বহু জনারণ্যের দেশ যুক্তরাষ্ট্র জাতিগত লড়াই করে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হয়েছে। বারবার বাঁক বদল করে এ লড়াই এগিয়ে চলেছে। আজকের যুক্তরাষ্ট্রেও বর্ণবৈষম্য আর বর্ণবাদ অবসানে রাজপথে স্লোগান উঠে। আজও রক্ত ঝরে সমতার দাবিতে।
জাতিগত সম্প্রীতির ডানায় উড়ে নিউইয়র্ক নগরের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মেয়র হয়েছিলেন এক নাপিতের ছেলে। নাম তাঁর ডেভিড এন ডিনকিন্স। ২৩ নভেম্বর রাতে নগরের আপার ইষ্ট সাইড ম্যানহাটনে নিজ ঘরে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর বয়স ছিল ৯৩ বছর।
ডিনকিন্সের স্ত্রী জয়েস ডিনকিন্স (৮৯) মারা যাওয়ার দুই মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে মৃত্যু হল মার্কিন রাজনীতির এক আইকন হয়ে ওঠা ডেভিড ডিনকিন্সের।
নিউইয়র্ক নগরের সাবেক মেয়র ডেভিড ডিনকিন্সের মৃত্যুতে একজন সত্যিকারের স্থপতি হারিয়েছে বিশ্ব। অন্য যেকোনো মেয়রের তুলনায় ডিনকিন্সই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি এমন এক সময়ে গথাম সিটির অধিবেশন শুরু করেছিলেন, যখন নিউইয়র্ক নগরের নৈতিকতা ছিল বিধ্বস্ত।
বর্ণবাদ, দুর্নীতি, অপরাধ ও আর্থিক সংকট নিয়ে ক্লান্ত ভোটারদের জন্য ডিনকিন্স ছিলেন একজন সত্যিকারের জননেতা। প্রার্থী হয়ে তিনি একদা বিধ্বস্ত নগরের সফল তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছিলাম। অনেক রাজনীতিবিদের মতে, ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের ১০৬তম মেয়র হিসেবে ডেভিড ডিনকিন্স ছিলেন সফল।
নিউইয়র্ক নগরের প্রথম ও একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ মেয়র ডেভিড এন ডিনকিন্সের মৃত্যু তাঁর সমসাময়িক অনেককেই শোকাহত করেছে। ২৪ নভেম্বর বর্তমান মেয়র ডি ব্লাজিও বলেছেন, ‘তিনি আমাদের উন্নততর পথে চালিত করেছেন এবং তিনি তা হৃদয় ও উষ্ণতা এবং ভালোবাসার সঙ্গে করেছেন।’
এক টুইট বার্তায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বলেন, ‘মি. ডিনকিন্স ছিলেন একজন ট্রেলব্লেজার, ভদ্রলোক ও আমার বন্ধু।’
সাবেক মেয়র রুডি জুলিয়ানি এক সময় ডিনকিন্সের কঠোর সমালোচক ছিলেন। মঙ্গলবার ভোরে তিনি টুইট করে বলেন, ‘আমাদের মহান নগরের সেবায় ডিনকিন্স যেন জীবনের এক বিরাট চুক্তি করেছিলেন।’
ডিনকিন্সের ক্যাম্পেইন কর্মী হিসেবে কাজ করেছিলেন রাজনীতি বিজ্ঞানী ডগলাস মুজিও, যিনি বর্তমানে সিটি মেয়র ডিব্লাজিওর সঙ্গে একই অফিস ভাগ করেছেন। মুজিও বলেন, মি.ডিনকিন্স ছিলেন একজন সতর্ক হারলেম ডেমোক্র্যাট। যিনি তুলনামূলকভাবে সামান্য নির্বাচনী ও নিয়োগকারী অফিসের মাধ্যমে সিটি হলে গিয়েছিলেন। তিনি নিউইয়র্কবাসীকে ‘গর্জিয়াস মোজাইক’ বলতে পছন্দ করতেন।
ডেভিড ডিনকিন্সের নীতিগত প্রচেষ্টার অনেকটাই ছিল শিশুদের জন্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিশুরা ঘৃণা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। ডিনকিন্সের প্রথম ডেপুটি মেয়র নরম্যান স্টেইসেল তাঁকে স্মরণ করে বলেন, ‘তিনি তরুণ-তরুণীদের জন্য আরও নিরাপদ, আরও সম্ভাবনার পরিবেশ তৈরি করতে যথেষ্ট সময় ও চিন্তাভাবনা ব্যয় করেছিলেন।’
স্টেইসেল বলেন, তার সেফ স্ট্রিটস, সেফ সিটি প্রোগ্রাম, যা পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলেছিল এবং অপরাধ নির্মুলে নিউইয়র্কের সাফল্যের ভিত্তি হিসেবে কৃতিত্ব পেয়েছিল। যুবসমাজকে সমৃদ্ধ করার জন্য কাজ করেছেন ডিনকিন্স। এমনকি তিনি অফিস ছাড়ার পরও সিস্টেমের অভ্যন্তরীণ কাজগুলো পর্যবেক্ষণ করতেন। এমন কাজের জন্য পারিবারিক আদালতের বিচারক জুডি অ্যাডামসের আদালতকক্ষে পর্যন্ত গিয়েছিলেন।’
ডিনকিন্সের মৃত্যুর পর নিউইয়র্কের অ্যাটর্নি জেনারেল লেটিসিয়া জেমসসহ একাধিক বিশিষ্ট নিউইয়র্কার্স মি. ডিনকিন্সের উদার মানসিকতা ও আন্তরিক মানবিকতার প্রশংসা করেন।
মিসেস জেমস বলেন, ‘কয়েক দশক ধরে মেয়র ডিনকিন্স আমাদের সম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতি এবং একটি অতুলনীয় প্রতিশ্রুতি নিয়ে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন।’
ডায়ানি মোরালেস আগামী নভেম্বরের নির্বাচনে মেয়র ডি ব্লাজিওকে আবারও মেয়র হিসেবে দেখার প্রত্যাশী। তিনি ডিনকিন্সকে ক্ষমতাবান ও নগরের এক শক্তিশালী মুখপাত্র বলে অভিহিত করেন। ব্রঙ্কসের রাজ্য সিনেটর জামাল টি বেইলি ডিনকিন্সকে সত্যিকারের ট্রেলব্লেজার ও কিংবদন্তি বলে অভিহিত করেছেন।
ওবামা প্রশাসনের সময় দক্ষিণ আফ্রিকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত থাকা প্যাট্রিক গ্যাস্পার্ড বলেন, ‘মি. ডিনকিন্স নিজেই অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন।’
মেয়র হিসেবে ডেভিড এন ডিনকিন্স নিউইয়র্ক নগরের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রবল আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। তিনি নগরের গ্রন্থাগারগুলো উন্মুক্ত রেখেছিলেন। টাইমস স্কয়ারকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন এবং ব্রঙ্কস, ব্রুকলিন ও হারলেমে আবাসন গড়ে তুলেছিলেন। তিনি শহরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করপোরেশন তৈরি করেছিলেন এবং নিউইয়র্ক নগরে করপোরেট সদর দপ্তর ধরে রাখতে লড়াই করেছিলেন। তবে ‘বর্ণবাদী মৈত্রী’ যা তার সবচেয়ে প্রিয় আশা ছিল, তা একটি সুদূর স্বপ্ন হিসেবেই থেকে যায়।
১৯৯১ সালে ক্রাউন হাইটসে চার দিনব্যাপী জাতিগত সহিংসতা নিয়ে সমালোচনায় পড়েছিলেন ডিনকিন্স। এর জের ধরে ১৯৯৩ সালে ভোটাররা ডিনকিন্সকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তিনি শহরের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ অপরাধের কয়েকটি সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন। জুলিয়ানি ও ডিনকিন্স পুলিশবিরোধী ছিলেন—এমন একটি আখ্যান জোরালোভাবে কার্যকর করতেও চেষ্টা করা হয়েছিল।
নিউইয়র্ক নগরের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মেয়র হিসেবে ইতিহাসে সুরক্ষিত ডেভিড ডিনকিন্সকে পরবর্তীতে কিছুটা শান্ত প্রবীণ রাজনীতিবিদ হিসেবে দেখা গেছে। সে সময় তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। ডব্লিউওএলআইবিতে একটি রেডিও টকশো হোস্ট করেছেন। সংবর্ধনা, ডিনার ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশ নিতে দেখা গেছে। মাঝে মাঝে তিনি উপস্থিত থাকতেন মেয়র মাইকেল আর ব্লুমবার্গসহ অন্য অফিস কর্মকর্তাদের সঙ্গে। বিভিন্ন অনুসন্ধানের পরামর্শও দিতেন তিনি।
ডেভিড নরম্যান ডিনকিন্স ১৯২৭ সালের ১০ জুলাই নিউজার্সির ক্যাপিটাল সিটি ট্রেনটনে জন্ম নেন। তিনি একাধারে ছিলেন মার্কিন রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও লেখক। তিনি ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্ক নগরের ১০৬তম মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনিই প্রথম আফ্রিকান–আমেরিকান হিসেবে এই পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।