ডাক্তারকে নিয়ে বলার আগে হাজারবার ভাবুন

Untitled-11
Untitled-11

জনগণের এক বুলি, ডাক্তাররা তাদের ট্যাক্সের টাকায় পড়ে ডাক্তার হয়েছে, তাই তাদের জন্য জীবন উৎসর্গ করতেই হবে। এই ফালতু কনসেপ্ট কে এদের মাথায় ঢুকিয়েছে? বাকিরা কার বাপের টাকায় পড়ে? ওই যে ট্যাক্সের কোটি টাকার গাড়িতে যারা চড়ছে, তাদের একবেলা আপনাদেরই ট্যাক্সের টাকার গাড়িতে লিফট দিতে বইলেন একবার!

সরকারি সব স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিই ভর্তুকির টাকায় চলে। মাস্টার্স পাসের পর লোকজনের পড়াশোনার খরচ নাই। ডাক্তারদের আছে। দেশের বাইরে ডিগ্রি আনতে গেলে সে খরচ তো ধরলাম ই না। সেগুলোও পকেট থেকেই যায়। সরকারের ভর্তুকিতে প্রতিটা বাঙালিই পড়ে, প্রাইভেট বাদে। প্রতিটা ডাক্তারই ট্যাক্স দেয়, এভারেজের চেয়ে বেশিই দেয়। তাই ডাক্তারেরা শুধু জনগণের টাকায় পড়ে, সেটা বলার আগে নিজেদের মুখটা চেপে রাখাই উচিত।
ভর্তুকি কোথায় নেই? কৃষি খাতে আছে, গার্মেন্টসে আছে, পুলিশ, সামরিক বাহিনী, সরকারি প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি—সব জায়গাতেই আছে। আমলাদের বেতন কোথা থেকে আসে?


সরকারি বিনিয়োগ না হলে, দান না হলে, ইউনিভার্সিটি হতো না? ব্যক্তিমালিকানায়ও হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দানের জমিতেই প্রতিষ্ঠিত। জনগণের জন্য হসপিটাল না হলে চিকিৎসা হতো না। মেডিকেল কলেজ না হলে, ডাক্তার হতো না জনগণের চিকিৎসা দিতে! মেধাবীরা ডাক্তারিতে না গেলেও হয়তো হতো! কারণ, সন্ত্রাসীরাও পেট ফাড়ে! কিন্তু আপনার অ্যাপেন্ডিক্স বার্স্ট হলে আপনি সন্ত্রাসীর ছুরির নিচে যান না। বিশ্বাস করে কার কাছে যান?
ডাক্তার। ডাক্তারের কাছে। কারণ বিশ্বাস। ডাক্তারই একমাত্র আপনার ভালো চায়, আপনার পরে সেভাবেই তাদের ট্রেনিং।

ছবিটি প্রতীকী। ছবি: রয়টার্স
ছবিটি প্রতীকী। ছবি: রয়টার্স

তাদের কোনো দিন ২০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে আপনার অপারেশন করতে?
বা কারও অপারেশন করতে বা দেখাতে?   তারা তাদের কাজের দাম নিয়েছে মাত্র।

এখন আসি, যা সবাই বলে, সেবার মানসিকতা! সেটা না থাকলে কার দায় পড়ে ২০-৩০ বছর এক্সট্রা বা বুড়ো বয়স পর্যন্ত পড়তে?


সেবার মানসিকতা? আপনি এই কথাটা প্লিজ সবাইকে বলেন, পয়সা নয়, সেবার মানসিকতা নিয়ে পড়াশোনা করেন। প্লিজ এই কথা রাজউককে বলেন, ভূমি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ফার্ম, পুলিশ, পাসপোর্ট অফিস, বিমান, আইনজীবী, রাজনীতিক সবাইকে বলেন। ইভেন মহাখালীর ডিজি অফিসকে বলেন। ঘুষ ডাক্তারের অফিসে যায়, না কোথায় যায়, সেটা আপনারা সবাই জানেন। কেরানি হাজার কোটি টাকা কই পায়?


বলবেন তো ডাক্তার কমিশন খায়, ডাক্তার ফার্মাসির পয়সা খায়। ডাক্তার যদি শুধু জেনেরিক ওষুধ লেখে, প্রতিটা ফার্মা আর তার সঙ্গে জড়িত লোক না খেয়ে মরবে। আরও আছে, ওই ওষুধ না লিখলে আপনারা নতুন ওষুধ কোথায় পাবেন?

কিন্তু জানেন কি? সরকারি হাসপাতালে দেশে কোনো মেশিনই চলে না। তাদের ২৪/৭ চালানোর পর্যাপ্ত মেশিন নেই। টেকনিশিয়ান নেই। ডাক্তারদের কারণে বা তাদের জন্য?
না রে ভাই, ডাক্তাররা ৪২ লাখ টাকার পর্দা, কোটি টাকার মেশিন কেনে না! সেগুলো চালায় না। সেগুলো কে চালায়? প্রশাসন। ফার্মার ওষুধ রোগীদের বিনা মূল্যে কে দেয়? ডাক্তার। তাদের ওষুধ না লিখলে, লাখ লাখ, কোটি কোটি লোক ওই ফ্রি ওষুধ পাবে না।


হাসপাতালে টিকিট কে দেয়? হাসপাতালে নিয়ম কারা বানায়? ডাক্তার? না রে ভাই। কলুর বলদের মতো ডাক্তাররা কাজ করে, প্রশাসনের কারণে বদনামের ভাগী হয়। ডাক্তারের কাজ রোগী দেখা, প্রেসক্রিপশন লেখা পর্যন্তই। ওষুধ খাওয়ানো, নল লাগানো, বেড দেওয়া, ট্রলি, খাবার দেওয়া, ফ্লুইড দেওয়া, রক্ত দেওয়া নার্সের কাজ, সহকারীদের কাজ। অত নার্স আছে আপনার? ডাক্তাররা সেই কাজটিও করে, আপনাদের সুবিধার জন্য। একবারও বলে না সেটা তাদের দায়িত্ব নয়।


কোনো খারাপ ডাক্তার নাই? থাকতে পারে ০.০০১ শতাংশ, যেখানে অন্য জায়গায় ভালো লোকের সংখ্যা ০.০০১ শতাংশ, পার্থক্য সেখানে।
আরেকটা বিষয়, প্রতিটা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কারণই হলো আপনি শিক্ষিত হবেন, স্কিল শিখবেন, ওয়ার্কফোর্সে যোগদান করবেন। ডাক্তারিও তাই, যাস্ট প্রফেশন। যার কাজ সেবা দেওয়া। সেবার বিনিময়ে জীবনধারণের অর্থ উপার্জন করা। শুধু শুধু তাদের কাছে আকাশকুসুম আশা না করাই উচিত। এটা তাদের কাজ। তারা কর্মী মাত্র। তারা রাজা-রানি নয় যে শুধু গাঁটের পয়সায়, বিনা মূল্যের সেবা দিয়ে যাবে। রাজার করও আদায় হয় জনগণের কাছ থেকে। মুলো, আলুটা বিনা পয়সায় পান প্রতিদিন, না ইলিশটা ফ্রি পান?


শুধু ডাক্তারের দায় পড়ছে জীবন তেজপাতা করার?


আবার ভাবেন একবার, এরা যদি ডাক্তার না হয়ে, প্রশাসনের সব পদ দখল করত, বাকিরা ডাক্তার হতো- নিজেদের কী অবস্থায় পেতেন?
বাঙালি এক ঘরেই থাকতে পারল না দু-চার সপ্তাহ। ডাক্তারের সমালোচনা করার যোগ্যতাই এদের নাই! সমালোচনা করতে হয়; নিজেদের সমালোচনা করেন আগে। সেটা তো পারবেন না। দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো মানুষ আপনি। দোষ সব ডাক্তারের।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সেবার কথাগুলো চালচোরদের বলেন, বলেন তাদের, যারা সবকিছুতে বাঁশ দেয়, সিমেন্টের বদলে অন্য কিছু দেয়, পয়সা বিদেশে পাচার করে, ব্যাংক চেটেপুটে খাইছে তাদের। এই কথাগুলো যারা রাস্তায় মানুষ মারে তাদের বলেন। এই কথাগুলো যারা রাস্তায় মানুষ নামাল তাদের বলেন। ভালোমানুষি সুন্দর কথাগুলো তাদের বলেন যারা দূরত্ব বজায় রেখে টেঁটা মারছে, মরদেহ রাস্তায় ফেলে যাচ্ছে, হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা না দেওয়ার জন্য আন্দোলন করছে, মিথ্যে বলে অন্যদের সংক্রমিত করছে, মরলে খাটিয়া দিচ্ছে না, ঘরে জায়গা দিচ্ছে না, তাদের বলেন। সবাই ভালো হলেই বাঁচবেন। এত দিন তো অনেকের হক মারলেন।


যারা ঘরে না থেকে সংক্রমণ ছড়াল, তাদের বলেন। যারা চিকিৎসকের ন্যায্য প্রোটেকশন না দিয়ে, নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে বলেন, নিজেরা ঘরে লুকিয়ে, তাদের বলেন। যারা চিকিৎসকের পিপিই নিয়ে ফটোসেশন করে বেড়াল, তাদের বলেন কেন তারা এসব করল?


আর এখনো কষ্ট করে সবার ঘরে থাকা নিশ্চিত করেন। ১৫০-৫০০ ভেন্টিলেটরের একটাও আপনাদের কপালে জুটবে না। আরও সহজ করে বলি, ওই ভেন্টিলেটর চালানোর জন্য আমার মনে হয় না একজনেরও আইসিইউ লেভেলের ট্রেনিং আছে দেশে।


ডাক্তাররা চাইলেই ঘরে বসে আপনাদের তামাশা দেখতে পারত। কিন্তু সেটা তারা করছে না। সংসার- সন্তানদের ফেলে কাজে যাচ্ছে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে শেখেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কেউ ছোট হয় না।
ভয় করেন। প্রার্থনা করেন সৃষ্টিকর্তার কাছে, যাতে আপনি বা আপনারা সুস্থ থাকেন। আর করোনার পরে যে অর্থনৈতিক ডিপ্রেশন হবে, তার থেকে বাঁচতেও প্রার্থনায় থাকেন।