২০২০ সাল এসেছে মানব ইতিহাসে শতবর্ষের কঠিনতম সংকটকাল নিয়ে। বৈশ্বিক মহামারির কারণে একদিকে মৃত্যুর মিছিলে আমরা শোকাহত, অন্যদিকে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে পেশাগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রে বন্ধ্যত্ব আমাদের বিপর্যস্ত করছে। তবে মানুষের সৃজনশীল ভাবনা থেমে নেই। সকল সীমাবদ্ধতা মেনেও নতুন উপায়ে ও কৌশলে কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ প্রচেষ্টায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, সহজ কথায় অনলাইন মাধ্যম। সংকট থেকে উত্তরণে মানুষ অনলাইন মাধ্যমের অভিনব ব্যবহার আবিষ্কার ও প্রয়োগ করে চলেছে জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রে। এ থেকে বাদ যায়নি নাটকও।
নাটক সাধারণত তিনটি মাধ্যমে অভিনীত হয়—বেতার, টেলিভিশন ও মঞ্চে। বেতার বা শ্রুতি নাটক মহামারির কারণে খুব বেশি সংকটে পড়েনি। কারণ, নাট্যশিল্পীদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রেখে বা তাঁদের ভিন্ন স্থানে রেখেও অভিনয়ের শব্দধারণ করে নাটক নির্মাণ করা যায়। টেলিভিশন নাটক বাধাগ্রস্ত হয়েছে ব্যাপকভাবে। কারণ, সব শিল্পী ও কলাকুশলীদের এক স্থানে এসে নাটকের দৃশ্য গ্রহণ করতে হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মঞ্চনাটক। বলা যায়, একদম বন্ধ হয়ে গেছে পুরো মঞ্চনাটক শিল্প। কারণ, মঞ্চনাটকের জন্য শুধু নাট্যশিল্পী ও কুশলীরাই নয়, দর্শকদেরও একই স্থানে জড়ো হতে হয়। যদিও কিছু প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল বা ভাবা হয়েছিল; যেমন, এক আসন বাদ দিয়ে দিয়ে দর্শকদের বসানো। কিন্তু কার্যত তা সফল হয়নি। ফলে প্রায় বছরখানেক ধরে মঞ্চনাটকে স্থবিরতা চলছে।
অনলাইন মাধ্যমে নাটক পাঠ, চরিত্র বিশ্লেষণ, নাট্যকর্মশালা ইত্যাদি প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বিশ্বজুড়ে। এরই মধ্যে ২০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিল্পাঙ্গন-এর উদ্যোগে আয়োজিত হলো অনলাইন নাট্যমেলা। এ নাট্যমেলা সংকটকালে নাট্যচর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে
তবে অনলাইন মাধ্যমে ইদানীং নানা আলোচনা শুরু হয়েছে নাটক নিয়ে। প্রথম উদ্যোগ হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত নাট্যশিল্পী ও কুশলীদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে তহবিল সংগ্রহ করা হয়েছে ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক পর্যায়ে। এর পর সংকটকালে নাট্যচর্চার সম্ভাবনা নিয়ে বোদ্ধাজন ভাবতে শুরু করেছেন। অনলাইন মাধ্যমে নাটক পাঠ, চরিত্র বিশ্লেষণ, নাট্যকর্মশালা ইত্যাদি প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বিশ্বজুড়ে। এরই মধ্যে ২০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিল্পাঙ্গন-এর উদ্যোগে আয়োজিত হলো অনলাইন নাট্যমেলা। এ নাট্যমেলা সংকটকালে নাট্যচর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
মঞ্চনাটকের অত্যাবশ্যকীয় অংশগুলোর মধ্যে রয়েছে মঞ্চ, মঞ্চসজ্জা, আলো, শব্দ, অভিনয়শিল্পী, নেপথ্য কুশলী ও দর্শক। মঞ্চের সীমিত পরিসরে মঞ্চসজ্জা, আলো ও শব্দ প্রয়োগে একটি প্রতীকী দৃশ্যের উপস্থাপন করা হয়। এখানে কখনোই বাস্তব দৃশ্য তৈরি বা উপস্থাপনার প্রয়াস থাকে না। কারণ, প্রতীকী দৃশ্যও অভিনয় করছে এবং দর্শকদের সামনে একটি গল্প বা বক্তব্য উপস্থাপন করছে। মঞ্চের সীমিত পরিসরে অভিনয়ের জন্য শিল্পীদেরও ভিন্ন আঙ্গিক তৈরি করতে হয়, যা টেলিভিশন বা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের রীতি থেকে ভিন্ন। সব শেষে দর্শকও একটি নাটকের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। দর্শকের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, দর্শকের মধ্য থেকে অভিনয় শিল্পীর উপস্থাপনা ইত্যাদি একটি নাটকের অভিনয়ে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। যেহেতু সবগুলো উপকরণই জীবন্ত এবং প্রতিদিনই পাল্টায়, সেহেতু একই নাটকের বিভিন্ন মঞ্চায়ন ভিন্ন ভিন্ন ব্যঞ্জনা উপহার দেয়। নাট্যশিল্পী ও কুশলীরা প্রতি মঞ্চায়নেই নাটকের গল্প ও চরিত্রকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন, নতুন বিশ্লেষণ যোগ করেন। এসব কারণেই মঞ্চ নাটক নাট্যদল ও দর্শক উভয়ের কাছেই অতি প্রিয়, যা প্রতি মঞ্চায়নে নতুন নাট্যরসের আস্বাদন দিয়ে থাকে। প্রশ্ন হলো ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার কি প্রকৃত নাট্যরসের উপস্থাপন করতে পারবে? তাহলে টেলিভিশন নাটক থেকে মঞ্চনাটকের পার্থক্য থাকল কোথায়?
প্রথমত, মঞ্চনাটকে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার মোটেও নতুন নয়। নাটকের গল্প, দৃশ্য, চরিত্র ও বক্তব্য উপস্থাপনে প্রযুক্তির নানাবিধ ব্যবহার ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। এবার শুধু যোগ করা হচ্ছে ক্যামেরা ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে মঞ্চাভিনয়কে সরাসরি দর্শকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। নাট্যশিল্পী ও কুশলীদের উপস্থাপনা একই থাকছে। শুধু দর্শকের আসনে দর্শকের চোখকে ক্যামেরা দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। একটি নির্দিষ্ট আসনে বসে দর্শক মঞ্চে যে অভিনয় দেখতেন, এখনো তা-ই দেখছেন; তবে দূরে বসে। এটা ঠিক, মিলনায়তনে অন্ধকারে বসে সরাসরি দেখার যে অনুভূতি, তার হয়তো কিছুটা কমতি হচ্ছে। কিন্তু একেবারে দেখা থেকে বঞ্চিত হওয়ার চেয়ে এটা অবশ্যই ভালো। একইভাবে নাট্যশিল্পীরা হয়তো দর্শকের সরাসরি প্রতিক্রিয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কিন্তু নাট্যাভিনয় তো অব্যাহত রাখা যাচ্ছে। অন্যদিকে এর ব্যাপক প্রচারের কথাও ভুললে চলবে না। মঞ্চে যে কয়েকজন দর্শক নাটকটি দেখতে পেত, এখন তার চেয়ে বহুগুণ বেশি দর্শক নাটকটি দেখার সুযোগ পাচ্ছে। এ লক্ষ্যেই বহু বছর আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে মঞ্চনাটক নিয়মিত প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এখনো বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন থেকে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে মঞ্চনাটক প্রচারের জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
ডিজিটাল প্রযুক্তির নাম শুনলে সবাই টেলিভিশন নাটকের সঙ্গে মঞ্চনাটককে গুলিয়ে ফেলে। মঞ্চনাটক মঞ্চেই সরাসরি অভিনীত হবে, টেলিভিশন নাটকের মতো বিভিন্ন দৃশ্যে বিভিন্ন ক্যামেরায় ধারণ করে পরে তা সম্পাদনা করে উপস্থাপন করা নয়।
আমাদের বর্তমান সভ্যতায় ডিজিটাল প্রযুক্তিকে অস্বীকার করলে চলবে না। একদিকে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের ব্যস্ততা, অন্যদিকে ডিজিটাল প্রযুক্তির অভাবনীয় প্রসার—এ বাস্তবতা মেনে নিয়ে এর ভেতরে মঞ্চনাটককে কীভাবে ব্যাপক ও সমৃদ্ধ করা যায়, তা ভাবতে হবে। ইতিমধ্যে চলচ্চিত্র ও অন্যান্য শিল্পমাধ্যম অনলাইন মাধ্যমে বিস্তার লাভ শুরু করেছে
করোনাকালে নাট্যশিল্পীদেরও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিধান রয়েছে। এ বিধান মেনে নাটক উপস্থাপনায় কিছু আপস করতে হবে। প্রথমত, খুব বেশি চরিত্রের নাটক নিয়ে কাজ করা যাবে না; নাট্যশিল্পী ও কুশলীদের সংখ্যা যতটা সম্ভব কম রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তির ব্যবহার করেও বিভিন্ন শিল্পী ভিন্ন ভিন্ন স্থানে থেকেও মঞ্চাভিনয় ও সম্প্রচার করা যেতে পারে। অনেকেই নিজেদের বাসায় বা আশপাশে ছোট পরিসরে মঞ্চ তৈরি করে নাটক উপস্থাপনের উদ্যোগ নিচ্ছেন, যা খুবই ইতিবাচক।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত শিল্পাঙ্গন অনলাইন নাট্যমেলায় এ ধরনের বেশ কিছু উদ্যোগের ফসল দর্শক ও বোদ্ধাজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিভিন্ন নাট্যব্যক্তিত্ব ও নাট্যদল তাদের সীমাবদ্ধতা ও নিরাপত্তা বিধান মেনেই সমৃদ্ধ কিছু নাটক উপস্থাপন করেছে। এতে বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিভিন্ন শহরের নাট্যব্যক্তিত্ব ও নাট্যদল অংশ নিয়েছেন, যা একটি আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবের রূপ ধারণ করেছে।
মঞ্চনাটক একটি পেশাদার শিল্প। এর জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ, চর্চা ও উপস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি। করোনা সংকট কয়েক দিনের বা কয়েক মাসের নয়, বছর বা তারও অধিককালের হতে পারে। এ দীর্ঘ সময়ে মঞ্চনাটক চর্চা যদি বন্ধ থাকে, তবে তো এ শিল্প অস্তিত্বের সংকটেই পড়বে। নাট্যশিল্পী ও কুশলীরা হতাশ হয়ে নাটক ছেড়ে দিতে পারেন কিংবা অন্য মাধ্যমে জড়িত হতে পারেন। এর পর স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে এলে মঞ্চনাটক শিল্পী ও কুশলী সংকটের সম্মুখীন হবে।
আমাদের বর্তমান সভ্যতায় ডিজিটাল প্রযুক্তিকে অস্বীকার করলে চলবে না। একদিকে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের ব্যস্ততা, অন্যদিকে ডিজিটাল প্রযুক্তির অভাবনীয় প্রসার—এ বাস্তবতা মেনে নিয়ে এর ভেতরে মঞ্চনাটককে কীভাবে ব্যাপক ও সমৃদ্ধ করা যায়, তা ভাবতে হবে। ইতিমধ্যে চলচ্চিত্র ও অন্যান্য শিল্পমাধ্যম অনলাইন মাধ্যমে বিস্তার লাভ শুরু করেছে। মঞ্চনাটক সনাতনী ভাবনা আঁকড়ে থাকলে আগামী পৃথিবীতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
লেখক: অধ্যাপক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক, ফার্মিংডেল, নিউইয়র্ক