ঢাবির স্মৃতিকথা: একটি সকালের গল্প

বন্ধু নন্দলাল দাসের (বাঁয়ে) সঙ্গে লেখক। ছবিটি মতিঝিল বলাকা চত্বরে ১৯৮৫ সালের দিকে তোলা।
ছবি: সংগৃহীত

ফেসবুকের পরিচয়ের পর ইউরোপ থেকে ঢাকায় গিয়ে মানুষ বিয়ে করে বুকে টেনে নেয়—এমন সংবাদ এসেছে পত্রিকায়। এমনই অনেক ঘটনার সূত্রপাত ও রচয়িতা ফেসবুক। ৩৩ বছর কেউ কথা না রাখলেও ৩৩ বছর আগে যৌবনের গন্ধে মাতাল বন্ধুরা হারিয়ে যাওয়া পর ফেসবুকের মাধ্যমেই আবার জীবনের নেশাজাগানিয়া পড়ন্ত বেলায় ফিরে আসে।

ভোররাতে উঠে ফোন হাতে নিয়ে বিস্মিত হয়ে দেখি কাঞ্চনের মিসডকল। মেসেঞ্জারে ম্যাসেজ লেখার পর প্রতি-উত্তর দেয় সে। ওর পাঠানো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করি। দুজনেরই দুই প্রান্ত থেকে লেখালেখি চলছে, কাঞ্চন গ্রুপ ছবি দেয়, মঈনের প্রোফাইল লিংক ও বন্ধুদের মেসেঞ্জার লিংক পাঠায়। অন্যদিকে, মঈনের পেজে মন্তব্যে লিখি, আমি বিরাশির ব্যাচ। কয়েক সেকেন্ডে মঈন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে লেখে, দোস্ত, অ্যাকসেপ্ট কর। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল! এর মাঝে এভাবে ভোরের ডানায় চড়ে বয়ে যায় অনেকটা সময়। সাড়ে তিন দশকের অন্ধকার ফিকে হয়ে আসে আকাশে। নতুন একটা ভোর দেখা দেয়। সূর্যোদয়ের পর ফোনে মুখোমুখি হই কাঞ্চনের।

কাঞ্চনকে দেখে বলি, তুমি তো তালপাতার সিপাহি ছিলে। দাদি-নানিরা বলতেন, বিয়ের পর মেয়েদের স্বাস্থ্য ভালো হয়। তুমিও দেখি নাদুসনুদুস হয়েছ। তোমার বেলায় উল্টো হয়েছে। কেমন করে পেলে আমার প্রোফাইল? দুলালকে বলেছিলাম তোমার কথা, তুমি কোথায় হারিয়ে গেলে! তোমাকে ও দুলালকে আমার বাসার ফোন নম্বর দিয়েছিলাম, সেটি কি ছিনতাই হয়ে গিয়েছে? ষাটের দশকের বাসার ল্যান্ড ফোনটি আজও বাজে।

দুলাল বলল তোমার সঙ্গে ওর যোগাযোগের কথা। দুলালই তোমার প্রোফাইলের লিংক দিয়েছে। তোমার মনে আছে বেবির কথা? হুম্‌, মনে আছে। ও তো নেই, মারা গিয়েছে। তুমি জানো কেমন করে? তোমার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল? তৌফিক সব সময় তোমার কথা বলে, ছেলেটা কোথায় হারিয়ে গেল। আচ্ছা, ওর ফোন নম্বর দিয়ো। নন্দ ওর বিয়ের কার্ড দিয়েছিল, যেতে পারিনি। নন্দর সেলে শতাধিকবার ফোন করেছি। অপরিচিত নম্বর দেখে হয়তো ফোন রিসিভ করে না। মনে হয় ওর ভেতর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’র ভয় ভর করেছে। রীনার খবর জানো? রীনা তো নেই, আকাশের ঠিকানায়! বলো কী! তুমি আর আমি টিএসসির ক্যাফেটেরিয়াতে দুপুরে খেতাম। যদিও ভাতই খেতাম প্রতিদিন।

লাইব্রেরির পূর্ব দিকে ছাপরা রেস্তোরাঁর মুরগির ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েছি কতশতবার। আসো, আজ আবার একসঙ্গে ভাত খাই। তোমার কাছ থেকে প্রায়ই টাকা ধার নিয়ে আমি বই কিনতাম টিএসসির বুক স্টোর থেকে। মনে আছে তোমার? ওমর কোথায়? ওমর মনে মনে একটা মেয়েকে ভালোবাসত। বলতাম, দেখতে ও তো তোর খালাম্মা হয়। এরশাদের মাস্তানরা ওকে মেরেছিল। আমি তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়ে সড়ক ভবন পর্যন্ত পৌঁছে রিকশা নিয়ে গুলিস্তান গিয়েছিলাম। ওমর এখন সাংবাদিকতা করে। আচ্ছা, হাই কোথায় জানো? ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনে আছে। তুমি অপরাজেয় বাংলার কাছে একটা গ্রুপ ছবি ও পিকনিকের ছবি পাঠিয়েছ। ছবিতে আমি নেই কেন? আশি সাল থেকেই তো ফটোগ্রাফি করি।

ক্লাসে এক সহপাঠী হাতে ফুল নিয়ে খেলা করছিল, রফিক স্যার জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমার হাতে কী? ওর ফুল উচ্চারণ সঠিক হয়নি, এ জন্য স্যার ওকে তিরস্কার করেছিলেন। আরেক দিন আরেকটি ছেলের শার্টের বুকের ওপরের দিকের দুটি বোতাম খোলা ছিল, স্যার ওকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলেন। ভাতঘুম উপেক্ষা করে আকরাম স্যারের ক্লাসে যেতে হতো। সকালে আটটার আগে আনন্দ বাস থেকে নেমে দক্ষিণের গেটে চা খেয়ে ধূম্ররাশি উদ্‌গিরণ করে ক্লাসে যেতাম। দুলাল ক্লাসে দেরিতে এসে বলেছিল, হলে থেকেও আটটার ক্লাসে যথাসময়ে হাজির হতে পারি না। তুই অত দূর থেকে এত সকালে আসিস কেমন করে? বিরাশির সকাল ও আজকের সকাল কী এক বিস্ময় উন্মোচন করে আজ আমার কাছে।

আবেগতাড়িত সকালটি রঙিন টিউলিপ হাতে নিয়ে চলে যেতে চাইলে মঈনের ফোন তাকে পেছন থেকে টেনে ধরে। সকালের গায়ে হেলান দিয়ে মঈন বলে, কেমন আছ? সব খুলে বলো তো। কেমন করে পঁচাশির পর আজ আবার যোগাযোগ হলো আটলান্টিকের ওপার থেকে? তোমার ছেলেমেয়ে কে কিসে পড়ে? তুমি কি করো? তোমার গ্রামের বাড়ি কোথায়? তোমার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ থেকে আর কে কে আসত? রাশি রাশি সোনার ধানে কবির তরি ভরে গেলেও প্রশ্নকর্তা প্রশ্ন করেও যে তার মন ভরে না। আমি, দুলাল, কাঞ্চন, রীনা—এ কয়জন সব সময় একসঙ্গেই থাকতাম। মলয়ও ছিল আমাদের সঙ্গে। দুলাল এক ঈদে গ্রামের বাড়ি যায়নি, হলেই ছিল। ঈদের দিন দুলাল আমার বাসায় গিয়েছিল। তোমার প্রোফাইল থেকে তোমার লেখাটি তিনবার পড়েছি। লেখাটি অসাধারণ সুন্দর ও দীর্ঘ পরিশ্রমের ফসল। আজ ভোরে কাঞ্চনের সঙ্গে যোগাযোগ হয় সাড়ে তিন দশক পর। কাঞ্চনের পাঠানো তোমার লিংকটা পেয়ে সূর্যোদয়ের আগে আমি খুবই আবেগতাড়িত হয়ে পড়ি।

এত দিন দেখেছি স্কুল, কলেজের সহপাঠীরা যে যার মতো করে না বলে হুটহাট করে চলে যাচ্ছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের চলে যাওয়ার পদশব্দে সকালের রোদ ভারী হয়ে উঠছে। এভাবে কাছের মানুষদের না বলে চলে যাওয়াটা কি খুব বেশি জরুরি।