাপাশি বাঙালির চিরাচরিত আড্ডা যেন একাকার হয়ে মিশে গিয়েছিল বইমেলার মূল সুরের সঙ্গে। সেই সঙ্গে আমাদের বাড়তি পাওনা যোগ হলো প্রিয় লেখক তপন রায়চৌধুরী। ভদ্রলোক সম্পর্কে এখানে যে সবাই খুব ভালো জানেন তা কিন্তু নয়। তিনি হুমায়ূন, সমরেশ বা সুনীলের মতো জনপ্রিয় কোনো লেখক নন। তাঁকে হাতে গোনা যে কজন চেনেন বা তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচিত আছেন, তাঁদের আহ্লাদের সীমা নেই। আর থাকবেই বা না কেন বলুন? বাঙালনামা অথবা রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা গ্রন্থগুলো তো এখনো বাঙালির মস্তিষ্ক থেকে উধাও হয়ে যায়নি, নাকি? তবে এ কথা চোখ বুজেই বলা যায়, তাঁর সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ বাঙালনামার জন্য পূর্ববাংলার মানুষের অন্তরে যেন তিনি একটু বেশি পরিমাণেই আদৃত হয়ে আছেন। দূরে কে যেন বলেই উঠলেন, ‘দেখতে অইবো না..হেইয়া আমাগো তপন রায় না?’ বুঝলাম, শুধু আমাদের বাঙালদের মধ্যে বিশেষ করে বরিশালের মানুষের চোখে তপন রায়চৌধুরীর জায়গা অনেক ওপরে। কিন্তু তপন রায় এই বিষয়টাকে কীভাবে ভাবছেন?
‘আপনি বরিশালের মানুষের জীবন-যাপন, ভাষার বিশেষ টোন, রাগ-ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ—সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাদের পাতে তুলে দিয়েছেন। আপনি নিজেও একজন বরিশালের মানুষ। পড়াশোনা করেছেন বরিশাল কলেজিয়েট স্কুলে, তারপর কলকাতা দিল্লি ঘুরে বর্তমানে বিলেতে। আপনার স্কুলজীবনের এই ছোট্ট পরিসরে বরিশাল আপনার হৃদয়ে কতটুকু জায়গা দখল করে বসে আছে?’ প্রশ্ন শুনে তিনি কিন্তু হঠাৎ করে চুপ হয়ে গেলেন। বেশ বুঝতে পারলাম, কোথায় কোন তারের সুরে তিনি যেন কিছুক্ষণের জন্য আটকা পড়ে গেছেন। তারপর মাথাটা ধীরে ধীরে সোজা করলেন আর চশমাটা বার কয়েক মুছে এবার মুখোমুখি হলেন, ‘দ্যাখো, আমি বরিশালের একজন মানুষ হিসেবে গর্বিত। বরিশালের সেই সব স্মৃতি আমার জন্য শুধুই কোনো নস্টালজিক বিষয় না। এই স্মৃতিগুলো আমার প্রতিদিনের জীবনের নিত্য খোরাক। আমি এই স্মৃতির মাঝেই প্রতিদিন বেঁচে আছি, বেঁচে থাকি। একটা কথা বুঝতে হবে বরিশালের আলো-হাওয়ায় আমার শিরের শিরা-উপশিরায়। তাদের প্রতিদিনের জীবনের খুনসুটি, ইগো—যা-ই বলো না কেন, সবকিছুই কিন্তু আমি ধারণ করেই আমার এই যাপিত জীবন। আমার ছেলেবেলা কাটিয়েছি বরিশালে। আমার শৈশব স্মৃতি আমার জীবনের এক অমূল্য সম্পদ। তবে এ কথা ঠিক যে বরিশালের মানুষ নিয়ে কথা বললে এর শেষ করা যাবে না। শেরেবাংলা এক বিশাল মাপের মানুষ ছিলেন। তবে আমার মনে হয় অনেক বরিশালিই হয়তো এই বিশাল মাপের মানুষকে সঠিকভাবে চিনতে পেরেছিলেন। আগে বুঝতাম না এখন বুঝি যে শেরেবাংলা কত দূরদর্শী ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বর্তমানে যেকোনো রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে বিরল। তবে এ কথা ঠিক, বরিশালের মানুষ সম্পর্কে জানতে হলে বুঝতে হলে তাদের মন আর মানসিকতা সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। তা না হলে অনেক ক্ষেত্রেই ভুল ধারণার জন্ম হতে পারে। যেমন একটা উদাহরণ দেই। আমার কাকা গেলেন কলকাতায়। সেখানে তিনি কাপড় কিনবেন। কলাকাতার নিউমার্কেটে একটা দোকানে দোকানির সাথে তিনি কথা বলছেন। দেখা গেল কাপড়ের দোকানদার তিনি নিজেও একজন বরিশালের মানুষ। আর যায় কোথায়? ঐ কাপড়ের দোকানদারও বুঝে ফেল্লেন যে আমার কাকা বরিশালের মানুষ। তাঁদের মাঝে দর-কষাকষি শুরু হয়ে গেল। কাকা জিজ্ঞেস করলেন, “দাম কত?” দোকানির উত্তর “এত।” কাকা বললেন, “দাম এত ক্যান? এই দামে তো নেওয়া যাবে না।” দোকানির উত্তর, “না নিলে না নিবেন, ঠেকলাম কিসে?” এই হলো বরিশালের মানুষের মন। একটা ইগো কাজ করে।
‘আমরা যারা বরিশালের, বিষয়টা আমাদের জন্য সহজ কিন্তু বাইরের অনেকেই হয়তো বিষয়টা ভুল বুঝতে পারে। যেমন ধরা যাক বরিশালের মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম সব সময় খুব উঁচু। মনে হবে বুঝি রোম সভ্যতার পরই বরিশালের স্থান। জোয়ান বুড়া সবাই বরিশালের নামী ব্যক্তিত্বদের নাম মুখস্থ করে বসে আছে। তুমি একটু জিজ্ঞেস করলেই সব মুখস্থের মতো বলে দিবে। আরেকটা কথা বলব, আমাদের সময়ে ছাত্র মহলে প্রেমে ব্যর্থ যুবকদের বেশ কদর ছিল। তাদেরকে কেমন জানি একটু হিরো হিরো মনে হতো। আর সে কারণেই বরিশালের সব যুবকই নিজেদের রোমিও ভাবত। বুকের মধ্যে ভালোবাসা বেঁধে চিঠির সাথে ইটের টুকরা বেঁধে প্রেমিকার উদ্দেশে ঢিল দিত। আর সেই চিঠি কখনো কখনো প্রেমিকার সামনে না পড়ে প্রেমিকার বাবার সামনে পড়লে তো বুঝতেই পারো কী দুরবস্থা! তবে আমরা সেই সব বীর যুবককে নিয়ে গর্ব করতাম। বলতে গেলে প্রেম বিষয়টা বরিশালের একটা ঐতিহ্যের মধ্যেই পড়ে। একজন সফল প্রেমিকের ভাষায়, “হ্যারে দেইখ্যা ত” পেরথমেই লাভে পড়িয়া গেলাম। হ্যার পর নদীর ধারে দুই দিন “ফলো” করলাম। তিন দিনের দিন একটু আন্ধার হইতেই ফোকাস মারলাম।’
বলার অপেক্ষা রাখে না তাঁর রসসমৃদ্ধ বাক্যবাণে আমরা হেসে মাটিতে লুটোপুটি খাই আরকি। তপন রায় কিন্তু নির্বিকারভাবে তাঁর কথা বলেই যাচ্ছেন। শুধু থেমে থেমে তাঁর ঘন মোটা ভ্রু কেঁপে উঠছে। বেশ বোঝাই যাই তিনিও বেশ মজা পাচ্ছেন।
আচ্ছা, তপনদা, বাঙালনামায় আপনি দেশভাগ নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন। তা ছাড়া হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথা উঠে এসেছে। বিষয়টা নিয়ে আপনার মতটা আবারও আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই। বরিশালের রসসমৃদ্ধ জীবন নিয়ে এতক্ষণ আমাদের আলোচনা যে তা তা থৈ থৈ নৃত্যে চলছিল, এ ধরনের কঠিন প্রশ্নে আমাদের স্বাভাবিক কথাবার্তায় কোথায় যেন একটু ছেদ পড়ল। কিন্তু তপন বাবুকে মনে হলো, এ ধরনের প্রশ্নের অপেক্ষায় তিনি যেন বসে ছিলেন। ‘দেখো, আমরা বলি ব্রিটিশরা হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে একটা বিবাদের দেয়াল তুলে দিয়ে গেছে। আমি কিন্তু এটা বিশ্বাস করি না। ব্রিটিশ আসার আগেও হিন্দু-মুসলমানদের সাথে সম্পর্ক খারাপ ছিল। আসল বিষয়টা হলো ধর্ম মানেই এমন। আমারটাই শ্রেষ্ঠ। তবে হ্যাঁ, এই ধর্মকে কেন্দ্র করে আমাদের সাম্যতা কতটুকু ব্যাহত হয়েছে সেটা হলো কথা। আমি বলব অনেকটুকুই। এই দেশভাগের কোনো ফসল আমরা পাইনি। দেশভাগের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে উত্তর ভারতের মুসলমানদের। এখন পর্যন্ত মারামারি-কাটাকাটি লেগেই আছে। আমি কিছুদিন আগে পাকিস্তান গিয়েছিলাম। ভাবতেই পারবে না আমি সেখান থেকে কী যে ভালোবাসাটা পেয়েছি। একটা পাঞ্জাবির দোকানে চা খাচ্ছিলাম। চা খাওয়ার পর এর বিল দিতে যাব। এই দেখে পাঞ্জাবি চায়ের স্টলের মালিক আমাকে কিছুক্ষণ তিরস্কার করলেন। তারপর চায়ের বিল দিতে আমাকে নিবৃত করলেন। আমরা তখন কেউ ভাবিনি যে আমি হিন্দু আর উনি মুসলমান। কথা হলো সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় কে হিন্দু আর কে মুসলমান—এসব নেই। ধর্মকে মানুষ ব্যবহার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। আমরা এই সাধারণ মানুষেরা কিন্তু এর করুণ শিকার ছাড়া আর কিছুই না। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য এই ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। এই সত্যটা তো একদম জলের মতোই পরিষ্কার।’