ডিডিএলজের সানেনে কয়েকটি অমূল্য মুহূর্ত
ছোটবেলায় প্রিয় সিনেমা ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ ব্রিজের ওপরে দাঁড়ানো শাহরুখ খানের একটি বিখ্যাত সিন আছে, যেখানে রাজ ম্যানডালিন কাঁধে তুলতে তুলতে নিজেকে বলে, ‘এই মেয়েটি যদি আমাকে ভালোবাসে, তাহলে সে পিছে ফিরে আমার দিকে তাকাবে, পালাট পালাট পালাট’? ওই দৃশ্যটি যেই স্থানে শুট করা হয়েছে তার নাম সানেন। আমার ওই ব্রিজটি পর্যন্ত পৌঁছানো একটি স্মরণীয় ঘটনা ছিল...সেই ভ্রমণটি নিয়েই আজকে বলব।
সানেন হচ্ছে সুইজারল্যান্ডের মধ্যে অবস্থিত ছোট একটি গ্রাম। ছবির মতো সাজানো ঝকঝকে তকতকে ও নয়নাভিরাম। জুরিখ, জেনেভা, বার্ন বা লুজার্নের মতো বড় শহরগুলোতে যেমন সারাক্ষণ ভিজিটরদের ভিড় লেগে থাকে, সবাইকে খুব উৎসাহ ও উত্তেজনা নিয়ে বেড়াতে, ছবি তুলতে দেখা যায়, সানেন এ গিয়ে ঠিক তার উল্টো ব্যাপার চোখে পড়ে। হট্টগোলের থেকে একদম আলাদা, চুপচাপ শান্তশিষ্ট, ফাঁকা ফাঁকা সবকিছু। আমাদের ট্যুর যেই কোম্পানি থেকে অ্যারেঞ্জ করে দিয়েছিল, সেখানে সানেন দর্শন অন্তর্ভুক্ত ছিল না। অনেক চেষ্টা করেও সানেনকে প্যাকেজের আওতায় আনতে পারছিলাম না—যিনি সব পরিকল্পনা করেছিলেন, তার বক্তব্য ছিল তিনি যেভাবে প্ল্যান করেছেন, তাতে আমরা মন্ট্রেক্স (সুইজারল্যান্ডের একটি নামকরা সিটি, যেখানে ঐতিহাসিক চিলন ক্যাসেল আছে) থেকে গোল্ডেন পাস প্যানারোমিক ট্রেনে ছয় ঘণ্টার জার্নি করে ইন্টারলাখেন (আরেকটি দর্শনীয় শহর এবং যেখানে বেশির ভাগ ফিল্মের শুটিং হয়) পৌঁছাব। ট্রেনের ওই ছয় ঘণ্টার যাত্রাতে আমরা কাচের স্বচ্ছ জানালা দিয়ে বেশ কয়েকটি দারুণ সুন্দর গ্রাম দেখতে পাব, কেননা ট্রেনটি গ্রামগুলোর ভেতর দিয়েই যাবে। আর সব গ্রামের সিনারি কমবেশি একই রকম—একটি, দুটি দেখলে সব কটি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়...আলাদা করে সানেন এ নামার প্রয়োজনীয়তা নেই। ট্যুর প্ল্যানারের কথা শুনে মনে মনে বললাম, ‘প্রয়োজনটা যে কি, তা যদি তুমি বুঝতে তাহলে তো হতোই’...সেই বালিকা বয়সে ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ দেখেছি, তখন থেকে আমি টার্গেট করে রেখেছি ইউরোপে গেলে সবার আগে সুইজারল্যান্ডে যাব। যে যে জায়গায় সিনেমার দৃশ্যায়ন হয়েছে, সব কটি ঘুরে ঘুরে দেখব। তার মধ্যে সানেন তো অত্যাবশ্যক কারণ ছবিটির রোমান্টিক মুহূর্তগুলোর ৪০ শতাংশ শুটিংই সানেনে হয়েছে। আর নারী বলে কিনা দরকার নেই যাওয়ার! হতাশ হয়ে বরের দিকে তাকালাম। সে চোখের ইশারায় আমাকে আশ্বস্ত করল। বোঝাতে চাইল, টেনশন নিয়ো না, দেখছি কী করা যায়...
বাড়িতে ফিরে আমরা নিজেরাই ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। অনেক খোঁজাখুঁজি ও গবেষণা করে বর একটি আইডিয়া দিল। সেটা হলো আমরা নারীর প্ল্যান অনুযায়ী মন্ট্রেক্স থেকে ট্রেনে ইন্টারলাখেনের উদ্দেশে রওনা দেব। দুই ঘণ্টা পর সানেন স্টেশনে ট্রেন এক মিনিটের জন্য থামবে। আমরা সেখানে নেমে যাব। গ্রামটি যেহেতু ছোট তাই স্টেশন থেকে গ্রামের ভেতরে ঢুকে আমাদের প্রেফারেবল জায়গাগুলো হেঁটে হেঁটেই আমরা দর্শন করতে পারব। আমাদের তিন চার ঘণ্টার বেশি লাগবে না। তাই আমাদের সেখানে রাতে থাকার দরকার নেই। খামোখা ট্যুর প্ল্যান এলোমেলো করে হোটেল খুঁজে রাতে থেকে পরের দিন যদি সেম ট্রেনের টিকিট না পাই, ঝামেলা হয়ে যাবে। তাই যা ঘোরাঘুরি ওই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই করে ইন্টারলাখেনের ট্রেন এ উঠে যাব। গোল্ডেন পাসের টিকিট নিয়মটা এমন যে এক দিনে আমরা ওই সেম ট্রেন আবার ব্যবহার করতে পারব। কয়েক ঘণ্টা পরপর ওই ট্রেনটি সানেন স্টেশনের ওপর দিয়ে যায়...অতএব চার ঘণ্টা পরে যে ট্রেনটি আসবে সেটাতে আমরা উঠে পড়তে পারব, টিকিট যেহেতু কাটাই আছে। আর কোনো অপশন ছিল না দেখে আমি এটাতেই রাজি হয়ে গেলাম। সময় কম হোক, তবু সানেন দেখা তো হবে!
যেভাবে ভেবে রেখেছিলাম, নির্দিষ্ট দিনে ঠিক সেভাবেই করলাম সবকিছু। ওহ হ্যাঁ বলতে ভুলতে গেছি, সুইজারল্যান্ড গেলে অন্তত একবার হলেও গোল্ডেন পাস প্যানারোমিক ট্রেনে সবার চড়া উচিত। জার্নিটি অপূর্ব। হালকা হলদে রঙের ট্রেনটি দেখতে যেমন স্টাইলিশ ঠিক, তেমনি এর ভেতরের বসার ডেকগুলোও দারুণ। ট্রেনের জানালা দিয়ে কয়েক ঘণ্টা বাইরের অতীব অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করার সেই অভিজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা ঈশ্বর আমাকে দেননি...প্রচণ্ড সুন্দরের মুখোমুখি হলে মানুষ স্তব্ধ হয়ে যায়, আমিও তাই হয়েছিলাম। চোখধাঁধানো সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে ট্রেনটি ছুটে চলছিল আর আমি সেগুলো প্রাণভরে হৃদয়ে ও স্মৃতিতে ধারণ করতে করতে শুধু এটাই ভাবছিলাম সৃষ্টিকর্তার মহিমা কতখানি অপার হলে এ রকম কিছু বানানো সম্ভব! একই সঙ্গে মুগ্ধ, স্তম্ভিত এবং অতিশয় আনন্দিত আমি তখনই মনে মন ঠিক করে ফেললাম, যদি আবার কখনো সুইজারল্যান্ডে আসা হয়, তবে মন্ট্রেক্স থেকে ইন্টারলাখেন এর এই ট্রেন ভ্রমণটি আমি আবার করব।
যাই হোক, পূর্বের প্রসঙ্গে ফিরে আসি, প্ল্যান অনুযায়ী সানেন এ নেমে গেলাম আমরা। স্টেশন থেকেই গ্রামটি অনেকটা দেখা যাচ্ছিল, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছোট ছোট কান্ট্রি হাউসেস, মনোরম সবুজ রঙের মাঠের মধ্যে ভেড়ার পাল, লোকাল মার্কেট, কিছু হোটেল, খাবারের দোকান। সব মিলিয়ে ছিমছাম পরিপাটি, অদ্ভুত এক শান্তি শান্তি ভাব...যেন কেউ খুব যত্নে সাজিয়ে দিয়ে গেছে। একটু হাঁটার পরই দেখতে পেলাম গ্রামে গরুর হাট বসেছে, দেখতে অনেকটা মেলার মতো লাগছিল (সম্ভবত ওদের লোকাল কোনো সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত ব্যাপারটি)...একপাশে সারি বেঁধে গরুর গলায় পরানোর বিশাল আকারের ঘণ্টাগুলঝোলানোনো ছিল। সেগুলো দেখে বাচ্চাদের মতো উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। ডিডিএলজের প্রেমের সিনগুলোতে এ ঘণ্টার বিশেষ ভূমিকা আছে তা কি আর ভোলা যায়? এরপর চোখে পড়ল সেই বিখ্যাত চার্চটি, যেটায় সিমরানের জন্য প্রথমবারের মতো প্রার্থনা করে রাজ। এই চার্চটি ভেতরের চেয়ে বাইরে থেকে দেখতে বেশি সুন্দর। চার্চের সামনে কিছু ছবি তোলার পর গেলাম সেই রানওয়েতে, যেখানে রাজ প্লেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়ায় ‘মেরে খোয়াবো মে যো আয়ে’ গানটির একটি দৃশ্যে। জায়গাটি খুব বড় নয়, তবে দেখতে দারুণ। খানিক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত ব্রিজটির ওপর দাঁড়ালাম। নিচে লেক, টলটলে পানি বয়ে যাওয়ার মিষ্টি আওয়াজ, চারপাশে মৃদুমন্দ বাতাস আর ব্রিজের গা ঘষে দাঁড়িয়ে আমরা দুজন। অদ্ভুত রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি! জায়গা আর পরিবেশ দুটিই এমন জাদুকরী, যে কেউ সম্মোহিত হতে বাধ্য। আহা, সে বড় ভালো লাগার সময়!
মুগ্ধতার রেশ কাটানো দুষ্কর ছিল, ফিরতে মন চাইছিল না। তবু ফিরতে তো হবেই। আবার স্টেশনে আসলাম, এসে স্টেশনের চারপাশটা একটু ঘুরে দেখলাম। পেছনের দিকে কোনাকুনি একটা ভিন্ন শেপ এর চাকাওয়ালা একটি বসার জায়গা ছিল...এখানেও আমার একটি প্রিয় দৃশ্যে চিত্রায়ণ হয়েছে (কফি খেতে খেতে মেয়েটি যখন প্রথমবারের মতো ছেলেটিকে বলে সে আরেকজনের বাগ্দত্তা), অবাক হয়ে ভাবলাম, এই এতগুলো বছরপরও এটি একই জায়গায় একই রকমভাবে আছে? ফিল্মে যেমন দেখেছি, হুবহু তাই...আর একদম অক্ষত! পরে বুঝলাম, এটি জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য নয়, তাই এত নিখুঁতভাবে সংরক্ষণ সম্ভব হয়েছে। ছবি তোলা অ্যালাউড কি না, সেটা জিজ্ঞেস করার জন্য এক পা আগাতেই হাসব্যান্ড জানাল ট্রেন এর টাইম হয়ে গেছে। আমাদের এখনই নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে...ট্রেনটি মাত্র ১ মিনিট দাঁড়ায় এবং সেদিনের জন্য সেটি লাস্ট ট্রেন তাই কোনোভাবেই ট্রেনটি মিস করা যাবে না। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে ওকে অনুসরণ করলাম তখন, সেই জায়গাটির ছবি আর তোলা হলো না। পরে একটু আফসোস হয়েছিল, সত্যি কিন্তু যেটুকু পেয়েছি তার তুলনায় অতটুকু দুঃখ নগণ্য ছিল...খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও আমার ছোটবেলার একটি শখ খুব সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পূরণ হয়েছিল। ওই দিনের ওই কয়েকটি ঘণ্টা আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তগুলোর অংশ হয়ে আছে, চিরদিন থাকবে।
ভ্রমণ তো আমরা কতই করি, ভালোমন্দ, বিচিত্র কত অভিজ্ঞতাই তো আমাদের হয় ভ্রমণে গিয়ে, কিন্তু শৈশবের লালিত স্বপ্ন এ রকম যথাযথভাবে জীবনে বাস্তবায়নের সুযোগ আমাদের বড় একটা আসে না। আর এ জন্যই এই ভ্রমণ কাহিনিটির মুহূর্তগুলো আমার হৃদয়ের এতটা কাছের। পৃথিবীর অনেকগুলো দেশ আমি ভ্রমণ করেছি, অনেক কিছু দেখে মুগ্ধ হয়েছি, এমনকি খোদ সুইজারল্যান্ডেই সানেনের থেকে অনেক বেশি সুন্দর জায়গায় গিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়েছি, তবুও সানেনের অনুভূতিটা একেবারেই আলাদা, অন্য রকম স্পেশাল!
*সারা বুশরা, সুইজারল্যান্ড