ঢাকার যানজট: একটি বাস্তবমুখী স্বল্পমেয়াদি প্রস্তাবনা

সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার যানজটের চিত্র। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় অপেক্ষা করতে হচ্ছে নগরবাসীকে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুকলে আজকাল যে বিষয়টি সহজেই চোখে পড়ে, তা হচ্ছে ঢাকার যানজট নিয়ে ভুক্তভোগী মানুষের ক্ষোভ আর হতাশা। এ নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকেরাও বেশ উদ্বিগ্ন। তাই নানাবিধ প্রকল্প ও ব্যবস্থার জন্য ব্যয় করা হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। প্রায় প্রতিদিনই পত্রপত্রিকায় এ বিষয় নিয়ে বের হচ্ছে নানবিধ প্রতিবেদন ও বিশেষজ্ঞ মতামত। তথাপি দিন দিন পরিস্থিতি কেবল খারাপের দিকেই যাচ্ছে।

ঢাকা একটি অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ নগর, যেখানে সড়কের আয়তন সীমিত আর বাসিন্দাদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির। স্বাভাবিকভাবেই বাস, সাইকেল আর হাঁটা হতে পারে এখানকার প্রধানতম ও সহজলভ্য পরিবহনমাধ্যম। কিন্তু বিশৃঙ্খল বাস সার্ভিস, অগণিত রিকশা আর ফুটপাত দখলের কারণে নিরাপদ ভ্রমণের তাগিদে ধারদেনা করে হলেও অনেক মধ্যবিত্ত এখন ব্যক্তিগত গাড়ি কিনছেন। ফলে রিকশার পাশাপাশি এ বর্ধিঞ্চু গাড়ির বহর এখন ঢাকাকে ক্রমেই এক অচল শহরে পরিণত করছে।

ঢাকার বাস্তবতা বিবেচনায় বাস, ট্যাক্সি, সাইকেল, পদযাত্রা (হাঁটা)—এই চার স্তরের একটি শৃঙ্খলিত পরিবহনের মডেল এখানে আলোচনা করা হলো। আলোচনা ও প্রস্তাবিত নানা মডেলের একটি সারাংশ হিসেবে এ মডেল আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পুরোপুরি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঢাকাকে একটি চলমান নগরে পরিণত করা সম্ভব।

প্রথমেই আসা যাক বাস সার্ভিসের বিষয়ে। বেপরোয়া চলাচল, লক্কড়ঝক্কড় অবস্থা, অসংখ্য ও বিভাজিত মালিকানা, মালিক–শ্রমিকদের মধ্যে ভ্রান্তি, ফ্র্যাঞ্চাইজিসহ নানা উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিবেচনায় সরকারকে অংশীজনদের সঙ্গে নিয়ে পুরো সার্ভিসকে নতুন করে সাজাতে হবে। এটা হবে একটি পাবলিক-প্রাইভেট ফরম্যাট, যাতে সব পক্ষই লাভবান হবে।

সরকার বিভিন্ন রুট নির্ধারণ করে সড়ক বিন্যাসভেদে পর্যাপ্তসংখ্যক দোতলা, বড়, মিনি ও মাইক্রোবাসের সংখ্যা নির্ধারণ করে দেবে। বর্তমান বাসমালিকেরা তাঁদের আগের বাসগুলোর পরিবর্তে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমসংখ্যক নতুন বাস পাবে। পুরোনো ও নতুন বাসের মূল্যমানের পার্থক্য বিবেচনায় ব্যাংক থেকে তাঁদের সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে। বাসগুলো পরিচালিত হবে একটি কেন্দ্রীয় সংস্থার অধীন, যার পরিচালনা বোর্ডে মালিক, শ্রমিক, যাত্রী ও অন্যান্য অংশীজনের প্রতিনিধি থাকবে।

বাসগুলো সময় ধরে চলবে ও শুধু নির্ধারিত স্থানে থামবে। বাসস্ট্যান্ডগুলোতে ফেয়ার মেশিনে ইলেকট্রনিক বাস কার্ড কেনার ও টাকা ভরার ব্যবস্থা থাকবে। প্রতিটি স্থানে যাত্রীদের সাহায্য করার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে এক–দুজন কর্মী নিয়োজিত থাকবেন। বাসে শুধু একজন চালক থাকবেন। ওঠা ও নামার সময়ে যাত্রীরা বাস কার্ড নির্ধারিত কার্ড রিডারে ছোঁয়াবেন এবং দূরত্ব অনুসারে ইলেকট্রনিকভাবে ভাড়া কেটে রাখা হবে।

মেট্রোরেল
ফাইল ছবি

বাস ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত সব অর্থ একটি কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা হবে। আর্থিক মডেলের ভিত্তিতে চুক্তি মোতাবেক প্রতি মাসে বাসমালিকদের অ্যাকাউন্টে কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে টাকা জমা হবে। বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত হলেও জনস্বার্থে সরকারকে হয়তো কিছু ভর্তুকি দিতে হবে। তবে এর ফলে বেশি যাত্রীর আশায় বাসের অনিয়মিত চলাচল, বিপজ্জনক প্রতিযোগিতা, যেখানে-সেখানে থামাসহ যাবতীয় সমস্যার সমাধান হবে।

যেহেতু কার্ড নিয়ে প্রতারণার আশঙ্কা আছে, কাজেই ফেয়ার মেশিন বাদে অন্যত্র কার্ড বিক্রির বিষয়ে ঝুঁকি বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে কার্ডে বিকাশের মতো ব্যবস্থায় টাকা ভরার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কোনো রকম নগদ টিকিটের ব্যবস্থা না থাকা ও বাসে কোনো কন্ডাক্টর না থাকার ফলে ভাড়া নিয়ে দুর্নীতি থাকবে না। এ ছাড়া বাস কন্ডাক্টর না থাকায় বাসের পরিচালনা ব্যয় কিছুটা কম হবে। বাসচালকদের নিয়োগ ও কল্যাণ কার্যক্রম–সংক্রান্ত আইনের বিধান মোতাবেক নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিশ্চিত করবে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতি মাসে বাসগুলোর ফিটনেস ও যাত্রীবান্ধব পরিবেশ পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নির্দেশ করবে এবং সব তথ্য কেন্দ্রীয় ডেটাবেইসে সংরক্ষণ করবে। বাসের মেরামতসহ সব বিষয়ে দায়দায়িত্ব মালিক পক্ষের। ফলে বিআরটিসির বাসগুলোর মেরামত নিয়ে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়, তা এখানে হবে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মানদণ্ড অনুসারে বাস চালাতে ব্যর্থ হলে বাসের পারমিট বাতিলসহ জরিমানা ও অন্যান্য দণ্ড কঠোরভাবে আরোপ করতে হবে। এভাবে সব পক্ষের সন্তুষ্টির মাধ্যমে ঢাকায় একটি সুন্দর বাস সার্ভিস নিশ্চিত করা যেতে পারে।

বাসের বাইরে পর্যাপ্তসংখ্যক ট্যাক্সি ও উবার জাতীয় শেয়ার্ড সার্ভিস হবে দ্বিতীয় স্তরের গণপরিবহন। এগুলোকে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে চলতে হবে। আর ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল যত দূর সম্ভব নিরুৎসাহিত করতে হবে। ফলে এদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে এবং যানজট অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও যানজট বিবেচনায় স্থানীয় পর্যায়ে যাতায়াতের জন্য উন্নত দেশগুলোতে বর্তমানে হাঁটা ও বাইসাইকেল ব্যবহার উৎসাহিত করা হচ্ছে। ঢাকা শহরের প্রায় সব এলাকায় বাজার, মসজিদ, স্কুল, ক্লাব, এমনকি বিভিন্ন ব্র্যান্ড শপ, কমিউনিটি সেন্টারসহ অন্যান্য সুবিধা গড়ে উঠেছে। অর্থাৎ এক থেকে তিন কিলোমিটারের মধ্যেই অধিকাংশ কাজ সারা সম্ভব হচ্ছে। কাজেই, হেঁটে বা সাইকেলে করে এসব কাজ সহজে করা সম্ভব।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন সড়কগুলো যেখানে সম্ভব ফুটপাতসহ উন্নয়ন করছে। কিন্তু দোকানপাটের বর্ধিত অংশ, নির্মাণসামগ্রীর স্তূপ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি সমস্যার কারণে বাচ্চা ও নারীদের পক্ষে অনেক এলাকাতেই হাঁটার সুযোগ নেওয়া সম্ভব হয় না। সামাজিক অংশগ্রহণ ও আইনের কঠিন প্রয়োগে অল্প সময়ে এসব সমস্যার সমাধান করে সবার জন্য হাঁটা সহজ ও আনন্দময় করা সম্ভব।

রিকশা উঠিয়ে দিতে হবে ধাপে ধাপে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে। তার জায়গায় অ্যাকটিভ ট্রান্সপোর্ট হিসেবে আসবে নানা ধরনের সাইকেল, যাতে সব বয়সের নারী-পুরুষ এগুলো ব্যবহার করতে পারে। বাজার, বড় বাসস্ট্যান্ড, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি জায়গায় সাইকেল রাখার নিরাপদ ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া উন্নত দেশের আদলে সিটি করপোরেশন বা প্রাইভেট সেক্টরের উদ্যোগে ভাড়ায় ব্যবহারের জন্য নানা জায়গায় সাইকেল রাখা যেতে পারে।

হাঁটা ও সাইকেল ব্যবহার এবং রিকশা বিতাড়নের কারণে অলিগলিতে যানজট বেশ কমে আসবে। তবে কিছুটা ফাঁকা পেয়ে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে ঢাকায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। তাই সড়কে গতিসীমা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। ঢাকার বাস্তবতায় এটা বড় সড়কে ৫০ কিমি, অলিগলিতে ২০ কিমি, আর অন্যান্য সড়কে ৩০–৪০ কিমি করা যেতে পারে।

মানুষের নিরাপত্তা ও নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করতে সড়কের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ও বাসে সিসি টিভি, সড়ক সিগন্যাল ব্যবস্থা, স্পিড ক্যামেরা, যাত্রীদের সিট বেল্ট, সাইকেল চালকদের হেলমেট, দুর্ঘটনা ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সহযোগে উন্নত ট্রাফিক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে। উন্নত দেশের অভিজ্ঞতায় কোনো প্রকৌশল সংস্থার মাধ্যমে এ–সংক্রান্ত ভৌত কাজের ডিজাইন ও বাস্তবায়ন এবং পুলিশ বিভাগের মাধ্যমে আইনি প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

সরকার উদ্যোগী হলে জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে পদযাত্রা-সাইকেল-ট্যাক্সি-বাসের এ মডেল বাস্তবায়ন কোনো কঠিন কাজ নয়। এর পাশাপাশি বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন মেট্রো, বিআরটি ও এক্সপ্রেসওয়ে যোগ হলে ঢাকার যাতায়াতব্যবস্থা দ্রুতই উন্নত হবে বলে আশা করা যায়। নতুনভাবে নৌপথে দ্রুতগতির ওয়াটার বাস সার্ভিস চালুর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। নানাবিধ কারণে এ পর্যন্ত নৌপথের উদ্যোগগুলো ব্যর্থ হলেও জুতসই ডিজাইন ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একে জনপ্রিয় করা সম্ভব।

শত সমস্যার মধ্যেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় দেশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলো একে একে বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে। এই ক্রমসঞ্চিত অভিজ্ঞতা ও সাহসের বলে ঢাকায় একটি লাগসই পরিবহনব্যবস্থা ঢাকায় গড়ে তোলা অবশ্যই সম্ভব। এ ক্ষেত্রে মেট্রো, বিআরটি, নৌপথ ও দূরপাল্লার দোতলা বাস রুটগুলোকে ঘিরে যথাযথ ইন্টারফেস–সহকারে পদযাত্রা-সাইকেল-ট্যাক্সি-বাস মডেলটি একটি ভালো সম্ভাবনা নির্দেশ করে। প্রস্তাবিত অন্যান্য পরিবহন মডেলের পাশাপাশি তাই এটা নিয়েও বিশদ আলোচনা করা যেতে পারে।

  • লেখক: ড. শফিক আলম, সিপিইঞ্জ-অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সওজ প্রকৌশলী